ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাকাত প্রদানের নিয়মনীতি

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
জাকাত প্রদানের নিয়মনীতি

কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা তাঁর অনুগত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন, ‘তারা যা কিছু দান করে, এভাবে দান করে যে, তাদের হৃদয় ভীতকম্পিত থাকে (এ কথা ভেবে) যে, তারা তাদের রবের কাছে ফিরে যাবে।’ (সুরা মুমিনুন : ৬০)। এক আয়াতে মোমিনদের সম্বোধন করে বলেন, ‘তোমরা তো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই ব্যয় করে থাক। যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় কর, তার পুরস্কার তোমাদের পুরোপুরিভাবে প্রদান করা হবে এবং তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৭২)। অন্য এক আয়াতে ঈমানদারদের সতর্ক করা হয়েছে, তারা যেন অসংযত আচরণের মাধ্যমে তাদের দান-সদকাকে ব্যর্থ না করে দেয়। এরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা অনুগ্রহ ফলিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-সদকাকে বিনষ্ট করো না ওই লোকের মতো, যে লোক দেখানোর জন্য সম্পদ ব্যয় করে আর আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের ওপর ঈমান রাখে না।’ (সুরা বাকারা : ২৬৪)। কোরআনুল কারিমের এসব আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, বিনয়, আল্লাহভীতি, ইখলাস ও আখলাকে হাসানা হলো দান-সদকা আল্লাহর দরবারে মকবুল হওয়ার অভ্যন্তরীণ শর্ত। এসব বিষয়ে যত্নবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়মতো জাকাত আদায় করে দেয়া কর্তব্য।

জাকাত আদায়ে বিলম্ব না করা

বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর জাকাত আদায়ে বিলম্ব করা যায় না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি, তোমরা তা থেকে ব্যয় করবে তোমাদের কারও মৃত্যু আসার আগে। অন্যথায় মৃত্যু এলে সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরও কিছু কালের অবকাশ কেন দিলে না! তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ (সুরা মোনাফিকুন : ১০)। এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো, নেসাবের মালিক হওয়ার সময়টি সামনে রাখা এবং ঠিক তার এক বছর পর সেই সময়েই জাকাত আদায় করা। নির্দিষ্ট সময়টি জানা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো মাসের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত নয়।

জাকাত প্রদানের নিয়ত জরুরি

যেদিন এক বছর পূর্ণ হবে, সেদিনই জাকাত আদায় করা ফরজ। এরপর যখনই জাকাত আদায় করুক, সে পরিমাণই আদায় করতে হবে, যা সেদিন ফরজ হয়েছিল। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১০৫৫৯)। বছর পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষের হিসাব ধর্তব্য, সৌরবর্ষের নয়। জাকাত আদায় হওয়ার জন্য জাকাত প্রদানের নিয়ত করা জরুরি। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৫৮)। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশেই জাকাত প্রদান করতে হবে। জনসমর্থন অর্জনের জন্য, লোকের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কিংবা অন্য কোনো জাগতিক উদ্দেশে জাকাত দেয়া হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। (সুরা বাকারা : ২৬৪)।

জাকাতের টাকা পৃথক করে রাখার নিয়ম

জাকাতের উপযুক্ত খাতে যেমন ফকির-মিসকিনকে দেয়ার সময় জাকাতের নিয়ত করতে হবে। এটাই মূল নিয়ম। তবে নিজের সম্পদ থেকে জাকাতের টাকা পৃথক করে রাখলে পৃথক করার সময়ের নিয়তই যথেষ্ট হবে। এখান থেকে ফকির-মিসকিনকে দেয়ার সময় নতুন নিয়ত না করলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৮)। জাকাতের উদ্দেশে টাকা পৃথক করে রাখলেও মালিক তা প্রয়োজনে খরচ করতে পারবে। তবে পরে জাকাত আদায়ের সময় জাকাতের নিয়ত করতে হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১০৩৯১-১০৩৯২)।

দান করার সময় জাকাতের নিয়ত

জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কিছু টাকা দান করা হয়েছে, কিন্তু দান করার সময় দানকারীর মনে জাকাতের নিয়ত ছিল না; তাহলে গ্রহীতার কাছে সেই টাকা বিদ্যমান থাকাবস্থায় জাকাতের নিয়ত করলে জাকাত আদায় হবে। তদ্রƒপ জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কোনো খাদ্যদ্রব্য প্রদান করা হলে গ্রহীতা তা খেয়ে ফেলার বা বিক্রি করে দেয়ার আগে জাকাতের নিয়ত করলেও জাকাত আদায় হবে। এরপর জাকাতের নিয়ত করলে জাকাত হিসেবে আদায় হবে না। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৬৮, রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৮-২৬৯)। তবে জাকাতের টাকা আলাদা করে রাখা হয়েছে; কিন্তু ফকির-মিসকিনকে দেয়ার আগেই তা চুরি হয়ে গেল বা অন্য কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেল, তাহলে জাকাত আদায় হয়নি। পুনরায় জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৬৯৩৬-৬৯৩৮, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৬/৫৩১-৫৩২, রদ্দুল মুহতার : ২/২৭০)।

চল্লিশ ভাগের একভাগ জাকাত দেয়া ফরজ

যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ হয়েছে, তার চল্লিশ ভাগের একভাগ (২.৫০ শতাংশ) জাকাত দেয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা হারে নগদ টাকা কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়-চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে। (সুনানে নাসায়ি : ২২৩০-২২৩৩, সুনানে আবি দাউদ : ১৫৭০-১৫৭২, তিরমিজি : ৬২৩, সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৮০৩, মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৭১৩৩-৭১৩৪, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১০৫৩৯-১০৫৮১)। আবার যে পরিমাণ জাকাত ফরজ হয়, স্বেচ্ছায় তার চেয়ে বেশি দিলেও অসুবিধা নেই। এতে জাকাত আদায় এবং বাড়তি দান দু’টোরই সওয়াব পাওয়া যাবে। (মুসনাদে আহমদ : ২০৭৭, মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৬৯০৭)।

অন্যের পক্ষ থেকে জাকাত আদায়ে অনুমতি

জাকাত গ্রহণকারীকে এ কথা জানানোর প্রয়োজন নেই যে, তাকে জাকাত দেয়া হচ্ছে। যে কোনোভাবে দরিদ্র ব্যক্তিকে জাকাতের মাল দেয়া হলে মালিক যদি মনে মনে জাকাতের নিয়ত করে, তাহলে জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার ২/২৬৮)। তবে অন্যের পক্ষ থেকে জাকাত আদায় করতে হলে তার অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় সে ব্যক্তির পক্ষ থেকে জাকাত আদায় হবে না। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৯)। গৃহকর্তা যদি ঘরের লোকদের জাকাত দেয়ার অনুমতি দিয়ে রাখেন, তাহলে তারা জাকাতের নিয়তে কাউকে কিছু দিলে তা জাকাত হিসেবে আদায় হবে। আর যদি পূর্বাগ্রে অনুমতি না দেয়া থাকে আর ঘরের লোকরা জাকাত হিসেবে কিছু দান করে, তাহলে যাকে দান করা হলো, সে সেই অর্থ খরচ করার আগেই যদি গৃহকর্তার অনুমতি পাওয়া যায়, তাহলেও তা জাকাত হিসেবে আদায় হবে। অন্যথায় জাকাত আদায় হবে না। পুনরায় আদায় করতে হবে।

জাকাতের নিয়তে পাওনা মওকুফের নিয়ম

কোনো দরিদ্র ব্যক্তির কাছে কারও কিছু টাকা পাওনা আছে। এখন সে যদি জাকাতের নিয়তে পাওনা মাফ করে দেয়, তাহলে জাকাত আদায় হবে না। তাকে জাকাত দিতে হলে নিয়ম হলো, প্রথমে তাকে জাকাত প্রদান করা, এরপর সেখান থেকে ঋণ উসুল করে নেয়া। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৭০, রদ্দুল মুহতার : ২/২৭১)। ঋণগ্রস্তকেই জাকাতের টাকা প্রদান করা উত্তম। কেননা, এতে তাকে ঋণের দায় থেকে মুক্ত করা হয়। আর কোনো স্বচ্ছল ব্যক্তি যদি জাকাত থেকে গণ্য করা নিয়ত ছাড়াই ঋণগ্রহীতার ঋণ ক্ষমা করে দেয়, তবে তো কথাই নেই। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৭১)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত