কোরআনুল কারিমে জাকাতের খাত নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে। এ খাত ছাড়া অন্য কোথাও জাকাত প্রদান করা জায়েজ নয়। এরশাদ হয়েছে, ‘জাকাত তো শুধু নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও জাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এটি আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তওবা : ৬০)। যে দরিদ্র ব্যক্তির কাছে অতি সামান্য মাল আছে অথবা কিছুই নেই, এমনকি একদিনের খোরাকিও নেই, এমন লোক শরিয়তের দৃষ্টিতে গরিব। তাকে জাকাত দেয়া যাবে।
যার প্রয়োজনের অতিরিক্ত সামগ্রী নেই
যে ব্যক্তির কাছে জাকাতযোগ্য সম্পদ অর্থাৎ সোনা-রুপা, টাকাণ্ডপয়সা, বাণিজ্যদ্রব্য ইত্যাদি নেসাব পরিমাণ আছে, সে শরিয়তের দৃষ্টিতে ধনী। তাকে জাকাত দেয়া যাবে না। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির কাছে জাকাতযোগ্য সম্পদ নেসাব পরিমাণ নেই, কিন্তু অন্য ধরনের সম্পদ যাতে জাকাত আসে না, যেমন- ঘরের আসবাবপত্র, পরিধেয় বস্ত্র, জুতা, গার্হস্থসামগ্রী ইত্যাদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং নেসাব পরিমাণ আছে, তাকেও জাকাত দেয়া যাবে না। (মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৭১৫৬)। তবে যার কাছে জাকাতযোগ্য সম্পদও নেসাব পরিমাণ নেই এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত অন্য ধরনের মাল-সামানাও নেসাব পরিমাণ নেই, এ ব্যক্তিকে জাকাত দেয়া যাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১০৫৩৬)।
যাদেরকে জাকাত দেয়া উত্তম
যে ব্যক্তি এমন ঋণগ্রস্থ যে, ঋণ পরিশোধ করার পর তার কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে না, তাকে জাকাত দেয়া যাবে। কোনো ব্যক্তি নিজ বাড়িতে নেসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী, কিন্তু সফরে এসে অভাবে পড়ে গেছে বা মাল-সামানা চুরি হয়ে গেছে, এমন ব্যক্তিকে জাকাত দেয়া যাবে। তবে এ ব্যক্তির জন্য শুধু প্রয়োজন পরিমাণ গ্রহণ করাই জায়েজ, এর বেশি নয়। জাকাতের টাকা এমন দরিদ্রকে দেয়া উত্তম, যে দ্বীনদার। দ্বীনদার নয় এমন লোক যদি জাকাতের উপযুক্ত হয়, তাহলে তাকেও জাকাত দেয়া যাবে। কিন্তু যদি প্রবল ধারণা হয় যে, জাকাতের টাকা দেয়া হলে লোকটি সে টাকা গোনাহের কাজে ব্যয় করবে, তাহলে তাকে জাকাত দেয়া জায়েজ নয়। তাই জাকাত শুধু মুসলমানদেরই দেয়া যাবে; হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্য কোনো অমুসলিমকে জাকাত দিলে জাকাত আদায় হবে না। তবে নফল দান-খায়রাত অমুসলিমকেও করা যায়। (মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৭১৬৬-৭১৭০, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৬/৫১৬-৫১৭)।
জাকাতের হকদারকেই জাকাত দিতে হবে
জাকাতের টাকা জাকাতের হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। জাকাতের নির্ধারিত খাতে ব্যয় না করে অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হলে জাকাত আদায় হবে না। যেমন- রাস্তাঘাট বা পুল নির্মাণ করা, কুপ খনন করা, বিদ্যুৎ-পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা। জাকাতের টাকা দ্বারা মসজিদণ্ডমাদ্রাসা নির্মাণ করা, ইসলাম প্রচার, ইমামণ্ডমুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা দেয়া, ওয়াজ মাহফিল করা, দ্বীনি বই-পুস্তক ছাপানো, ইসলামি মিডিয়া তথা রেডিও, টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদিও জায়েজ নয়। মোটকথা, জাকাতের টাকা এর হকদারকেই দিতে হবে। অন্য কোনো ভালো খাতে ব্যয় করলেও জাকাত আদায় হবে না। (মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৬৯৪৭-৬৯৪৮, ৭১৩৭-৭১৭০)।
উপযুক্ত ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেয়া জরুরি
জাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত হলো, উপযুক্ত ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দেয়া। যাতে সে নিজের খুশিমতো তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। এরূপ না করে যদি জাকাতদাতা নিজের খুশিমতো দরিদ্র লোকটির কোনো প্রয়োজনে টাকা খরচ করে; যেমন- তার ঘর সংস্কার করে দিল, টয়লেট স্থাপন করে দিলো কিংবা পানি বা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করল, তাহলে জাকাত আদায় হবে না। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৫৭)। নিয়ম হলো, জাকাতের টাকা দরিদ্র ব্যক্তির মালিকানায় দিয়ে দেয়া। এরপর যদি সে নিজের খুশিমতো এসব কাজেই ব্যয় করে, তাহলেও জাকাতদাতার জাকাত আদায় হয়ে যাবে।
জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত আত্মীয়-স্বজনের বিধান
আত্মীয়-স্বজন যদি জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়, তাহলে তাদের জাকাত দেয়া উত্তম। ভাইবোন, ভাতিজা, ভাগ্নে, চাচা, মামা, ফুফু, খালা এবং অন্যান্য আত্মীয়দের জাকাত দেয়া যাবে। (মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৭১৬০-৭১৬১, ৭১৬৪-৭১৭১, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৬/৫৪২-৫৪৬)। দেয়ার সময় জাকাতের উল্লেখ না করে মনে মনে জাকাতের নিয়ত করলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। এ ধরনের ক্ষেত্রে এটাই উত্তম। তবে নিজ পিতামাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, পরদাদা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ যারা তার জন্মের উৎস, তাদের নিজের জাকাত দেয়া জায়েজ নয়। এমনিভাবে নিজের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি এবং তাদের অধস্তনকে নিজ সম্পদের জাকাত দেয়া জায়েজ নয়। স্বামী এবং স্ত্রী একে অপরকে জাকাত দেয়া জায়েজ নয়। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৫৮)।
জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত কাজের লোকের বিধান
বাড়ির কাজের ছেলে বা কাজের মেয়েকে জাকাত দেয়া জায়েজ, যদি তারা জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হয়। তবে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে জাকাতের অর্থ দিলে জাকাত আদায় হবে না। কেউ কেউ কাজের লোক রাখার সময় বলে, মাসে এত টাকা করে পাবে, আর ঈদে একটা বড় অংক পাবে। এ ক্ষেত্রে ঈদের সময় দেয়া টাকা জাকাত হিসেবে প্রদান করা যাবে না। সেটা তার পারিশ্রমিকের অংশ বলেই ধর্তব্য হবে। আর জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত হলে অপ্রাপ্ত বয়স্ককেও জাকাত দেয়া যায়। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৫৭)।
জাকাতের উপযুক্ত ভেবে জাকাত দানের পর অনুপযুক্তির প্রকাশ
কোনো লোককে জাকাতের উপযুক্ত মনে হওয়ায় তাকে জাকাত দেয়া হলো, কিন্তু পরবর্তীতে প্রকাশ পেল যে, লোকটির নেসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তাহলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। পুনরায় জাকাত দিতে হবে না। তবে যাকে জাকাত দেয়া হয়েছে, সে যদি জানতে পারে যে, এটা জাকাতের টাকা ছিল, সে ক্ষেত্রে তার ওপর তা ফেরত দেয়া ওয়াজিব। তবে জাকাত দেয়ার পর যদি জানা যায় যে, জাকাত-গ্রহীতা অমুসলিম ছিল, তাহলে জাকাত আদায় হবে না। পুনরায় জাকাত দিতে হবে। (আল বাহরুর রায়েক : ২/২০১)।