ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ব্যবসায় হালাল-হারাম

ইলিয়াস মশহুদ
ব্যবসায় হালাল-হারাম

ইসলাম একটি শাশ্বত, সার্বজনীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। সৃষ্টিজগতে এমন কোনো দিক নেই, যেখানে ইসলাম নিখুঁত ও স্বচ্ছ দিকনির্দেশনা দেয়নি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমার এ কিতাবে কোনো কিছুই অবর্ণিত রাখিনি।’ (সুরা মায়িদা : ৩৮)। মানুষের জীবন ধারণ এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব আদিকাল থেকেই স্বীকৃত। তবে জীবনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, এরূপ ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। এ জন্য জুমার নামাজের সময় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ কর।’ (সুরা জুমা : ৯)। এ আয়াতে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা করে যে উপার্জন করা হয়, তা-ই সর্বোত্তম।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ২৭৮৩)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যখন ত্যাগ স্বীকার করে সওয়াবের আশায় মুসলিম জনপদে কোনো প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করে এবং ন্যায্যমূল্যে তা বিক্রি করে, আল্লাহর কাছে সে শহিদের মর্যাদা লাভ করে।’ (কুরতুবি : ১৯৭২)।

ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত

ইবাদত কবুলের আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল উপার্জন। আর হালাল উপার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো বৈধ পন্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য করা। ব্যবসা-বাণিজ্য জীবিকা নির্বাহের সর্বোত্তম মাধ্যম হওয়ায় রাসুল (সা.), খোলাফায়ে রাশেদিন, আশারায়ে মোবাশশারাসহ অধিকাংশ সাহাবি, তাবেঈ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)। ইসলামের দৃষ্টিতে ক্রয়-বিক্রয় ব্যবসায় অভিহিত হওয়ার জন্য শর্ত হলো, তা হতে হবে সম্পূর্ণ হালাল পন্থায়। হালাল-হারামের সীমাতিক্রম করলেই তা আর ব্যবসা থাকে না; বরং হয়ে যায় প্রতারণা। হালাল ব্যবসার শর্তগুলোর অন্যতম হলো ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতি। অর্থাৎ ক্রেতার পণ্যটি নেয়ার আগ্রহ থাকবে, বিক্রেতারও তা বিক্রির আগ্রহ থাকতে হবে। উভয়ে যদি ধার্যকৃত মূল্যে সন্তুষ্ট থাকেন, তবেই ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হবে। বিক্রেতা যদি জোর করে ক্রেতার ওপর কোনো জিনিস চাপিয়ে দেন অথবা ক্রেতা যদি জোর করে বিক্রেতার সন্তুষ্টি ছাড়াই তার জিনিসটি নিয়ে নেন, তাহলে তা ব্যবসা হবে না; বরং জুলুম হবে। আমাদের দেশে দেখা যায়, কেউ ৪৯৫ টাকার কোনো পণ্য কিনে ৫০০ টাকার নোট দিলেন, বিক্রেতা আপনাকে ৫ টাকা ফেরত দেবেন; কিন্তু ৫ টাকা ফেরত না দিয়ে এর পরিবর্তে তাকে ৫ টাকা দামের একটি চকলেট দিয়ে দিলেন; অথচ ক্রেতার এ চকলেট নেয়ার কোনো আগ্রহই নেই। ক্রেতার আগ্রহ না থাকলেও শুধু শুধু বিক্রেতার স্বার্থেই তা ক্রেতার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। যেহেতু এখানে উভয়ের সন্তুষ্টি নেই, এ জন্য এটা পরিষ্কার জুলুম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা একে অপরের ধন-সম্পদ অবৈধ উপায়ে আত্মসাৎ করো না। পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন কর।’ (সুরা নিসা : ২৯)।

হালাল ব্যবসার প্রকারভেদ

পাঁচটি পদ্ধতিতে ব্যবসা করা ইসলামি শরিয়তে অনুমোদিত। তা হলো- ১. বায়উল মুরাবাহ : লাভ-লসের ভিত্তিতে নগদ মূল্যে ক্রয়-বিক্রয়ের একক ব্যবসা। ২. বায়উল মুআজ্জাল : ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোনো সময়ে একসঙ্গে অথবা কিস্তিতে উভয় পক্ষের সম্মতিতে মূল্য পরিশোধের শর্তে ক্রয়-বিক্রয়। ৩. বায়উস সালাম : ভবিষ্যতে সরবরাহের শর্তে এবং তাৎক্ষণিক উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণ শরিয়ত অনুমোদিত পণ্যসামগ্রীর অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) যখন মদিনায় আসেন, তখন লোকেরা ফল-ফসলের জন্য অগ্রিম মূল্য প্রদান করত। তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অগ্রিম মূল্য প্রদান করবে, সে যেন তা সুনির্দিষ্ট মাপের পাত্র দিয়ে সুনির্দিষ্ট ওজনে প্রদান করে।’ (বোখারি : ২২৩৯, মুসলিম : ১৬০৪)। ৪. বায়উল মোদারাবা : একপক্ষের মূলধন, অপরপক্ষের দৈহিক ও বুদ্ধিভিত্তিক শ্রমের সমন্বয়ে যৌথ ব্যবসা। এ পদ্ধতিতে লভ্যাংশ তাদের মাঝে চুক্তি অনুযায়ী বণ্টন করা হবে। রাসুল (সা.) খাদিজা (রা.)-এর মূলধন দিয়ে এভাবেই যৌথ ব্যবসা করেছিলেন। এ ছাড়া সাহাবিরা এ পদ্ধতিতে ব্যবসা করেছেন। ৫. বায়উল মোশারাকা : মূলধন ও লভ্যাংশের ব্যাপারে দুই বা ততোধিক অংশীদারের মধ্যকার চুক্তি অনুসারে ব্যবসা। মোশারাকা পদ্ধতিতে ব্যবসায় লাভ হলে অংশীদাররা পূর্ব নির্ধারিত অনুপাতে তা ভাগ করে নেয়; আর লোকসান হলে অংশীদাররা নিজ নিজ পুঁজির আনুপাতিক হারে তা বহন করে। (সুনানে আবি দাউদ : ৪৮৩৬)।

হালাল ব্যবসার স্বরূপ

ব্যবসা হালাল হওয়ার জন্য কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হয়; অন্যথায় তা বৈধ হবে না। যেমন- সততা, আমানতদারি ও বিশ্বস্ততা এবং মূল্য নির্ধারণ ব্যবসা হালাল হওয়ার পূর্বশর্ত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহাঅপরাধী হিসেবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, সততা ও ন্যায়ের সঙ্গে ব্যবসা করবে, তারা ছাড়া।’ (তিরমিজি : ১২১০)। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর যুগে (একবার পণ্যের) মূল্য বেড়ে গেলে সাহাবিরা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দিন।’ তিনি বললেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহই হচ্ছেন মূল্য নির্ধারণকারী; তিনি সঙ্কোচনকারী, সম্প্রসারণকারী ও রিজিকদাতা। আর আমি অবশ্যই এমন এক অবস্থায় আমার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি, যাতে তোমাদের মধ্য থেকে কেউ আমার বিরুদ্ধে রক্ত (প্রাণ) ও সম্পদ সম্পর্কে জুলুমের অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১২৬১৯)।

ব্যবসা হালাল হওয়ার শর্ত

১. বিক্রিত পণ্য অবশ্যই হালাল বস্তু হতে হবে। ২. ওজনে কম দেয়া বা পরিমাণে কম দেয়া যাবে না এবং কাউকে প্রতারিত করা যাবে না। ৩. বিক্রিত পণ্য ফেরত নেয়ার নিয়ম ও ব্যবস্থা রাখা জরুরি। ৪. সুদণ্ডঘুষে জড়িত এমন লেনদেন থেকে দূরে থাকতে হবে। ৫. পণ্যে বাস্তবে কোনো ত্রুটি বা ভেজাল থাকলে তা বিক্রি করা যাবে না এবং অবশ্যই পণ্যের ত্রুটি থাকলে তা গ্রাহককে আগে জানিয়ে দিতে হবে। ৬. সিন্ডিকেট বা কৃত্রিম সংকট তৈরি করা যাবে না। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু শর্ত রয়েছে, যা ব্যবসার ধরন অনুযায়ী পরিবর্তনশীল। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওপরোল্লিখিত শর্তগুলো প্রযোজ্য।

হারাম পণ্যের ব্যবসাও হারাম

আল্লাহতায়ালা মদ, মৃত প্রাণী, রক্ত, প্রতিমা এবং শূকরের গোশত ইত্যাদি হারাম করেছেন। তিনি বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কাজ বৈ কিছু নয়। অতএব, এগুলো থেকে বিরত থাক; যাতে তোমরা সফল হও।’ (সুরা মায়িদা : ৯০)। আল্লাহতায়ালা যেসব জিনিস হারাম করেছেন, সেসব জিনিসের ব্যবসাও হারাম করেছেন। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি রাসুল (সা.)-কে মক্কা বিজয়ের বছর এবং মক্কা থাকাবস্থায় বলতে শুনেছেন, তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর রাসুল মদ, মৃত দেহ, শূকর ও প্রতিমা বেচাকেনা হারাম করেছেন।’ তখন বলা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি কি মনে করেন যে, লোকেরা মৃত পশুর চর্বি দ্বারা নৌকায় প্রলেপ দেয়, তা দিয়ে চামড়ায় বার্নিশ করে এবং লোকেরা তা চকচকে করার কাজে ব্যবহার করে?’ তখন তিনি বললেন, ‘না, তা হারাম।’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করে দেন; কারণ, মহান আল্লাহ তাদের জন্য চর্বি হারাম করেছেন, অথচ তারা একে গলিয়ে নেয় এবং তা বিক্রি করে ও তার মূল্য ভক্ষণ করে।’ (বোখারি : ২২৩৬)।

ব্যবসায় ভেজালের মিশ্রণ

পণ্যসামগ্রীতে যে কোনো ধরনের ভেজাল মেশানো অন্যায়। এটা দেশীয়, সামাজিক এবং ইসলামি শরিয়তেও মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য।

লেনদেনে বস্তুর দোষত্রুটি গোপন করা, ওজনে কম দেয়া, অসত্য তথ্য দেয়া, ধোঁকা দেয়া, নিম্নমানের পণ্য মিশিয়ে দেয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা ইত্যাদিও ভেজালের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আহলে কিতাবরা! কেন তোমরা জেনে-শুনে সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে সংমিশ্রিত করছ এবং সত্যকে গোপন করছ?’ (সুরা আলে ইমরান : ৭১)।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) বাজারে খাদ্যস্তুপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। খাদ্যস্তুপের ভেতরে হাত দিয়ে দেখলেন, ভেতরের খাদ্যগুলো ভেজা। বিক্রেতার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, ‘এমনটি কেন করা হলো?’ বিক্রেতা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! বৃষ্টিতে এগুলো ভিজে গেছে।’ তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাহলে তুমি খাদ্যগুলো ওপরে রাখনি কেন? যাতে মানুষ দেখতে পেত।’ এরপর রাসুল (সা.) বললেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম : ১০২)।

ওজনে কম দেয়া

ওজনে কম দেয়া এবং ঠকানোর মাধ্যমে একজন ক্রেতার হক নষ্ট করা হয়, যা তার অধিকার। ক্রয়কৃত প্রতিটি দানা ক্রেতার সম্পদ। একটি দানার মাধ্যমেও প্রতারণা করা হলে তা অবশ্যই তার সম্পদ নষ্ট করা হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেও না। তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা।’ (সুরা নিসা : ২৯)।

অন্য আয়াতে বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের ন্যায়পন্থা, অনুগ্রহ ও নিকটাত্মীয়দের হক প্রদানের নির্দেশ দেন এবং অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে নিষেধ করেন।’ (সুরা নাহল : ৯০)।

পণ্য মজুদ করে রাখা

অধিক মুনাফার আশায় পণ্য মজুদ করে রাখা অথবা তা বাজার থেকে তুলে নিয়ে দাম বাড়ানো ইসলামে অবৈধ। কোনো সংকট বা দুর্ভিক্ষের সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পরে অতিরিক্ত মুনাফায় সেই পণ্য বিক্রি করাকে মজুদদারি বলে। এ ধরনের কাজে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অনেক মানুষ দুর্ভোগে পড়ে।

তাদের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। তা ছাড়া এটা সামাজিক অপরাধও। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, আল্লাহতায়ালা তার ওপর দরিদ্রতা চাপিয়ে দেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫৫)। সাঈদ ইবনে মুসাইয়িব (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘গোনাহগার ছাড়া কেউ পণ্য মজুদ করে রাখে না।’ (তিরমিজি : ১২৮৫)। ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত আরেক হাদিসে রয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাবার (দাম বৃদ্ধির আশায়) মজুদ করে রাখে, আল্লাহ তাকে দুরারোগ্য ও দারিদ্রতা দিয়ে শাস্তি দেবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৫৫)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত