ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সৎ ব্যবসায়ীর মহাপুরস্কার

মিনহাজুল আরিফীন
সৎ ব্যবসায়ীর মহাপুরস্কার

আল্লাহতায়ালা মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন?্য। ইবাদত কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো হালাল রিজিক। আর রিজিক অর্জনের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। তাইতো আমরা দেখি, প্রত্যেক নবীই হালাল পন্থায় কোনো না কোনো ব্যবসা করেছেন। ইসলাম যেহেতু একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, তাই ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ সব বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। ব?্যবসা-বাণিজ?্য পরিচালনার জন?্যও রয়েছে ইসলামের সুনির্দিষ্ট কিছু গাইডলাইন। যারা ইসলামের বিধান অনুযায়ী চলবে, তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের জন?্য দেয়া হয়েছে সুমহান সম্মান ও অবারিত কল্যাণের নিশ্চয়তা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। শুধু তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয়, তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা তোমাদের প্রতি দয়ালু।’ (সুরা নিসা : ২৯)।

হালাল ব্যবসা নবীদের পেশা

কোরআন ও হাদিসে ব্যবসার ব্যাপারে এত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যেন ব্যবসা করা অন্য যে কোনো পেশার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমরা ব্যবসার মাঝে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের একটি শিক্ষা খুঁজে পাই। এ জন্যই আল্লাহতায়ালা ব্যবসার পেশাকে অন্যান্য পেশার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। শুধু শর্ত একটি, তা হলো- শরিয়ত ও সুন্নত মোতাবেক হতে হবে। ব্যবসায় মগ্ন হয়ে কিছুতেই আল্লাহ থেকে গাফেল হওয়া যাবে না। রিজিক অনুসন্ধানের জন্য হুকুম করেছেন মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.)। হালাল ব?্যবসার এত গুরুত্ব এবং ফজিলতের কারণেই প্রত্যেক নবীই কোনো না কোনো পন্থায় হালাল ব্যবসা করেছেন। আদম (আ.) কৃষিকাজ করতেন। ইদরিস (আ.) সেলাইকর্ম করতেন। দাউদ (আ.) লোহার বর্ম বানাতেন। আমাদের নবীজি (সা.)-ও নিজে ব্যবসা করেছেন। নবুওয়ত লাভের আগে নবীজি (সা.) মোদারাবার ভিত্তিতে ব্যবসা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা.)-এর সঙ্গে শেয়ারে ব্যবসাও করেছেন।

কোরআনে ব্যবসায় উৎসাহ প্রদান

হালাল-হারাম ইসলামের এক অনন্য অলঙ্ঘনীয় বিষয়। জীবিকা উপার্জনের ইসলাম অনুমোদিত মাধ্যমগুলোর অন্যতম হলো ব্যবসা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ ব?্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)। তিনি আরও বলেন, ‘নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে। আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে; যেন সফলকাম হও।’ (সুরা জুমা : ১০)। কোরআনের অন?্যত্র বলা হয়েছে, ‘তিনিই তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন। অতএব, তোমরা দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তাঁর দেয়া জীবনোপকরণ হতে আহার্য গ্রহণ কর। পুনরুত্থান তো তাঁরই কাছে।’ (সুরা মুলক : ১৫)।

সৎ ব্যবসা দাওয়াতি কাজের সহায়ক

ভারতবর্ষে ইসলাম এসেছে আরব বণিকদের মাধ্যমে। বর্তমানে এ উপমহাদেশে বিপুলসংখ্যক মুসলমান। এ ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারকারীরা মুজাহিদ ছিলেন না যে, জিহাদের মাধ্যমে তারা এখানে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছেন। ওই সময় কোনো তাবলিগ জামাতও ছিল না যে, ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন তারা। বরং এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারকারী ছিলেন এমন কিছুসংখ্যক সাহাবি ও তাবেঈ, যারা ব্যবসায়ী বেশে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। তারা নিজেদের ব্যবসার মাধ্যমে এমন সুমহান আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের অন্তরে তাদের প্রতি সীমাহীন অনুরাগ জন্ম নেয়। ইসলামের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে। ইসলামকে তারা একটি শ্রেষ্ঠ দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে নেয়।

ব্যবসায় দ্বীন প্রচারের সুবর্ণ সুযোগ

আল্লাহতায়ালা তাঁর অনুগ্রহে মুসলিমণ্ডঅমুসলিম নির্বিশেষে একটি দেশ ও সমাজে বসবাস করার সুযোগ দিয়েছেন। তাই মানুষের সামনে নিজেদের কর্মের সর্বোত্তম নমুনা পেশ করলে, তাদের সঙ্গে আন্তরিক ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করলে, তাদের সঙ্গে সৎ এবং ন্যায়সঙ্গত লেনদেন করলে এ ব্যবসা শুধু ব্যবসাই থাকবে না; বরং একটি সওয়াবপূর্ণ দাওয়াতে পরিণত হবে। এর একেকটি মুহূর্ত আল্লাহর দরবারে সওয়াব ও প্রতিদান লাভের কারণ হবে। প্রতিনিয়ত অমুসলিমদের সঙ্গে আমাদের ওঠাবসা হয়। কিন্তু আমাদের এ বিষয়টি মনে থাকে না যে, আল্লাহতায়ালা একজন মুসলমান হিসেবে আমাকে দ্বীনের একজন দাঈ (ধর্মপ্রচারক) বানিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। সমগ্র মানবতার কল্যাণে তোমাদের আবির্ভাব।’ (সুরা আলে ইমরান : ১১০)। তাই নিজেদের কর্ম ও আচরণের মাধ্যমে অমুসলিমদের কাছে টানতে হবে। তাদের সহমর্মী হওয়া চাই। তাদের দুঃখণ্ডদুর্দশায় শরিক হতে হবে। এভাবে তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে।

সততার পরকালীন পুরস্কার

সততা অনেক বড় গুণ। সততার পুরস্কার দেবেন মহান আল্লাহ। সুরা আহজাবের ৩৫ নম্বর আয়াতে সততা এবং স্বচ্ছতাসহ অন্য গুণাবলিতে গুণান্বিত নারী-পুরুষের প্রতিদান ও পুরস্কারের আলোচনা করে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাদের জন্য রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান। সততাকে হাদিসে অন্তরের প্রশান্তি, মুক্তি লাভ, জান্নাত অর্জন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং ধন-সম্পদে বরকতের মাধ্যম বলা হয়েছে। কেয়ামতের দিন সততার কারণে সত্যবাদীদের জান্নাত মিলবে। পরকালে তো সততার পুরস্কার সুনিশ্চিত। পার্থিব জীবনেও মিলবে বরকত ও সমৃদ্ধি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ কর এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিও না। আর ভূপৃষ্ঠে সংস্কার সাধন করার পর তাতে অনর্থ সৃষ্টি করো না। এ হলো তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।’ (সুরা আরাফ : ৮৫)। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যদি ক্রেতা-বিক্রেতা সত্য বলে এবং ভালো-মন্দ প্রকাশ করে দেয়, তাহলে তাদের লেনদেন বরকতময় হবে। আর যদি উভয়ে মিথ্যা বলে এবং দোষত্রুটি গোপন করে, তাহলে এ লেনদেন থেকে বরকত তুলে নেয়া হবে।’ (মুসলিম : ১৫৩২)।

রিজিকে বরকত লাভের মাধ্যম

জীবনের তাগিদে কাজ, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা ও উপার্জন প্রয়োজন। তবে রোজগারের জন্য আল্লাহতায়ালার স্মরণ অতীব জরুরি। আল্লাহর স্মরণ থাকলে কাজ-কর্ম ও আয়-রোজগারের যে চেষ্টা চালানো হয়, তা সবকিছুই ইবাদতে পরিণত হয়। যেসব ব্যবসায়ী ইসলামি বিধিবিধান পালন করে থাকে, আল্লাহ তাদের জীবিকা বৃদ্ধি করে দেন। অধিক সফলতা প্রদান করে থাকেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেসব লোক, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে, নামাজ কায়েম ও জাকাত প্রদান হতে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। যাতে তারা যে কর্ম করে, তার জন্য আল্লাহ তাদের উত্তম পুরস্কার দেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদের অধিক দেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবিকা দান করেন।’ (সুরা নুর : ৩৭)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ক্রেতা-বিক্রেতার জন্য পরস্পর পৃথক হওয়ার আগপর্যন্ত ইচ্ছাধিকার থাকবে। উভয়ে যদি সত্য কথা বলে এবং দোষত্রুটি বলে দেয়, তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত হবে। আর যদি তারা ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং দোষত্রুটি গোপন রাখে, তবে তাতে বরকত থাকবে না।’ (মুসলিম : ১৫৩২)।

আল্লাহ হালাল ব্যবসার অংশীদার

আল্লাহতায়ালা নিজেকে ওইসব ব্যবসায়ীদের অংশীদার হিসেবে সুসংবাদ দিয়েছেন, যারা ব্যবসা পরিচালনায় বিশ্বাসঘাতকতা করে না, কাউকে ঠকায় না, ধোঁকাবাজি করে না; বরং হালাল পন্থায় ব?্যবসা করে। এ বিষয়ে ইমাম আবু দাউদ (রহ.)-এর বর্ণনায় হাদিসে কুদসিতে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন, ‘যতক্ষণ দু’জন অংশীদার ব্যবসায় একে অপরের সঙ্গে খেয়ানত (বিশ্বাসঘাতকতা) না করে, ততক্ষণ আমি তাদের তৃতীয় শরিক হিসেবে (তাদের সহযোগিতা করতে) থাকি। অতঃপর যখন খেয়ানত করে, তখন আমি তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে যাই (তারা আমার সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়)।’

নবীদের সঙ্গে সৎ ব্যবসায়ীর হাশর

ব্যবসায় মত্ত হয়ে নিজের ধর্মীয় কর্তব্যের কথা ভুলে যাওয়া আদৌ উচিত নয়। বরং মুসলমানের কর্তব্য হলো, আল্লাহকে স্মরণ রাখা ও হালাল পদ্ধতিতে আয়-উপার্জনের চেষ্টা করা। নবীজি (সা.) ব্যবসায়ীদের মর্যাদা তুলে ধরে বলেন, ‘কেয়ামতের দিন সৎ ব্যবসায়ীরা সিদ্দিক ও শহিদের সঙ্গে উঠবে।’ (তিরমিজি : ১২০৯)। ব্যবসা যখন আমানতদারি, বিশ্বস্ততা ও সততার সঙ্গে করা হবে, তখন এটি নেক আমলে পরিণত হবে। বিশ্বনবী (সা.)-ও ব্যবসা করেছেন; বরং তিনি ব্যাপক পরিসরে ব্যবসা করেছেন। যাকে আজকাল ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড বলা হয়। এ অঙ্গনে তিনি আমাদের জন্য অনেক আদর্শ রেখে গেছেন। যদি ঈমানদারি, আমানত ও সততা আমাদের মধ্যে এসে যায়, তাহলে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডও নেক আমলে পরিণত হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত