ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঋণ পরিশোধে করণীয়

জীবন চলার পথে আমরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হই। সেসব সমস্যার মধ্যে কিছু সমস্যা এমন রয়েছে, যেগুলো টাকা-পয়সা দিয়ে সমাধান করা যায়। কিন্তু অনেক সময় প্রয়োজন পরিমাণ টাকা-পয়সা সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে থাকে না। ফলে এ সময় তাকে ঋণ বা করজের দারস্থ হতে হয়। প্রয়োজন পরিমাণ টাকা-পয়সা আছে, এমন ব্যক্তির শরণাপন্ন হতে হয়। সমাজবদ্ধ জীবনে এ বিষয়টি স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সমাজে এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা টাকা-পয়সা ঋণ বা করজ করার পর তা যথাসময়ে আদায় করতে চায় না কিংবা নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করতে গড়িমসি করে। ফলে আজকের প্রেক্ষাপটে মানুষ একজন আরেকজনকে ঋণ বা ধার দিতে কুণ্ঠাবোধ করে। এ দুঃখজনক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ঋণ পরিশোধে করণীয় সম্পর্কে অবগত হওয়া জরুরি। লিখেছেন- আবদুল কাইয়ুম শেখ
ঋণ পরিশোধে করণীয়

উৎকৃষ্ট বস্তু দিয়ে ঋণ পরিশোধ

কারও কাছ থেকে কোনো বস্তু ঋণ বা করজ নেয়ার পর নিয়ম হলো, যে মানের বস্তু করজ নেয়া হয়েছে, ঠিক সে মানের বস্তু ফিরিয়ে দেয়া। এর চেয়ে নিম্নমানের বস্তু ফিরিয়ে দেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, এতে ঋণদাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবশ্য কোনো ব্যক্তি যদি পাওনাদারকে তার প্রদানকৃত বস্তুর চেয়ে উৎকৃষ্ট মানের বস্তু ফিরিয়ে দেয়, তাহলে তা আরও উত্তম। যেসব লোক পাওনাদারকে গৃহীত বস্তুর চেয়ে উৎকৃষ্ট মানের বস্তু ফিরিয়ে দেয়, তাদের মহানবী (সা.) শ্রেষ্ঠ বলেন। আবু রাফি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এক ব্যক্তির কাছ থেকে একটি উটের বাচ্চা ধার নেন। এরপর তার কাছে সদকার উট আসে। তিনি আবু রাফি (রা.)-কে সে ব্যক্তির উটের ধার শোধ করার আদেশ দেন। আবু রাফি (রা.) রাসুল (সা.)-এর কাছে ফিরে এসে জানালেন, ‘সদকার উটের মধ্যে আমি সেরূপ দেখছি না, তার চেয়ে উৎকৃষ্ট উট আছে।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘ওটাই তাকে দাও। সে ব্যক্তিই উত্তম, যে ধার পরিশোধে উত্তম।’ (মুসলিম : ৪০০০)।

পাওনাদারের সঙ্গে সদ্ব্যবহার

ঋণ বা করজ দেয়ার পর পাওনাদারের এ অধিকার রয়েছে যে, নির্ধারিত সময়ে দেনাদারের কাছে পাওনা পরিশোধ করার জন্য তাগাদা দেবে। পাওনাদার তাগাদা দেয়ার জন্য এলে দেনাদারের করণীয় হলো, তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা, নম্র ভাষায় কথা বলা এবং উচ্চবাচ্য করা হতে বিরত থাকা। বিশ্বনবী (সা.) তার সহচরবৃন্দকে পাওনাদারের সঙ্গে নম্র আচরণ ও সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, এক বেদুইন মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে তার ঋণ শোধের জন্য তাকে কঠোর ভাষায় তাগাদা দিল। এমনকি সে তাকে বলল, ‘আমার ঋণ পরিশোধ না করলে আমি আপনাকে নাজেহাল করব।’ সাহাবিরা তার ওপর চড়াও হতে উদ্যত হয়ে বললেন, ‘তোমার অনিষ্ট হোক! তুমি কি জানো, কার সঙ্গে কথা বলছ?’ সে বলল, ‘আমি আমার পাওনা দাবি করছি।’ তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘তোমরা পাওনাদারের পক্ষ নিলে না কেন?’ অতঃপর তিনি কায়েসের কন্যা খাওলা (রা.)-এর কাছে লোক পাঠিয়ে তাকে বললেন, ‘তোমার কাছে খেজুর থাকলে আমাকে ধার দাও। আমার খেজুর এলে তোমার ধার পরিশোধ করব।’ খাওলা (রা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার পিতা আপনার জন্য উৎসর্গিত হোক, ইয়া রাসুলাল্লাহ!’ বর্ণনাকারী বলেন, তিনি তাকে ধার দিলেন। তিনি বেদুইনের পাওনা পরিশোধ করলেন এবং তাকে আহার করালেন। তিনি বলেন, ‘উত্তম লোকেরা এমনই হয়। যে জাতির দুর্বল লোকেরা জোর-জবরদস্তি ছাড়া তাদের পাওনা আদায় করতে পারে না, সে জাতি কখনও পবিত্র হতে পারে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪২৬)।

করজদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

বিপদের সময় যদি কেউ কাউকে উপকার করে, তাহলে উপকৃত ব্যক্তির জন্য সমীচীন হলো, উপকারী ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আর এ কথা সত্য যে, প্রয়োজনগ্রস্ত বা অভাবগ্রস্ত না হলে কেউ কারও কাছে হাত পাতে না ও ধার চায় না। অতএব, যদি কোনো ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন বা অভাবের সময় অন্য কারও কাছ থেকে করজ বা ঋণ পায়, তাহলে তার জন্য সমীচীন হলো, উপকারী করজদাতার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। মহানবী (সা.) পাওনাদারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেনাদারকে উৎসাহিত করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবিয়া (রা.) তার পিতার সূত্রে তার দাদা হতে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) আমার কাছ থেকে ৪০ হাজার দিরহাম করজ নিয়েছিলেন। এরপর তার কাছে মাল এলে তিনি তা আদায় করে বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমার ঘরে এবং মালে বরকত দান করুন। করজের বিনিময় হলো, লোক করজদাতার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে এবং তা আদায় করবে।’ (সুনানে নাসায়ি : ৪৬৮৩)।

দ্রুত ঋণ পরিশোধ

জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কার কখন মৃত্যু এসে যায়, বলা যায় না। তাই কখনও ঋণী বা করজদার হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি ঋণ বা করজ আদায়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত। ঋণী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা অত্যন্ত ভয়ংকর। মহানবী (সা.)-এর যুগে এক সাহাবি ঋণী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে বিশ্বনবী (সা.) ঋণের দায় থাকাবস্থায় তার জানাজা পড়াতে অস্বীকার করেন। এরপর জনৈক সাহাবি তার ঋণের দায়ভার নিজের জিম্মায় গ্রহণ করলে তিনি জানাজার নামাজ পড়ান। জাবের (রা.) বলেন, আমাদের কোনো একজন সাহাবি ইন্তেকাল করায় আমরা তার গোসল দিলাম, খুশবু লাগালাম, কাফন পরালাম। তারপর তার লাশ নবীজি (সা.)-এর কাছে হাজির করলাম। আমরা বললাম, ‘তার জানাজা পড়ান।’ তিনি দু-এক পা এগিয়ে এসে বললেন, ‘তার কি কোনো ঋণ রয়েছে?’ আমরা বললাম, ‘দুই দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ঋণ আছে।’ এ কথা শুনে মহানবী (সা.) ফিরে গেলেন। এরপর আবু কাতাদা (রা.) দিনার দুটির ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব নিলেন। তারপর আমরা নবীজি (সা.)-এর কাছে এলাম। তিনি বললেন, ‘তাহলে ঋণদাতার হক এবারে সাব্যস্ত হলো এবং মৃতব্যক্তি ঋণ থেকে মুক্ত হলো।’ তারপর নবীজি (সা.) মৃত সাহাবির জানাজার সালাত আদায় করলেন। (বুলুগুল মারাম : ৮৭৭)।

শোধ করার নিয়তে করজ গ্রহণ

কিছু মানুষ এমন রয়েছে, যারা করজ গ্রহণ করা বা ঋণ নেয়ার পর তা আদায় করার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। টাকা হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে আদায় করে দেয়। অপরদিকে কিছু মানুষ এমনও রয়েছে, যারা ধার নেয়া বা ঋণগ্রহণ করার পর আলসেমি করে ও দীর্ঘসূত্রতা অবলম্বন করে। বাস্তবিকপক্ষে এমন ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের জন্য ঋণ পরিশোধ করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। পক্ষান্তরে যেসব লোক তাড়াতাড়ি করজ আদায় করা বা ঋণ পরিশোধ করার তৎপরতায় থাকে, আল্লাহতায়ালা তাদের জন্য ঋণ পরিশোধ করার ব্যবস্থা করে দেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের মাল পরিশোধ করার উদ্দেশে করজ নেয়, আল্লাহতায়ালা তা আদায়ের ব্যবস্থা করে দেন। আর যে তা বিনষ্ট করার নিয়তে নেয়, আল্লাহতায়ালা তাকে ধ্বংস করেন।’ (বোখারি : ২৩৮৭)। যে ব্যক্তি আদায় করার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করে, আল্লাহতায়ালার সাহায্য তার সঙ্গে থাকে। আবদুল্লাহ বিন জাফর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত আল্লাহ তার সঙ্গে থাকেন, যদি না সে আল্লাহর অপছন্দনীয় উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪০৯)।

টালবাহানা শাস্তিযোগ্য অপরাধ

কোনো ব্যক্তি যদি অভাব-অনটনের কারণে পাওনা আদায়ে গড়িমসি ও টালবাহানা করে, তাহলে তা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু সংগতিসম্পন্ন ও সচ্ছল ব্যক্তি পাওনাদারের পাওনা আদায়ে গড়িমসি ও টালবাহানা করলে কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বিশ্বনবী (সা.) সচ্ছল টালবাহানাকারীর মান-সম্মানে হস্তক্ষেপ করা এবং তাকে শাস্তি দেয়ার যোগ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমর ইবনুশ শারিদ (রহ.) তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সচ্ছল ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ না করলে তার মান-সম্মানের ওপর হস্তক্ষেপ করা যায় এবং তাকে শাস্তি দেয়া যায়।’ ইবনুল মোবারক (রহ.) বলেন, ‘এর অর্থ হলো, তার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করা বৈধ এবং তাকে আটক করা যাবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৬২৮)।

গড়িমসি করা জুলুম

কতক ব্যক্তি এমন রয়েছে, যারা ঋণ বা করজ নেয়ার পর তা আদায়ে গড়িমসি ও টালবাহানা করতে থাকে। এ গড়িমসি ও টালবাহানা যদি অভাবের কারণে হয়, তাহলে তা মেনে নেয়া যায়। কিন্তু সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কতক লোকের অভ্যাস হলো, অকারণে পাওনাদারকে বারবার ফিরিয়ে দেয়া এবং টালবাহানা করে বেড়ানো। উপকারী পাওনাদারকে এভাবে কষ্ট দেয়া তার ওপর জুলুম করার শামিল। এমনটি করতে হাদিসে নিষেধ করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সক্ষম ব্যক্তির ঋণ আদায়ে গড়িমসি করা অত্যাচারের শামিল। তোমাদের কারও প্রতি ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব দিলে সে যেন তা গ্রহণ করে।’ (মুসলিম : ৩৮৯৪)।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত