ব্যবসা-বাণিজ্য জীবিকা উপার্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম। ব্যবসার মাধ্যমেই মূলত একজনের পণ্যসামগ্রী অন্যের কাছে পৌঁছে এবং মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ হয়। সমাজের একটি বড় অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। ইসলামের নির্দেশনানুযায়ী সততা ও আমানতদারির সঙ্গে মানুষের কল্যাণকামী হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারলে সন্দেহাতীতভাবে ব্যবসাও ইবাদতে গণ?্য। ব্যবসায়ীদের প্রতি ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে, তারা যেন তাদের ব্যবসায় আল্লাহকে ভয় করে; পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে না দেয়; সব সময় যেন বৈধভাবে মুনাফা গ্রহণ করে। তবেই ব্যবসা হবে হালাল বা বৈধ। পক্ষান্তরে মানুষকে কষ্ট দিয়ে, ধোঁকা-প্রতারণা ও মিথ??্যার আশ্রয় নিয়ে এবং পণ্য মজুত করে অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে দেয়ার নাম ব্যবসা নয়; বরং এটি প্রকাশ্য জুলুম। ইসলামে এ ব?্যাপারে রয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি।
ধোঁকাবাজ নবীর উম্মত নয়
আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধোঁকা-প্রতারণা ও ভেজালের ছড়াছড়ি। ধোঁকা-প্রতারণার জাল বিস্তার করছে সর্বত্র। কে কাকে ঠকাবে, সে চিন্তায় অস্থির প্রায় সবাই। কিন্তু ইসলামে ধোঁকা ও প্রতারণা জঘন্য অপরাধ। কোনো মুসলমান ধোঁকা দিতে পারে না। কারণ, ধোঁকা মোনাফেকের স্বভাব। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ধোঁকা ও প্রতারণাকারীর জন্য কঠিন শাস্তির কথা বলেছেন। এ ধরনের অপকর্ম ইসলামে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত। মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশ্রন ঘটিয়ে ধোঁকা দেয়া ইত্যাদি সম্পূর্ণ হারাম। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, একদিন রাসুল (সা.) বাজারে গিয়ে একজন খাদ্য বিক্রেতার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দেখলেন, ভেতরের খাদ্যগুলো ভেজা বা নিম্নমানের। এ অবস্থা দেখে রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে খাবারের পণ্যের মালিক! এটা কী?’ লোকটি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টি পড়েছিল।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি সেটাকে খাবারের ওপর রাখলে না কেন; যাতে লোকেরা দেখতে পেত? যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম : ১০২)। নবীজি (সা.) ধোঁকা ও প্রতারণাকারী সম্পর্কে কঠোর বাক্য উচ্চারণ করেছেন। তাই প্রত্যেক মোমিনের এ মর্মে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া দরকার যে, ধোঁকা দেব না, ধোঁকায় পড়বও না।
মিথ্যার আশ্রয় জঘন্যতম অপরাধ
মিথ?্যা রিজিক ও বরকতে ঘাটতি সৃষ্টি করে। মিথ্যায় সাময়িক সুবিধা ও লাভজনক মনে হলেও এর অভ্যন্তরীণ ক্ষতি অনেক বেশি। ব্যবসায়ীরা সাধারণত ব্যবসায় লাভবান হওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এতে বাহ্যত পণ্যের কাটতি বাড়লেও ব্যাবসায়িক মুনাফার বরকত কমে যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা বেচাকেনায় মিথ্যা কসম করা থেকে বিরত থেক। কেননা, এর কারণে (সাময়িক) পণ্য বেশি বিক্রি হলেও বরকত কমে যায়।’ (মুসলিম : ১৫৬০)। মিথ্যা অবশ্যই একটি নিন্দনীয় ও বড় ধরনের অপরাধ। ব্যবসার সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ আরও বেশি মারাত্মক ও ক্ষতিকর। কোনো মুসলমান সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ করতে পারে না। সত্যকে গোপন করতে পারে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন করো না।’ (সুরা বাকারা : ৪২)। মিথ্যাবাদীর মর্মান্তিক শাস্তি সম্পর্কে সামুরা বিন জুনদুব (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) একদিন (ফজর নামাজ শেষে) আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের কেউ আজ কোনো স্বপ্ন দেখেছ কি?’ আমরা বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, কিন্তু আমি দেখেছি যে, দুজন ব্যক্তি আমার কাছে এলো। অতঃপর তারা আমাকে পবিত্র ভূমির (শাম বা বাইতুল মুকাদ্দাসের) দিকে নিয়ে গেল। হঠাৎ দেখতে পেলাম, এক ব্যক্তি বসে আছে, আরেকজন লোহার আঁকড়া হাতে দাঁড়িয়ে। দাঁড়ানো ব্যক্তি বসে থাকা ব্যক্তির (এক পাশের) চোয়ালটা এমনভাবে আঁকড়াবিদ্ধ করছিল যে, তা (চোয়াল বিদীর্ণ করে) মাথার পেছনের দিক পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল। এরপর অপর চোয়ালটিও আগের মতো বিদীর্ণ করল। ততক্ষণে প্রথম চোয়ালটা জোড়া লেগে যাচ্ছিল। আঁকড়াধারী ব্যক্তি আবার সেরূপ করছিল। তারপর তারা আমাকে ব্যাখ্যা বলে দিল যে, ‘আপনি যে ব্যক্তির চোয়াল বিদীর্ণ করার দৃশ্য দেখলেন, সে মিথ্যাবাদী; মিথ্যা কথা বলে বেড়াত। তার বিবৃত মিথ্যা বর্ণনা ক্রমাগত বর্ণিত হয়ে দূর-দূরান্তে পৌঁছে যেত। ফলে তার সঙ্গে কেয়ামত পর্যন্ত (কবরে) এরূপ আচরণ করা হবে।’ (বোখারি : ১৩৮৬)।
ওজনে ঠকানো দুর্ভিক্ষ ও ধ্বংসের কারণ
ওজনে কম দেয়া যে কত বড় গর্হিত কাজ, আল্লাহর কত অপছন্দনীয় এবং এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ, তা অসাধু ব্যবসায়ীরা চিন্তা করে দেখে না। কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘চরম দুর্ভোগ তাদের জন্য (বা ওয়াইল নামক দোজখে যেতে হবে তাদের), যারা মাপে কম দেয়। (আল্লাহতায়ালা আরও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলছেন) যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণমাত্রায় নেয়। (নিজের হিসেবটা ঠিকমতো বুঝে নেয়)। যখন লোকদের মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়। (ঠকায়, ব্যবসায় প্রতারণা ও ঠকবাজির এ কাজটি কাফেরদের চরিত্রের মতো। আল্লাহতায়ালা জিজ্ঞেস করেন) তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা (মরণের পর) আবার উত্থিত হবে? যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে। এটা কিছুতেই উচিত নয়। নিশ্চয় পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জিনে রয়েছে।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ১-৮)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা ওজনে বা মাপে কম দেয়, তখন শাস্তিস্বরূপ তাদের খাদ্যশস্য উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে।’ (আত তারগিব ওয়াত তারহিব : ৭৮৫)।
পণ্য সিন্ডিকেট করা মস্ত বড় অপরাধ
প্রতি বছর কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট কোনো উপলক্ষ্যকে সামনে রেখে চড়া মূল?্য লাভের আশায় অধিক ব?্যবহার্য দ্রব?্যসামগ্রীর বিশাল মজুদ গড়ে তোলে। বিশেষ করে, রমজানে দেখা যায়- শসা, টমেটো, বেগুনের দাম হুড়হুড় করে বেড়ে যায়। তরমুজ, লেবু ও চিনির দামও আকাশ ছুঁই ছুঁই করে। তাই রমজান এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হাঁসফাঁস করতে হয় মধ?্যবিত্ত পরিবারের; যা নিতান্তই দুঃখজনক। কিছুদিন আগে আমাদের সমাজের একশ্রেণির মানুষ পেঁয়াজ মজুদ করে রাখল। ফলে পেঁয়াজের দাম হলো আকাশচুম্বী। তবু সর্বসাধারণের কিছুই করার ছিল না। বেশি দাম দিয়েই পেঁয়াজ কিনতে হলো। আবার শত শত লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধার করা হলো একজনের খাটের নিচ থেকে। অথচ বিশ্বনবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি গুদামজাত করল, সে বড় অপরাধ করল।’ (মুসলিম : ১৬০৫)। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে বিশেষভাবে গুরুত্ব এবং ব্যাপক উৎসাহ দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা একে অপরের ধন-সম্পদ অবৈধ উপায়ে আত্মসাৎ করো না। পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন কর।’ (সুরা নিসা : ২৯)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘উত্তম রোজগার হলো, একজন মানুষের তার নিজের হাতের কামাই এবং সব ধরনের বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের আয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭২৬৫)। বৈধ ব্যবসা হলো, যে বেচাকেনায় কোনো প্রকার ধোঁকা, খেয়ানত, মিথ্যা ও প্রতারণা থাকে না। পক্ষান্তরে যে ব্যবসায় মিথ্যা, প্রতারণা, ধোঁকা ও খেয়ানতের সংমিশ্রণ ঘটে, তাকে বৈধ ব্যবসা বলা যায় না। কেয়ামতের দিন তাদের অপরাধী লোকদের সঙ্গে পুনরুত্থান করা হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই ব্যবসায়ীদের কেয়ামতের দিন অপরাধী হিসেবে উপস্থিত করা হবে। তবে যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, সৎকর্ম করে ও সত্য কথা বলে, তাকে ছাড়া।’ (তিরমিজি : ১২১০)।
মিথ্যা শপথ করা মহাপাপ
পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথ করা যাবে না। মিথ্যা মানবতাবোধকে লোপ করে, নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়। মিথ্যাবাদীর ওপর আল্লাহর অভিশাপ। মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। কবিরা গোনাহসমূহের মধে?্য অন্যতম হলো, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা।
আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, নবীজি (সা.)-কে কবিরা গোনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, পিতামাতার অবাধ?্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।’ (বোখারি : ২৬৫৩, মুসলিম : ৮৮)। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তিন ব্যক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন হলো, যে তার ব্যবসায়িক পণ্যকে মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে।’ (মুসলিম : ১০৬)। আবু বাকরা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় গোনাহ সম্পর্কে সতর্ক করব না?’ আমরা বললাম, ‘অবশ্যই হে আল্লাহর রাসুল!’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে শরিক স্থাপন করা ও পিতামাতার নাফরমানি করা।’ এ কথা বলার সময় তিনি হেলান দিয়ে বসেছিলেন। এরপর (সোজা হয়ে) বসে বললেন, ‘সাবধান! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। সাবধান! মিথ্যা কথা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।’ অতঃপর ক্রমাগত বলেই চললেন। এমনকি আমি বললাম, ‘তিনি মনে হয়, আর থামবেন না।’ (বোখারি : ৫৯৭৬, মুসলিম : ৮৭)। এ হাদিস থেকে মিথ্যা সাক্ষ্যদান যে একটি মহাপাপ, তা তিনভাবে প্রমাণিত হয়- প্রথমত এ কাজ করলে মহাপাপী হতে হয়, যা শিরকের মতো মহাপাপের সঙ্গে সংযুক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা মূর্তিরূপ অপবিত্রতা বর্জন কর এবং মিথ্যা কথা (সাক্ষ্য) হতে দূরে থাক।’ (সুরা হজ : ৩০)। অন?্য হাদিসে মিথ?্যা সাক্ষে?্যর ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া শিরকের সমতুল্য আপরাধ।’ এ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া আল্লাহর সঙ্গে শিরক করার সমতুল্য।’ (সুনানে বাইহাকি : ৪৫২১)। এরপর তিনি কোরআনের আয়াত পড়লেন, ‘তোমরা মূর্তির অপবিত্রতা হতে দূরে থাক, মিথ্যা কথা পরিহার কর, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও। তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না।’
(সুরা হজ : ৩০-৩১)।