ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মক্কা-মদিনায় কেনাকাটা

হজের সফরে ইবাদতের পাশাপাশি জমে উঠেছে মার্কেটিং। পরিবারের একেকজনের একেক আবদার। হাজি সাহেবকে সেসব আবদারের ওপর জিম্মি হয়ে হজে যেতে হয়। নুন আনতে পানতা ফুরোয়, এমন হাজি সাহেবও অধুনা ডাঁট-ফাটের সঙ্গে তাল মেলান। মার্কেট করে বস্তার পর বস্তা পুরে বুক ফুলিয়ে হাঁটেন। স্বচ্ছল হলে তো কথাই নেই। সবমিলিয়ে হজের বাজার এখন বেশ রমরমা। মক্কা-মদিনায় হাজিদের এসব কেনাকাটা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন- মক্কা শরিফে হজ কাফেলায় অবস্থানরত দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের নিয়মিত কলাম লেখক - মিনহাজুল আরিফীন
মক্কা-মদিনায় কেনাকাটা

ভেবেছিলাম, খেজুর আর জমজমের পানি ছাড়া কিছুই নেব না। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে উঠল না। কিছু কিনি বা না কিনি, সঙ্গীদের কথায় তাল মিলিয়ে ঢুঁ মারলাম সৌদির বিখ্যাত শপিংমলগুলোতে। তেমন কিছু না কিনলেও ঘুরে দেখলাম। জানাশোনার পরিধি বেশ সমৃদ্ধ হলো। মক্কায় তুলনামূলক জিনিসপত্রের দাম বেশি। তবে নির্দিষ্ট কিছু দোকান আছে, যেগুলো প্রধান সড়ক থেকে গলি-ঘুপচির ভেতরে। সেখানে কিছুটা ছাড়মূল্য রয়েছে। মেসফালাহ সড়কের আগে, কবুতর চত্বরের পরে, পূর্বদিকে কয়েকটি গলি আছে। পাঁচতারকা হোটেল ও বাংলাদেশি রেস্তোরাঁসহ টুকিটাকি সবই সেখানে সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। এ গলির এক দোকান থেকে বড় সাইজের ডাবল পার্টের মোলায়েম জায়নামাজ নিলাম। প্রতি পিস সাড়ে আট রিয়াল; যা অন্য কোথাও পাইনি।

বেরুবার পথে বিল শোধ

পয়সাঅলাদের যেন ফুটপাত থেকে কেনাকাটা করলে জাত যায়। তাই তাদের অভিজাত শপিংমল ছাড়া শপিং-ই জমে না। তারা শপিং করতে চলে যায় হারামের পার্শ্ববর্তী বিখ্যাত আবরাজ আল বাইত বা কক টাওয়ারের নিচতলার মার্কেটপ্লেসে, কেউ চলে যায় বিন দাউদ শপিংমলে। সেখানে আপাদমস্তক সব আছে। উটের দুধও পাওয়া যায়। ক্রেতারা যে যার মতো নিজ হাতে সদাই নেয়। বেরুবার পথে বিল শোধ করতে হয়। বিন দাউদে গিয়ে খানিক বিড়ম্বনায় পড়লাম। এক সঙ্গী তার বাচ্চার জন্য খেলনা নিল। কিন্তু তা কীভাবে খেলতে হয়, শেখার প্রয়োজন হলো। একজন সেলসম্যানকেও পাওয়া গেল না। বহু অপেক্ষার পর একজন জুটল, কিন্তু খুব বেগ পেতে হলো।

খাবার কিনে বসেন পার্কে

হারামের অদূরে আজিজিয়ায় অনেকে টাকা খসিয়ে আসেন। আজিজিয়া সুপার মল কাবা শরিফ থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। সৌদি আরবের মক্কার অভিজাত এ এলাকা ‘আজিজিয়া’র বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা ভিন্ন রকমের। সারাদিন এখানকার সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধ থাকলেও বিকেলের পর থেকে জমে ওঠে। জেগে থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। এখানকার বাসিন্দারা অভিজাত পরিবারের হওয়ায় তাদের দিনের সময়টা কাটে আয়েশিভাবে। সন্ধ্যার পর পরিবার নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ান। নামিদামি রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে খেতে বসেন পার্কে। আলো ঝলমলে এ শহরে কারও নেই কর্মব্যস্ততা।

বাধ্যতামূলক ১৫ শতাংশ শুল্ক

আজিজিয়া এলাকার মার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা একাধিক লোকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, একটু মানসম্মত জিনিস কেনার জন্য মূলত তাদের এখানে আসা। দাম একটু বেশি হলেও গুণগতমান ভালো হওয়ায় এখানকার মার্কেটগুলোতে নির্দিষ্ট ক্রেতা রয়েছে। যদিও জুয়েলারি দোকানগুলোতে ২২ ক্যারেটের চেয়ে ২১ ক্যারেটের অলঙ্কারই বেশি। আর ২২ ক্যারেটের প্রতি বাংলাদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি। অনেকে কিনে থাকেন স্বর্ণের বার। এখানে স্বর্ণালঙ্কার কিনলে বাধ্যতামূলক ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। চাইলে দামাদামিও করা যায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্রেতাদের জন্য অলঙ্কার কিনতে আস্থার জায়গা হচ্ছে, জেদ্দার আল বালাদ মার্কেট।

ছোট ছোট বাঁচাও ফেরিঅলা

জেদ্দা মক্কা প্রদেশের অন্তর্গত সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। এটি বিখ্যাত বাণিজ্যিক কেন্দ্র। প্রচুর বাংলাদেশি অধ্যুষিত এ নগরীটি লোহিত সাগর তীরে অবস্থিত। কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে এখানকার রূপ, জৌলুস ও নগরীতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের জীবনযাপন। আমরা যখন জেদ্দায় পৌঁছি, তখন ঘড়িতে স্থানীয় সময় বিকেল পাঁচটা। জেদ্দার কিছু কিছু এলাকায় দেখলাম, বাংলাদেশি ভাইয়েরা সাইড ওয়াকের ওপর রকমারি পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন। কারও জুতাণ্ডস্যান্ডেল, কারও বাঁচ্চাদের খেলনা, আবার কারও পোশাক-পরি"ছদের দোকান। আবার কিছু এলাকায় দেখলাম, ছোট ছোট বাঁচাও ফেরিঅলার কাজ করছে। যে বয়সে তাদের হাতে বই-খাতা থাকার কথা, সেই বয়সে নেমে পড়েছে কাজে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এরা ইয়েমেনি। মা-বাবার সঙ্গে তারা কাজ করে।

প্রবাসীদের মানবেতর জীবন

সৌদি আরবের জেদ্দা প্রদেশে বসবাস করেন আট লাখ বাংলাদেশি। যাদের কঠোর পরিশ্রম এবং পাঠানো অর্থের কল্যাণে দেশের অর্থনীতির চাকা কিছুটা সচল থাকে। বেড়েছে মানুষের মাথাপিছু আয়। অথচ কঠোর পরিশ্রম করেও বেশিরভাগ প্রবাসী এখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বালাদ সিটিতেই দু’লাখ বাংলাদেশি বসবাস করেন। এখানকার কয়েকটি মার্কেট ঘুরে দেখা গেল, এখানে কর্মরত শতকরা ৯০ শতাংশই বাংলাদেশি।

জেদ্দায় দাম অনেক কম

আল বালাদ মার্কেটে একটি ঘড়ির দোকানে ঢুকলাম। মূল দোকানি বাংলাদেশি। বাড়ি সিলেট। খুটিনাটি আলাপ হলো তার সঙ্গে। আচার-ব্যবহারে অমায়িক। সততার পরিচয় মিলল তার কাছ থেকে। সে সুফলও পেল হাতেনাতে। কারণ, সততাই ব্যবসার মূলধন। ঘড়ির যে দাম চাইল, মোআল্লিম সাহেব যাচাই করে দেখলেন- একদম সীমিত লাভেই দাম ধরেছে। তাই তার কাছ থেকে বেশ কয়েকটি ঘড়ি নিলাম। ঘড়িগুলো মানসম্মত, কিন্তু বেশ সুলভ। যেই ঘড়িগুলো কিনলাম ৩০ থেকে ৪০ রিয়ালে, সেগুলো মক্কা-মদিনায় কম করে হলেও ৫০ থেকে ৮০ রিয়ালে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের সঙ্গী কয়েকজন স্বর্ণ কিনলেন। জানালেন, মক্কা থেকে জেদ্দায় দাম অনেক কম।

দামাদামির দ্বিধায় ঠকার শঙ্কা

হজের সফরে গিয়ে মানুষ কমবেশি অনেক কিছুই কেনাকাটা করেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, খেজুর। মক্কার তুলনায় মদিনায় খেজুরের দাম বেশ কম। এখানে অধিকাংশ পণ্যের দাম মক্কার তুলনায় কম। সে কারণে কেনাকাটা মদিনায় করাই ভালো। তবে অভিজাত মার্কেটগুলোতে সবকিছুর দামই আকাশচুম্বী। মসজিদে নববির চারপাশে অনেক শপিংমল, মার্কেট ও হকার রয়েছে। বদর গেটের বিপরীতে আছে বিন দাউদ ও তাইয়েবা শপিংমল। কেনাকাটার সময় কোনো দোকানে যদি ফিক্সড প্রাইস (একদর লেখা) থাকে, তারপরও দামাদামি করতে দ্বিধাবোধ করলে ধরা খাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ, হজের মৌসুমে ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম একটু বাড়িয়ে লেখে। তাই কিছুটা দর কষাকষি করাই শ্রেয়। তবে সুপার মার্কেটের যেসব পণ্যে বারকোড দেয়া, সেসবে দরাদরির সুযোগ নেই।

প্রসাধনীর জন্য জেদ্দা সাশ্রয়ী

মদিনায় বহু খেজুরের মার্কেট রয়েছে। সুলভ মূল্যে তা পাওয়া যায়। এর সবচেয়ে বড় কারণ, মদিনা প্রাচীনকাল থেকেই খেজুর বাগানের জন্য বিখ্যাত। তবে নিরাশার কথা হলো, লাগেজের ওজনের কথা মাথায় রেখে চাইলেও খেজুর বেশি নেয়া যায় না। আমাদের সঙ্গীদের কেউ তো নিজের নির্দিষ্ট পরিমাণ হওয়ার পর অন্যজনকে বাড়তিগুলো দিয়েছেন। বিখ্যাত কিছু খেজুরের জাত হলো- আজওয়া, আম্বার, সুক্কারি, মাজদল, কালকি, রাবিয়া ইত্যাদি। খেজুর ছাড়াও মদিনায় রয়েছে- আতর, তাসবি, টুপি, জায়নামাজ, জুব্বা, বোরকা, হিজাব, কাপড়, ঘড়ি ও কসমেটিক্স ইত্যাদি। তবে কসমেটিক্স জাতীয় জিনিসের জন্য জেদ্দাই সাশ্রয়ী।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত