কোরবানির আধুনিক মাসায়েল
আমরা কষ্টে উপার্জিত অর্থ ব্যয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করি। কিন্তু কোরবানির সঠিক নিয়মকানুন না জানার কারণে অনেকের কোরবানিই শুদ্ধ হয় না। কোরবানি সংক্রান্ত এমন কিছু আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা জানাচ্ছেন- যোবায়ের ইবনে ইউসুফ
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কোরবানির পশুর নাম রাখা
অনেকেই ভালোবেসে নিজ পোষা প্রাণীর নাম রেখে থাকেন। বিশেষ করে, কোরবানির সময় এ বিষয়টা খুব নজরে পড়ে। পশুর নাম রাখা এবং সেই পশু দিয়ে কোরবানি করা জায়েজ। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর ‘আজবা’ নামের একটি (দ্রুতগামী) উটনী ছিল। তাকে অতিক্রম করে যাওয়া যেত না। (বোখারি : ৬৫০১)।
ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া পশু
সরকার নির্ধারিত ন্যায্য ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া উচিত নয়। তবে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা পশু যদি কেউ কিনে তা দিয়ে কোরবানি করে, তাহলে তার কোরবানি হবে। কেননা, এখানে অপরাধী ট্যাক্স ফাঁকিদাতা। তাই এতে কোরবানিদাতার কোরবানিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। (বাদায়েউস সানায়ে : ৫/১২৯)।
মেশিনে পশু জবাই
আধুনিক বিশ্বের বহু দেশে মেশিনের মাধ্যমে পশু জবাই করা হয়। এ ক্ষেত্রে মেশিনের সুইচ ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে চালু করা আবশ্যক। যদি না বলে, তাহলে কোরবানি জায়েজ হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিকহ : ২/৪৫১)।
প্রবাসীদের কোরবানি
প্রবাসে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য যে কোনো দেশে কোরবানি করা জায়েজ। এ ক্ষেত্রে পশু যেই এলাকায় থাকবে, সেই এলাকায় ঈদের নামাজ হওয়ার পরে পশু জবাই করতে হবে। কোরবানিদাতার ঈদের নামাজ পড়া না পড়া ধর্তব্য নয়। (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩১৮)।
খাসিকৃত পশুর কোরবানি
অনেকে বলে থাকেন, খাসিকৃত পশু দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নেই। এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, খাসিকৃত পশু দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ?ই নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষ উত্তম?। (মাজমাউল আনহুর : ৪/২২৪)।
চুরি করে আনা পশু
যদি কোনো পশু চুরি করে আনা হয়, আর এ বিষয়টা নিশ্চিতভাবে জানা যায়, তাহলে চুরিকৃত পশু ক্রয় করে কোরবানি করলে কোরবানি শুদ্ধ হবে না। কেননা, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো চুরির বস্তু, চুরির মাল জেনেও ক্রয় করবে, সেও সেই অপরাধে এবং গোনাহে (সমানভাবে) অংশীদার হবে।’ (শুআবুল ঈমান লিল বাইহাকি : ৫১১২)।
রাতে কোরবানি করা
অনেকেই মনে করেন, রাতে কোরবানি করা যায় না। আসলে এটা ঠিক নয়। জিলহজের ১০ ও ১১ তারিখ দিবাগত রাতেও কোরবানি করা জায়েজ। তবে রাতে আলো স্বল্পতার কারণে জবাইয়ে ত্রুটি হতে পারে বিধায় রাতে জবাই করা অনুত্তম। অবশ্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকলে রাতে জবাই করতে কোনো অসুবিধা নেই। (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩২০)।
নারীর পশু জবাই
কোরবানির পশু যদি কোনো নারী জবাই করে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। কোরবানি আদায় হয়ে যাবে। তবে শর্ত হলো, আল্লাহর নামে অর্থাৎ ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করতে হবে। (ইমদাদুল ফাতাওয়া : ৩/৫৪৮)।
কসাই জবাই করলে
অনেক সময় দেখা যায়, যে ব্যক্তি পশু জবাই করছে, তার জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কে নিজ নিজ জবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে, তবে ওই কোরবানি শুদ্ধ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩৩৪)।
পশু দ্বারা উপকৃত হওয়া
কোরবানির উদ্দেশ্যে পশু ক্রয় অথবা নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে কোনো প্রকার উপকার গ্রহণ করা (যেমন- আরোহণ করা, পশম কাটা, হাল চাষ করা ইত্যাদি) জায়েজ নেই। যদি কেউ উপকার গ্রহণ করে, তাহলে যে পরিমাণ উপকার গ্রহণ করেছে, সে পরিমাণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। (মুসনাদে আহমাদ : ২/১৪৬)।
কোরবানির পশুর দুধ পান
কোরবানির উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পশুর দুধ পান করা যাবে না। যদি জবাই করার সময় আসন্ন হয়, আর দুধ দোহন না করলে পশুর কষ্ট হবে বলে মনে হয়, তবুও দুধ দোহন করবে না। প্রয়োজনে ওলানে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দেবে। যদি কেউ দুধ দোহন করেই ফেলে, তাহলে তা সদকা করে দিতে হবে। আর যদি নিজে পান করে ফেলে, তাহলে তার মূল্য সদকা করে দিতে হবে। (মুসনাদে আহমদ : ২/১৪৬)।
অংশীদারের মৃত্যু হলে
কোরবানির পশুতে একাধিক অংশীদার থাকলে, তাদের মধ্যে কেউ যদি মৃত্যুবরণ করে, তাহলে মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশরা যদি তার পক্ষ থেকে কোরবানি করার অনুমতি দেয়, তাহলে তা জায়েজ আছে। অন্যথায় ওই অংশীদারের টাকা ফেরত দিতে হবে। তার স্থলে অন্য ব্যক্তিকে অংশীদার বানানো যাবে। (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩২৬)।
কোরবানির পশু বাচ্চা দিলে
কোনো পশু কোরবানির জন্য ক্রয় বা নির্ধারণ করার পর জবাই করার আগে যদি বাচ্চা প্রসব করে, তাহলে ওই বাচ্চার গোশত খাওয়া যাবে না, সদকা করে দিতে হবে। উত্তম হচ্ছে, ওই বাচ্চা জবাই না করে জীবিত সদকা করে দেয়া। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৩)।
জীবিতের নামে কোরবানি
ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি করা যেমন বৈধ, তদ্রƒপ জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকেও কোরবানি করা জায়েজ। এ কোরবানির গোশত সবাই খেতে পারবে। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৬)।
মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি
মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কোরবানি করা জায়েজ। মৃত ব্যক্তি যদি কোরবানি করার ওসিয়ত না করে থাকে, তাহলে সেটা নফল কোরবানি হিসেবে গণ্য হবে এবং এর গোশত সবাই খেতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কোরবানির জন্য ওসিয়ত করে থাকে, তাহলে সেই কোরবানির গোশত তার ওয়ারিশরা খেতে পারবে না; বরং পুরোটাই সদকা করে দিতে হবে। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৬)।
কোরবানি করতে না পারলে
যদি কারও ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়, আর সে কোরবানির দিনগুলোতে কোনো কারণে কোরবানি করতে না পারে, তাহলে যদি সে পশু ক্রয় করে থাকে, তাহলে ওই পশুটিই জীবিত সদকা করে দিতে হবে। আর যদি পশু ক্রয় না করে থাকে, তাহলে কোরবানির উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৪)।
সময়ের পরে জবাই
কেউ যদি কোরবানির উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পশু কোরবানির সময় শেষ হওয়ার পর জবাই করে, তাহলে ওই পশুর পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায়, তাহলে যে পরিমাণ মূল্য কমে গেছে, সে পরিমাণ অর্থ সদকা করে দিতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০২)।