ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কোরবানির গোশত ও চামড়ার বিধান

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
কোরবানির গোশত ও চামড়ার বিধান

কোরবানিদাতার জন্য নিজ কোরবানির গোশত খাওয়া জায়েজ, বরং মুস্তাহাব। (সুরা হজ : ২৮, মুসলিম : ২২/১৫৯, মুসনাদে আহমদ : ৯০৭৮, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৪)। হাদিসে এসেছে, কোরবানির স্থানে গিয়ে রাসুল (সা.) নিজ হাতে ৬৩টি পশু কোরবানি করলেন। এরপর যা অবশিষ্ট থাকল, তা আলী (রা.)-কে দিলেন। তিনি তা কোরবানি করলেন। তিনি নিজে তাকে কোরবানির পশুতে শরিক করলেন। তারপর তিনি প্রত্যেক পশুর কিছু অংশ নিয়ে একটি হাঁড়িতে রান্নার নির্দেশ দিলেন। গোশত রান্না হলে তারা দুজনেই তা থেকে খেলেন এবং ঝোল পান করলেন। এরপর রাসুল (সা.) সওয়ার হয়ে বাইতুল্লাহ পৌঁছুলেন। (মুসলিম : ২৮১৫)। আয়েশা (রা.)-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘খাও, সংরক্ষণ কর এবং সদকা কর।’ (মুসলিম : ১৯৭১)।

গোশত বণ্টনের উত্তম পন্থা

কোরবানির গোশত ধনী-গরিব সবাইকে খাওয়ানো জায়েজ। উত্তম হলো, কোরবানির গোশত তিনভাগ করে একভাগ নিজের ও পরিবারের জন্য রাখা, একভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মাঝে বণ্টন করা, আরেকভাগ গরিব-মিসকিনদের মাঝে সদকা করা। সব গোশত নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য রেখে দেয়াও জায়েজ। (ফতোয়ায়ে শামি : ৬/৩২৮)। জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত; নবীজি (সা.) প্রথমে তিনদিন পর কোরবানির গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। পরে এর অনুমতি দিয়ে বললেন, ‘খাও, পাথেয় হিসেবে সঙ্গে নাও এবং সংরক্ষণ করে রাখ।’ (মুসলিম : ৩৬৪৪)। তাই কোরবানির গোশত ফ্রিজে রাখা বা প্রক্রিয়াজাত করে রাখা জায়েজ। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৪, মুসলিম : ২/১৫৯, মুয়াত্তায়ে মালেক : ১/৩১৮, ইলাউস সুনান : ১৭/২৭০)। তবে তা মানবতা ও কোরবানির তাৎপর্যের পরিপন্থি। (ইলাউস সুনান : ১৭/২৬৯)।

কোরবানির গোশত বেচাকেনা নাজায়েজ

শরিকে কোরবানি করলে ওজন করে কোরবানির গোশত বণ্টন করতে হবে, অনুমান করে বণ্টন করা বৈধ নয়। (ফতোয়ায়ে শামি : ৬/৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে : ৫/৬৭)। কোরবানির গোশত ভিন্ন ধর্মালম্বীদের দেয়া জায়েজ। তবে যদি মানত বা অসিয়তকৃত কোরবানির পশুর গোশত হয়, তাহলে তা দেয়া যাবে না। (ইলাউস সুনান : ৭/২৮৩, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/৩০০)। কোরবানির গোশত, চর্বি, ইত্যাদি বিক্রি করা জায়েজ নয়। বিক্রি করলে প্রাপ্ত মূল্য সদকা করে দিতে হবে। (ইলাউস সুনান : ১৭/২৫৯, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৫ ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৫৪, ফতোয়ায়ে আলমগিরি : ৫/৩০১)।

কোরবানির গোশতের সামাজিক বণ্টন

অনেক এলাকায় প্রত্যেক কোরবানিদাতা স্বীয় কোরবানির গোশতের এক-তৃতীয়াংশ (যা ফকির-মিসকিনদের মাঝে বণ্টন করা মুস্তাহাব) ব্যক্তিগতভাবে বণ্টন না করে সামাজিকভাবে বণ্টন করার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় সমাজে জমা দিয়ে থাকে। এটা জায়েজ আছে। কেননা, কোরবানিদাতার জন্য এক-তৃতীয়াংশ গোশত সমাজে প্রদান করা এবং সমাজপতিদের জন্য তা গ্রহণ করে গরিব-মিসকিনদের মাঝে বিতরণ করার সুব্যবস্থা করা ঈমানি দায়িত্ব। এতে সমাজের অসহায় লোকদের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানোর ভোগান্তি থেকে নিষ্কৃতি মেলা ছাড়াও সব গরিব-দুঃখীর একসঙ্গে সমহারে গোশত পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া এ নিয়ম চালু রাখায় যেহেতু সমাজকে একতাবদ্ধভাবে ধরে রাখার এক অভিনব কৌশল রয়েছে, যার ফলে অসামাজিক কার্যকলাপকারীদের বিরুদ্ধে সহজেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়; তাই এ নিয়মটি বাহ্য কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে বর্জন করা সমীচীন নয়। কিন্তু সমাজে জমা দেয়া গোশতের বণ্টন থেকে কোরবানিদাতা কোনো ভাগ গ্রহণ করতে পারবেন না। তা শুধু গরিব-মিসকিনদের প্রাপ্য। (বাদায়েউস সানায়ে : ৮/১৩৩, হেদায়া : ৩/২৯৩)। তবে এ ব্যাপারে সমাজপতিরা কোরবানিদাতাকে চাপ সৃষ্টি করে ইচ্ছেমতো (অর্ধেক বা তার বেশি) তার কোরবানির গোশত আদায় করতে পারবেন না। করলে সেটা অবৈধ হবে। (কানজুল উম্মাল : ১/৯২)।

কোরবানির চামড়ার বিধান

কোরবানির পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার করা যাবে এবং চাইলে কাউকে হাদিয়াও দেয়া যাবে। (ফতোয়ায়ে শামি : ৬/৩২৮, ফতোয়ায়ে বাজ্জাজিয়া : ৬/২৯৪)। তবে নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করলে বিক্রিত মূল্য গরিবদের মাঝে দান করা আবশ্যক। (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩২৮, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/৩০১)। চামড়া বিক্রি করে টাকা নিজের কাজে খরচ করা জায়েজ নেই। তা দিয়ে হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, সেতু, মুসাফিরখানা, ঈদগাহ, কবরস্থান ও মসজিদ নির্মাণও বৈধ নয়। ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম ও শিক্ষকদের বেতন দেয়াও জায়েজ নেই। লা-ওয়ারিশ লাশের কাফন-দাফন করাও জায়েজ নেই বা লাশের পক্ষ থেকে তার রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ করা জায়েজ নেই। হুবহু চামড়া দান করে দেয়া উত্তম। এটাই মৌলিক বিধান। এটি সাধারণ গরিবদেরও দেয়া যায়, আবার মাদ্রাসার গরিব শিক্ষার্থীদের জন্যও দান করা যায়। উল্লেখ্য, যেসব মাদ্রাসায় গরিব শিক্ষার্থীরা কোরআনে কারিম শেখে বা রাসুল (সা.)-এর হাদিস পাঠ করে এবং আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলামকে সর্বমহলে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থভাবে জীবন বিলিয়ে দেয়, সেসব মাদ্রাসার গরিবদের ফান্ডে কোরবানির পশুর চামড়া দেয়া অতি উত্তম ও দ্বিগুণ সওয়াবের কাজ। এতে দুটি সওয়াব হাসিল হয়- একটি দান করার, অপরটি দ্বীনি ইলম শিক্ষায় সহযোগিতা করার। (ফতোয়ায়ে শামি : ৬/৩২৮, জাওয়াহিরুল ফিকহ : ৬/২৭৭, কিফায়াতুল মুফতি : ৮/২৩৮)।

পারিশ্রমিক হিসেবে পশুর কোনো কিছু দেয়া

জবাইকারী, কসাই বা কোরবানির কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কোরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেয়া যাবে না। অবশ্য নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসেবে গোশত বা তরকারি দেয়া যাবে। (ফতোয়ায়ে বাজ্জাজিয়া : ৬/২৯৪, আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩২৮)। আলী (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) আমায় তার কোরবানির উটের আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি কোরবানির পশুর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনের কাপড় সদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজেদের পক্ষ থেকে (আলাদাভাবে) দেব।’ (মুসলিম : ১৩১৭, বোখারি : ১৭১৬)। তবে কসাই বা কাজের লোকদের ঘরের অন্যান্য সদস্যদের মতো গোশত খাওয়ানো যাবে। (আহকামুল কোরআন লিল জাসসাস : ৩/২৩৭, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৪, আল বাহরুর রায়েক : ৮/৩২৬)।

পশুর কোনো কিছু বিক্রি করার বিধান

কোরবানির গোশত, চর্বি, হাড়, চামড়া, ইত্যাদি বিক্রি করা বৈধ নয়। তবে যদি কেউ বিক্রি করেই ফেলে, তাহলে সেই পূর্ণ টাকা সদকা করে দিতে হবে। আর যদি সদকার নিয়তে বিক্রি না করা হয়, তাহলে সে বিক্রি মাকরুহ হবে, কিন্তু তার মূল্য সদকা করেই দিতে হবে। (ইলাউস সুনান : ১৭/২৫৯, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৫, ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৫৪, ফতোয়ায়ে আলমগিরি : ৫/৩০১, আল বাহরুর রায়েক : ৮/১৭৮)। এ ছাড়া কোরবানির মৌসুমে অনেক মহাজন কোরবানির হাড় কিনে থাকেন। টোকাই ছেলেপুলের দল বাড়ি বাড়ি থেকে হাড় সংগ্রহ করে তাদের কাছে বিক্রি করে। কিন্তু কোনো কোরবানিদাতার জন্য নিজ কোরবানির কোনো কিছু (এমনকি হাড়ও) বিক্রি করা জায়েজ হবে না। করলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২২৫, ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৫৪, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/৩০১)।

চামড়ার মূল্য কেটে রাখা হারাম

অনেক এলাকায় কোরবানিদাতাদের কোরবানিকৃত পশুর সব চামড়া সমাজের এক নির্ধারিত স্থানে জমা হয় এবং সমাজের পক্ষ থেকে সেগুলো নিলামে বিক্রি করে প্রতি চামড়ার অর্ধেক মূল্য সমাজে রেখে বাকিটা কোরবানিদাতাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। সমাজে যা রাখা হলো, তা সঠিক খাতে ব্যয় হলো কিনা, সেটাও জানা সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় শরিয়তের বিধান হলো, সব চামড়া বিক্রি করার পর সমাজপতিদের জন্য কোরবানির চামড়ার পরিপূর্ণ মূল্য (যে চামড়ার যে দর আসে, সেটা) প্রথমে চামড়ার স্ব স্ব মালিকের (কোরবানিদাতাদের) কাছে পৌঁছে দেয়া ওয়াজিব।

এরপর স্বেচ্ছায় যদি কেউ তা থেকে টাকা দেয়, তা শরিয়তসম্মত খাতে ব্যয় করা উচিত। অন্যথায় টাকা নেয়াই বৈধ নয়। আর সামাজিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে চামড়ার মূল্য কেটে রাখা হারাম। (সুরা বাকারা : ২৮৩, কানজুল উম্মাল : ১/৯২)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত