সুকুক : কী এবং কেন

মুফতি আবদুল্লাহ মাসুম

প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত ইসলামিক প্রডাক্টগুলোর একটি হলো ‘সুকুক’। বিশেষত বাংলাদেশে এ সময়ে ইসলামিক ফিন্যান্স বিষয়গুলোর মধ্যে সুকুকের আলোচনা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে বছর দুয়েক আগেও এর তেমন আলোচনা ছিল না। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে এর আরও আগে থেকেই ইসলামিক ফিন্যান্সের বিভিন্ন লেকচারে এ নিয়ে আলোচনা করে আসছি। গত ২৯ মে, ২০১৯ পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘বিএসইসি’ সুকুক বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে। এরপর এ বিষয়ে দুটি আন্তর্জাতিক ওয়ার্কশপ হয়েছে। এর প্রথমটিতে একজন শরিয়া ও অর্থনীতি অবজারভার হিসেবে আমার থাকার সুযোগ হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম আইএফএ কনসালটেন্সি লিমিটেড কর্তৃক আয়োজিত সুকুক বিষয়ে অ্যাওফি সমর্থিত আন্তর্জাতিক মানের একটি পূর্ণাঙ্গ ট্রেনিং কোর্সও এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এর কয়েকটি ক্লাসও আমি নিয়েছি। বাংলাদেশ সরকার সুকুক ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে মাসখানেক আগেই। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ সরকারি সুকুক (ঝড়াবৎবরমহ ঝঁশঁশ) ইস্যু করা হবে।

বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, পুরো বিশ্বের ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যাসেটের ১৭ শতাংশই এ সুকুকের দখলে। কারেন্সির অঙ্কে তা ৪২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। (থমসন রয়টার্স, ২০১৭)।

সুকুক কী?

বলার উদ্দেশ্য, এ সুকুক আসলে কি? তা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। সহজে এর মূল কথাটি হলো এতটুকু আমরা জানি, কোম্পানি, ব্যাংক ইত্যাদি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থে পুঁজির প্রয়োজন হয়। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারেরও প্রয়োজন হয় মোটা অঙ্কের মূলধনের। কোম্পানিগুলো তাদের পুঁজি সরবরাহ করার গতানুগতিক পদ্ধতি হলো শেয়ার ইস্যু করা। অথবা বন্ড ইস্যু করা। অপরদিকে সরকারের গতানুগতিক পদ্ধতি হলো ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করা। সুকুক মূলত এ ধরনেরই ফান্ড সংগ্রহের একটি বিশেষ মাধ্যম, যার মাধ্যমে সরকার বা কোম্পানি তাদের পুঁজি/মূলধন সরবরাহ করে থাকে। তবে বাস্তবে বিভিন্ন দিক থেকে শেয়ার ও বন্ডের সঙ্গে সুকুকের পার্থক্য রয়েছে।

শেয়ারের সঙ্গে সুকুকের মূল পার্থক্যটি হলো শেয়ার মূলত আনুপাতিকহারে পুরো কোম্পানির অ্যাসেটের প্রতিনিধিত্ব করে। একটি শেয়ার ক্রয়ের অর্থ হলো, আপনি সেই কোম্পানির সব ধরনের অ্যাসেটের আনুপাতিক মালিকানা লাভ করেছেন। এজিএমে আপনি কথা বলতে পারবেন। এভাবে বৃহৎ শেয়ার সংগ্রহ করলে কোম্পানির নীতি-নির্ধারণীতেও আপনি ভূমিকা রাখতে পারবেন।

অপরদিকে সুকুক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ প্রজেক্টে সুনির্দিষ্ট অ্যাসেটের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। সাধারণ শেয়ারের মতো পুরো কোম্পানির সব অ্যাসেটের উপর হয় না।

ধরা যাক, ‘ক’ কোম্পানি একটি শিপিং কোম্পানি। তাদের অনেকগুলো শিপ আমদানি-রপ্তানিতে ভাড়ায় ব্যবহৃত হয়। কোম্পানির একটি শিপ ‘খ’ কোম্পানির কাছে ভাড়ায় দেওয়া। চুক্তি অনুযায়ী ‘খ’ কোম্পানিটি ৩ মাস অন্তর ভাড়া প্রদান করে। এদিকে ‘ক’ কোম্পানির নগদ মোটা অঙ্কের মূলধনের প্রয়োজন। এজন্য সে ওই শিপকে ভিত্তি করে তৃতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে [পরিভাষায় একে ‘এসপিভি’ (Special purpose vehicle) বলে] ১ হাজার সুকুক ইস্যু করল। প্রতিটি সুকুকের মূল্য ১ হাজার টাকা। মোট সুকুক মূল্য : ১০ লাখ টাকা। যারা সুকুক ক্রয় করবেন, তারা সবাই আনুপাতিকহারে ওই শিপের মালিক হয়ে যাবেন। এ কেসে ‘ক’ কোম্পানির লাভ হলো, সে উপস্থিত মূলধন পেয়ে গেছে। সুকুক হোল্ডারদের লাভ হলো, তারা ৩ মাস অন্তর অন্তর শিপ থেকে অর্জিত ভাড়া ভোগ করবে। এরপর একটা সময়ে শিপটি ওই তৃতীয় প্রতিষ্ঠান (এসপিভি) তাদের পক্ষে বিক্রয় করে দিবে। এটি ‘ক’ কোম্পানিও ক্রয় করে নিতে পারে।

লক্ষ্য করে দেখুন, এখানে সুকুক হোল্ডাররা একটি বিশেষ প্রজেক্টে ফান্ড সংগ্রাহক কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। শেয়ারের মতো পুরো কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয়নি।

তদ্রপ সুকুক সাধারণ বন্ডের মতোও নয়। বন্ড শতভাগ একটি সুদী প্রডাক্ট। বন্ড ক্রয় করার অর্থ সুদে ঋণ প্রদান করা। এখানে সুনির্দিষ্ট অ্যাসেট থেকে প্রাপ্ত প্রফিট বণ্টন করা হয় না। বরং বন্ড ইস্যুকারী তার সামগ্রিক আয় থেকে সুদ প্রদান করে থাকে। আয় না হলেও গৃহীত মূলধনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হয়। অপরদিকে সুকুক শতভাগ একটি ইসলামি প্রডাক্ট। সুকুক ক্রয়ের অর্থ সুদে ঋণ প্রদান নয়, বরং বিশেষ প্রজেক্টে অংশগ্রহণ। এ অংশগ্রহণ কখনও মুদারাবা, কখনও মুশারাকা, কখনও ইজারা, কখনও সালাম (Advanced Contract) ইত্যাদি শরিয়া কন্ট্রাক্টের অধীনে হয়ে থাকে (আমাদের পূর্বোক্ত উদাহরণটি ইজারা বা ভাড়া কন্ট্রাক্টের উদাহরণ)।

সুতরাং সুকুক অবশ্যই ফান্ড সংগ্রহের একটি বিশেষ মাধ্যম। তবে তা শেয়ার নয়, বন্ডও নয়। অবশ্য কিছু কিছু দিক থেকে শেয়ারের সঙ্গে মিল আছে। যেমন, এটিও শেয়ারের মতো সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন করা যায় (অবশ্য ডেবট বেইসড সুকুক ব্যতিক্রম)। শেয়ারের মতো এটিও আনুপাতিকহারে অবিভক্ত সমান মালিকানা বোঝায়। তদ্রপ বন্ডের সঙ্গেও কিছু মিল আছে, যেমন বন্ডের মতো সুকুক অবকাঠামোর উন্নয়ন এমনভাবে করা হয়, যেন বিনিয়োগকৃত মূলধন সুরক্ষিত থাকে। তবে অবশ্যই সেটি শরিয়া অনুসরণ করে। এ জন্যই অনেক গবেষক সুকুককে ‘কুআইজি ইক্যুইটি’ (Quasi Equity) ‘মেজানিন ইক্যুইটি’ (Meyyanine Equity) বলে অভিহিত করেছেন।

সুকুকের পোশাকি পরিচয় :

ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড প্রণেতা সংস্থা ‘অ্যাওফি’ তাদের ১৭ নম্বর শরিয়া স্ট্যান্ডার্ডে, প্রচলিত ইনভেস্টমেন্ট সুকুকের পোশাকি পরিচয় দিয়েছে এভাবে ‘ইনভেস্টমেন্ট সুকুক হলো সমমূল্যে বিভক্ত কিছু সার্টিফিকেট বা দলিলপত্র, যা কোনো সুনির্দিষ্ট দ্রব্যে বা কোনো কিছু উপকার গ্রহণে বা কোনো সার্ভিসিং/সেবায় বা সুনির্দিষ্ট কোনো প্রজেক্টের সম্পদে বা সুনির্দিষ্ট কোনো ইনভেস্টমেন্ট কার্যক্রমে অবিভক্ত আংশিক মালিকানা বুঝিয়ে থাকে। আর এর কার্যক্রম শুরু হয়ে থাকে সুকুকের মূল্য গ্রহণ, সুকুক গ্রহণ কার্যক্রম শেষ হওয়া ও যে উদ্দেশ্যে ফান্ড সংগ্রহ করা হচ্ছে সে উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার শুরু করার পর।’ (ধারা-২।)

সুকুকের বৈশিষ্ট্য

সুকুকের মূল বৈশিষ্ট্য তিনটি। যথা(১) এটি বিশেষ প্রজেক্টে হয়ে থাকে। (২) এর বিপরীতে সুনির্দিষ্ট অ্যাসেট থাকে। পরিভাষায় একে ‘আন্ডারলায়িং অ্যাসেট’ বলা হয়। সুকুক হোল্ডারদের মূলত সেই অ্যাসেট থেকে প্রফিট জেনারেট হয়। দেখুন সাধারণ ব্যাংক লোনের বিপরীতেও মর্টগেজ হিসেবে অ্যাসেট রাখতে হয়। তবে সেটি ব্যবহৃত হয় না। সেখান থেকে প্রফিট আসে না। (২) এর অবকাঠামো গঠন হয় শরিয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো কন্ট্রাক্টের অধীনে।

সুকুক শব্দের অর্থ

‘সুকুক’ শব্দটি মূলত বহুবচন। এর একবচন ‘ছক্ক’। মূল শব্দটি ফার্সি। সেখান থেকে আরবি ‘ছাক্কুন’। এরপর এর বহুবচন ‘সুকুক’। এর শাব্দিক অর্থ : সার্টিফিকেট। দলিল-দস্তাবেজ। যা কোনো সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন, জমির দলিল। (আল-মিসবাহুল মুনির, পৃ.১৮০)।

সুকুকের প্রায়োগিক ব্যবহার

প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐতিহাসিকভাবে ‘সুকুকের’ তিনটি অর্থ ও প্রয়োগ দেখা যায়। যথা

ক. কোনো সম্পদের ডুকুমেন্টস/সার্টিফিকেট। যেমন, ওয়াকফ সম্পদের দলিল। হিজরি পঞ্চম শতাব্দীতে এর ব্যবহার পাওয়া যায়। (রদ্দুল মুহতার, ১৩/৫৯২)।

খ. রাষ্ট্রীয় ভাতা প্রাপ্তির সার্টিফিকেট। এ ব্যবহারটি ৬৫ হিজরিতে উমাইয়্যাহ শাসনামলে পাওয়া যায়। মদিনার গভর্নর তখন মারওয়ান ইবনে হাকাম (২-৬৫ হি./৬২৩-৬৮ ঈ.)। ওই সময়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভাতা প্রদান করা হতো। সেই ভাতা প্রাপ্তির জন্য বিশেষ সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছিল। যা ‘সুকুক’ নামে পরিচিত ছিল। এই সুকুক দিয়ে নির্ধারিত স্থান থেকে রাষ্ট্রীয় ভাতা হিসেবে খাদ্য লাভ করা যেত। এই সুকুক আবার সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন হতো। যিনি এই সুকুক লাভ করতেন, তিনি সেটি দিয়ে ভাতা উত্তোলন না করে অন্যত্র বিক্রয় করে দিতেন। এতে যে সমস্যা হতো তা হলো পণ্য হস্তগত করার আগেই তা বিক্রয় করা হয়। হাদিসে তা স্পষ্ট নিষিদ্ধ। তাই তৎকালীন সাহাবায়ে কেরাম এর বিরোধিতা করেছেন। ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে হাদিসের কিতাবগুলোয় উল্লেখ হয়েছে। (মুসলিম, ৩৭৩৯)।

গ. সুদী বন্ডের বিকল্প হিসেবে ‘বিশেষ সার্টিফিকেট’। এ অর্থেই বর্তমানে ব্যবহৃত হয়। লক্ষ্য করুন, পূর্বোক্ত দুটি প্রয়োগ ও বর্তমান প্রয়োগে একটি বিশেষ মিল হলো, সুকুক সবসময় সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে এর আন্ডারলায়িং অ্যাসেট থাকে। এটিই সুকুকের মূল কথা।

প্রচলিত সুকুকের সূচনা

প্রচলিত সুকুকের সূচনা হয় ১৯৭৮ সালে জর্দানে ‘সকুকুল মুকারাযা’/‘মুদারাবা’ দিয়ে। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪ সালে তুরস্কে ‘মুশারাকা সুকুক’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ‘তার্কিশ রেভিনিউ ‘শেয়ারিং সার্টিফিকেট’ নামে পরিচিতি ছিল। এটি ছিল সে দেশের প্রথম সরকারি সুদমুক্ত বন্ড। এরপর ১৯৯০-এ মালয়েশিয়ায় সর্বপ্রথম করপোরেট সুকুক ইস্যু করে। (সুকুক প্রিন্সিপাল অ্যান্ড প্র্যাকটিস, ইসরা, পৃ. ৬১)। এরপর বিভিন্ন দেশে সুকুক ইস্যু হয়।

সুকুক কেন প্রয়োজন?

একটি টেকসই ও কল্যাণধর্মী অর্থব্যবস্থার জন্য সুদ অন্যতম প্রতিবন্ধক। সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা সম্পদের সুষম বণ্টন ব্যাহত করে। সম্পদে এককেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন ধরে সুদভিত্তিক বন্ড আমাদের অর্থব্যবস্থায় প্রচলিত। এর থেকে উত্তোরণের অন্যতম উপায় সুকুক প্রচলন করা। সুকুক সম্পূর্ণ সুদমুক্ত একটি ইসলামি বন্ড। এটি সুদের বিপরীতে টেকসই অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি এটি সম্পূর্ণরূপে সম্পদভিত্তিক হওয়ায় এতে আর্থিক ঝুঁকিও সামগ্রিকভাবে কম। তবে সুকুক থেকে উপকার ও কল্যাণ লাভ করতে হলে এর শরিয়া পরিপালন সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ সুকুক ইস্যু করবে এটি অবশ্যই ভালো ও প্রত্যাশিত। তবে সেটা অবশ্যই সুদৃঢ় শরিয়া পরিপালনের মধ্য দিয়ে হতে হবে। এর জন্য দেশের টপ টু বটম ইসলামি অর্থনীতি বাস্তবায়ন অপরিহার্য। সব কিছু অনৈসলামিক রেখে শুধু বন্ডে ইসলামীকরণ করা হলে এর সুফল নিয়ে সংশয় থেকে যায়।

 

লেখক : সার্টিফাইড শরিয়া অ্যাডভাইজর অ্যান্ড অডিটর, অ্যাওফি বাহরাইন