যে দানে নেই প্রতিদান
আবদুল্লাহ হাসান কাসেমি
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আর্তমানবতার সহায়তায় এবং বিভিন্নমুখি দ্বীনি সহযোগিতায় আমরা দান-সদকা করি। যা আল্লাহতায়ালার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দনীয় একটি ইবাদত। এর দ্বারা বিপদাপদ দূর হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়, পুণ্য ও প্রতিদান লাভ হয় এবং পরকালীন জীবন হয় সুখী, সমৃদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে? তাহলে তিনি দাতার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন এবং তার জন্য রয়েছে মহাপ্রতিদান।’ (সুরা হাদিদ : ১১)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তোমরা কোনো পুণ্য অর্জন করতে পারবে না, যতক্ষণ না পছন্দনীয় বস্তু আল্লাহর পথে ব্যয় করবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯২)। উকবা ইবনে আমির (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘প্রতিটি মানুষ কেয়ামতের দিন তার সদকার ছায়াতলে থাকবে, যতক্ষণ না মানুষের মধ্যে ফয়সালা করা হবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭৩৩৩)।
অবৈধ পথে উপার্জিত সম্পদ ব্যয় : দানের অপরিসীম সওয়াব ও ফজিলতের কথা শুনে আমরা অনেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনাথ, অসহায় ও বিপদগ্রস্ত লোককে সহযোগিতা করি, তাদের প্রয়োজন পূরণে বিভিন্ন দান-সদকা করি। তাছাড়া মসজিদ, মক্তব ও মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় কাজে ও ধর্মীয় সেক্টরেও ডোনেশন দিয়ে থাকি। আমাদের এসব দান ও অনুদান যদি হালাল ও বৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ থেকে হয়, তাহলে আল্লাহর কাছে তা গৃহীত হবে; নইলে এর কোনো প্রতিদান মিলবে না এবং কানাকড়িও মূল্যায়িত হবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা যা-কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। আর এরূপ মন্দ জিনিস (আল্লাহর নামে) দেওয়ার নিয়ত কোরো না, যা (অন্য কেউ তোমাদেরকে দিলে ঘৃণার কারণে) তোমরা চোখ বন্ধ না করে তা গ্রহণ করবে না। মনে রেখ, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী; সর্বপ্রকার প্রশংসা তাঁরই।’ (সুরা বাকারা : ২৬৭)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো বান্দা হালাল সম্পদ থেকে কিছু সদকা করে, আর আল্লাহতায়ালা শুধু হালাল বস্তুই গ্রহণ করেন, তখন রহমান তা ডান হাতে গ্রহণ করেন, যদিও তা একটি খেজুর পরিমাণ হয়। অতঃপর দানটি রহমানের হাতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি তা পাহাড়ের চেয়েও বড় ও বিরাট হয়ে যায়। যেভাবে তোমাদের কেউ উটের বাচ্চা লালিত-পালিত করে বড় করে তোলে।’ (মুসলিম : ১০১৪)।
দানে রিয়া ও লৌকিকতা : অনেকে হালাল ও বৈধ উপায়ে অর্জিত টাকাণ্ডপয়সা ব্যয় করে; কিন্তু তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হয় রিয়া ও লৌকিকতা। ফলে অঢেল সম্পদ মুক্ত হস্তে ব্যয় করেও তারা বিন্দুবিসর্গ প্রতিদান পাওয়ার উপযুক্ত হয় না; বরং যাবতীয় চেষ্টা-মেহনত বিফলে যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(তোমরা তোমাদের দান-সদকা বরবাদ কোরো না ওই ব্যক্তির মতো) যে লোক দেখানোর উদ্দেশে আপন সম্পদ ব্যয় করে এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না।’ (সুরা বাকারা : ২৬৪)। লোক দেখানোর উদ্দেশে দান করে প্রতিদান পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে তিন শ্রেণির লোকের ব্যাপারে ফয়সালা করা হবে, তাদের একশ্রেণি হচ্ছে শহিদ। এদের উপস্থিত করার পর আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে কী কী নেয়ামত দান করেছিলেন, তা স্মরণ করিয়ে দেবেন। তারা দুনিয়াতে প্রাপ্ত সব নেয়ামতের কথা স্বীকার করবে। তখন আল্লাহতায়ালা জিজ্ঞেস করবেন, ‘আচ্ছা, এসব নেয়ামত পেয়ে তোমরা কী আমল করেছ?’ উত্তর দেবে, ‘আপনার পথে প্রাণপণ লড়াই করেছি, এমনকি অবশেষে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করেছি।’ আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘মিথ্যা বলছ। লড়াইয়ের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তোমাদেরকে বীর-বাহাদুর বলা হবে। আর তা বলা হয়ে গেছে।’ এরপর তার ব্যাপারে নির্দেশ জারি করা হবে। ফলে তাকে উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামের গর্তে নিক্ষেপ করা হবে।
আরেক শ্রেণি হচ্ছে, ওইসব লোক, যারা ইলম শিখেছে, ইলম শিক্ষা দিয়েছে এবং কোরআন পড়েছে। এদেরকেও উপস্থিত করার পর আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে কী কী নেয়ামত দান করেছিলেন, তা স্মরণ করিয়ে দেবেন। তারাও দুনিয়াতে প্রাপ্ত সব নেয়ামতের কথা স্বীকার করবে। তখন আল্লাহতায়ালা জিজ্ঞেস করবেন, ‘আচ্ছা, এসব নেয়ামত পেয়ে তোমরা কী আমল করেছ?’ উত্তর দেবে, ‘আমরা নিজে ইলম শিখেছি, অন্যকে ইলম শিক্ষা দিয়েছি এবং আপনার সন্তুষ্টির জন্য কোরআন পাঠ করেছি।’ আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘মিথ্যা বলছ। আসল কথা হচ্ছে, তোমরা ইলম শিখেছ, কোরআন পড়েছ এজন্য যে, তোমাদের বড় আলেম, বড় কারি বলা হবে। আর তা বলা হয়ে গেছে।’ এরপর তাদের ব্যাপারে একই নির্দেশ জারি করা হবে। ফলে তাদেরও উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামের গর্তে নিক্ষেপ করা হবে।
তৃতীয় আরেক শ্রেণি হচ্ছে, ওইসব ধনী লোক, যাদের আল্লাহতায়ালা সব ধরনের সম্পদ ও প্রাচুর্য দান করেছিলেন। এদেরও উপস্থিত করে আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে কী কী নেয়ামত দান করেছিলেন, তা স্মরণ করিয়ে দেবেন। তারাও দুনিয়াতে প্রাপ্ত সব নেয়ামতের কথা স্বীকার করবে। তখন আল্লাহতায়ালা জিজ্ঞেস করবেন, ‘আচ্ছা, এসব নেয়ামত পেয়ে তোমরা কী আমল করেছ?’ তারা উত্তর দেবে, ‘আপনার সন্তুষ্টির জন্য আপনার প্রিয় ও পছন্দনীয় সব পথেই আমরা খরচ করেছি।’ আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘মিথ্যা বলছ। তোমাদের দানের পেছনে আসল উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তোমাদের দানবীর বলা হবে। আর তা বলা হয়ে গেছে।’ এরপর তাদের ব্যাপারেও অভিন্ন নির্দেশ জারি করা হবে। ফলে তাদেরও উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামের গর্তে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম : ১৯০৫)।
খোটা ও কষ্ট দান : কাউকে কিছু দান করার পর উচিত হলো, তা ভুলে যাওয়া এবং পরকালে আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান পাওয়ার আশা রাখা। কিন্তু আমরা অনেকে ইসলামের এ সুন্দর বিধানটি ভুলে যাই এবং কারণে-অকারণে গ্রহীতাকে খোটা দিই। যার বিষফলরূপে তার মনে চরম আঘাত সৃষ্টি হয় এবং সে ভীষণ কষ্ট অনুভব করে। এর মাধ্যমেও দান-সদকার প্রতিদান নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের সদকাসমূহকে খোটাদান ও কষ্টদানের মাধ্যমে বরবাদ কোরো না।’ (সুরা বাকারা : ২৬৪)। প্রতিদান তো পাবেই না, সেই সঙ্গে সে আল্লাহতায়ালার চরম রোষানলে পড়বে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তিন ব্যক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।’ বর্ণনাকারী বলেন, আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! তারা কারা? তারা তো ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘খোটা দানকারী, টাখনুর নিচে লুঙ্গি পরিধানকারী এবং ওই ব্যক্তি, যে মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করে।’ (তিরমিজি : ১২১১)।
বিশুদ্ধ নিয়ত অনিবার্য : আল্লাহর কাছ থেকে যথাপ্রাপ্য প্রতিদান পেতে হলে দান-অনুদান হতে হবে ইখলাস ও আন্তরিকতাপূর্ণ এবং রিয়া ও লৌকিকতামুক্ত; যাতে অনুগ্রহ ফলানো হবে না এবং কাউকে কষ্ট দেওয়া হবে না। এছাড়া আমল যত বড় ও বিরাটই হোক না কেন এবং যত সুন্দর ও প্রশংসনীয়ই হোক না কেন, আল্লাহতায়ালার কাছে তার কানাকড়িও মূল্য নেই, নেই প্রাপ্তি ও প্রতিদানও। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। যে যেমন নিয়ত করবে, সে তেমন ফল পাবে। সুতরাং যার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উদ্দেশ্যে হবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তার রাসুলের উদ্দেশেই বিবেচিত হবে। আর যার হিজরত দুনিয়া হাসিলের উদ্দেশে কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশে হবে, তার হিজরত উক্ত উদ্দেশেই বিবেচিত হবে। (বোখারি : ১)।