প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা কাম্য নয়
আবদুল্লাহ নোমান
প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মোমিনের বিশ্বাস হলো, নিখিল বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিকে আল্লাহতায়ালাই রিজিক দান করেন। দৃশ্য-অদৃশ্য সব জীবের জীবনধারণের যাবতীয় উপকরণ তিনিই যুগিয়ে থাকেন। শাশ্বত এ বিশ্বাস অনুযায়ী ইসলামে একে দেওয়া আছে জীবনযাত্রার এক সুষ্ঠু সুষম ও পরিচ্ছন্ন নকশা। প্রত্যেক মুসলমান মনেপ্রাণে সে বিশ্বাস লালন করলেও বিশ্বাস কেন্দ্রিক জীবনছকটি সবার সামনে পরিষ্কার নয়। তাইতো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনধারায় অর্থবিত্তের লাগামহীন দৌড়ঝাঁপ এবং হালাল-হারামের তোয়াক্কাহীন অসুস্থ প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হয়। মানুষ জীবিকার ধান্দায় অন্ধ হয়ে যায়। ফলে তাকে অনিদৈশ্য যাত্রার অহেতুক মেহনতে নাকাল-নিগৃহীত হতে হয়। জীবনের বাঁকে বাঁকে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার শিকার হতে হয়। অথচ আমাদের জন্য যা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা যদি দুই পর্বতের নিচেও থাকে, তবুও তা আমাদের কাছে আসবে। আর যা নির্ধারণ করা হয়নি, তা যদি আমাদের দুই ঠোঁটের মাঝেও থাকে, তবুও তা আমরা হাসিল করতে পারব না। এটাই বাস্তবতা।
দারিদ্র্যবিমোচনে ইবাদত
শুচিশুদ্ধ ব্যক্তি জীবন, আলোকস্নাত সমাজ এবং সুষম রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য চাই অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। তবে এর উপার্জন হতে হবে সম্পূর্ণ হালাল পন্থায়। ইবাদতকে প্রাধান্য দিতে হবে সর্বাবস্থায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি আমার ইবাদতের জন্য অবসর হয়ে যাও, আমি তোমার হৃদয় সচ্ছলতা দ্বারা পূর্ণ করে দেব এবং তোমার অভাবের দরজা বন্ধ করে দেব। আর যদি তা না কর, তবে আমি তোমার অন্তরকে ব্যস্ততায় ভরে দেব; কিন্তু তোমার অভাব দূর করব না।’ (তিরমিজি : ২৪৬৬)। সেই সঙ্গে নির্মল, সুখময় ও সৌকর্যময় জীবনের প্রত্যাশী হলে অবশ্যই অল্পে তুষ্টির গুণ অর্জন করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘বড়ই সুখের জীবন ওই ব্যক্তির, যে ইসলামের হেদায়াত লাভ করেছে। আর প্রয়োজন অনুপাতে তার জীবিকার ব্যবস্থা হয়েছে এবং তাতে সে পরিতুষ্ট রয়েছে।’ (তিরমিজি : ২৩৪৯)।
প্রাচুর্যের লালসা কাম্য নয়
মূলত দু’দিনের এ পান্থশালায় বিত্ত-বৈভব এবং প্রাচুর্যের লালসা মানুষকে চিরস্থায়ী জীবনের সুখণ্ডশান্তি থেকে গাফেল করে দিয়েছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, পার্থিব ভোগ-বিলাস ও ভোগ-উপভোগই যেন জীবনের মূল লক্ষ্য। অর্থ-ঐশ্বর্য ও বিত্ত-বৈভবের নাগাল পাওয়াই যেন হায়াতের মূলমন্ত্র। কিন্তু জীবনের রেলগাড়ি যখন কবরের স্টেশনে গিয়ে দাঁড়ায়, তখনই মানুষের বোধোদয় হয়। চাকচিক্যময় ভঙ্গুর পৃথিবীর আসল রূপ প্রকাশিত হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(পার্থিব ভোগসামগ্রীতে) একে অন্যের ওপর আধিক্য লাভের প্রচেষ্টা তোমাদের উদাসীন করে রাখে। যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে পৌঁছ। কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শিগগিরই তোমরা জানতে পারবে। আবারও (শোন) কিছুতেই এরূপ সমীচীন নয়। শিগগিরই তোমরা জানতে পারবে। কখনোই নয়। তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের সঙ্গে যদি এ কথা জানতে (তবে এরূপ করতে না)। তোমরা জাহান্নাম অবশ্যই দেখবে। তোমরা অবশ্যই তা দেখবে চাক্ষুষ প্রত্যয়ে। অতঃপর সেদিন তোমাদের নেয়ামতরাজি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে (যে, তোমরা তার কী হক আদায় করেছ?)’ (সুরা তাকাসুর : ১-৮)।
দম ফুরালে সব বিদায়
মূলত দুনিয়া পূজা ও বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে এতটাই মোহগ্রস্ত করে ফেলে যে, সে জীবনের প্রকৃত মূল্যবোধ, সঠিক দর্শন এবং কাঙ্ক্ষিত মধ্যপন্থা থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়ে। ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির ভালোবাসায় কিংবা অপরের সঙ্গে বড়াই করার প্রতিযোগিতায় এমন মত্ত হয়ে পড়ে যে, পরিণাম চিন্তা করার ফুরসতই পায় না। তাকদিরে আল্লাহ কর্তৃক রিজিক নির্ধারিত আছে; এ মহাসত্য সে দিব্যি ভুলে বসে এবং পার্থিব উপায়-উপকরণই তার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। সম্পদের অট্টালিকা গড়ে তোলার জন্যই সে হন্যে হয়ে ঘোরে দুনিয়া নামক সোনার হরিণের পেছনে। অথচ নিঃশ্বাস বন্ধ হলেই সব হাতছাড়া হয়ে যায়। চলে যায় অন্যের মালিকানায়। আবদুল্লাহ ইবনে শিখখির (রা.) বলেন, আমি একবার রাসুল (সা.)-এর কাছে পৌঁছে দেখলাম, তিনি সুরা তাকাসুর তেলাওয়াত করছেন। আর বলছেন, আদম সন্তান বলে, ‘আমার সম্পদ! আমার সম্পদ!’ অথচ হে আদম সন্তান! তোমার সম্পদ সেটা, যা তুমি খেয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছ, পরিধান করে পুরোনো করে ফেলেছ অথবা সদকা করে সামনে (আখেরাতের জন্য) পাঠিয়েছ।’ (মুসলিম : ৭৩১০)। মুসলিমের অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘এ ছাড়া যা আছে, তা তোমার হাত থেকে চলে যাবে এবং অপরের জন্য তা ছেড়ে যাবে।’ দুনিয়ার প্রতি মানুষের লোভলালসা এতটাই প্রকট যে, কবরের মাটিই তা শুধু মেটাতে পারে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আদম সন্তানের যদি সোনায় পূর্ণ একটি উপত্যকা থাকে, (তবে সে তাতেই সন্তুষ্ট হবে না; বরং) দুটি উপত্যকা কামনা করবে। তার মুখ কবরের মাটি ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা ভর্তি করা সম্ভব নয়। যে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন।’ (বোখারি : ৬৪৩৯)।
জন্মের আগেই রিজিক নির্ধারিত
আসমান-জমিন সৃষ্টি করার ৫০ হাজার বছর আগে আল্লাহ আমাদের তাকদির নির্ধারণ করে রেখেছেন। প্রত্যেক ছোট-বড় জিনিস লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। শিশু যখন মায়ের গর্ভে অবস্থান করে, তখন ১২০তম দিনে একজন ফেরেশতা এসে গর্ভস্থিত ফিটাসে রুহ ফুঁকে দেন। এ সময় তার ব্যাপারে চারটি বিষয় নির্ধারিত হয়ে যায়- ১. সে জীবনে সুখী হবে নাকি দুঃখী হবে? ২. জান্নাতি হবে নাকি জাহান্নামি হবে? ৩. জীবনে কী কী করবে? ৪. তার রিজিক কোত্থেকে কতটুকু আসবে? রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের সবার সৃষ্টির উপাদান নিজ নিজ মায়ের পেটে ৪০ দিন পর্যন্ত বীর্যরূপে অবস্থান করে। পরবর্তী সময়ে ৪০ দিন জমাট বাঁধা রক্তরূপে থাকে। পরবর্তী সময়ে ৪০ দিন গোস্ত পি-রূপে থাকে। অতঃপর আল্লাহ একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তাকে চারটি বিষয়ে আদেশ দেওয়া হয়। তাকে লিখতে বলা হয়, তার আমল, তার রিজিক, তার আয়ু এবং সে পাপী হবে নাকি নেককার হবে, সে বিষয়ে। অতঃপর তার মধ্যে আত্মা ফুঁকে দেওয়া হয়। কাজেই তোমাদের কোনো ব্যক্তি আমল করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তার এবং জান্নাতের মাঝে মাত্র একহাত পার্থক্য থাকে, এমন সময় তার আমলনামা তার ওপর জয়ী হয়, তখন সে জাহান্নামবাসীর মতো আমল করে। আরেকজন আমল করতে করতে এমন স্তরে পৌঁছে যে, তার এবং জাহান্নামের মাঝে মাত্র এক হাত তফাৎ থাকে। এমন সময় তার আমলনামা তার ওপর জয়ী হয়। ফলে সে জান্নাতবাসীর মতো আমল করে।’ (বোখারি : ৩২০৮)।
রিজিক নিয়ে চিন্তা নয়
আল্লাহ যখন রিজিক নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা কি কেউ পরিবর্তন করতে পারবে? সারা বিশ্বের মানুষ এক হয়ে চেষ্টা করলেও তা কি বদলাতে পারবে? না। কখনও নয়। ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি একদিন রাসুল (সা.)-এর পেছনে ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি বিষয় শিখিয়ে দিচ্ছি; তুমি আল্লাহকে (আল্লাহর বিধিবিধানকে) হেফাজত কর, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। তুমি আল্লাহকে হেফাজত কর; আল্লাহকে তোমার সামনে পাবে। যখন তুমি প্রার্থনা করবে, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। যখন সাহায্য চাইবে, আল্লাহর সাহায্য চাইবে। জেনে রাখ, দুনিয়ার সব মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েও যদি তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তবুও তারা তোমার কোনো উপকার করতে পারবে না। তবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন, ততটুকুই করতে পারবে। অনুরূপ তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েও যদি তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, তবুও তারা তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন, ততটুকুই করতে পারবে। কলমগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে; আর কাগজগুলো শুকিয়ে গেছে। (অর্থাৎ সবার তাকদির চূড়ান্তভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে; তাতে আর কোনো পরিবর্তন হবে না)। (তিরমিজি : ২৫১৬)। আমরা যেভাবেই উপার্জন করি না কেন, যত চেষ্টাই করি না কেন, তাকদিরে নির্ধারিত রিজিকের বাইরে কানাকড়িও আমাদের ভাগ্যে আসবে না। কাজেই আমাদের উচিত, উপার্জনের জন্য হালাল পন্থাই বেছে নেওয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে লোকসব! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তমপন্থায় জীবিকা অন্বেষণ কর। কেননা, কোনো ব্যক্তিই তার জন্য নির্ধারিত রিজিক পূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করবে না। যদিও তার রিজিক প্রাপ্তিতে কিছু বিলম্ব হয়। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ কর। যা হালাল, তাই গ্রহণ কর এবং যা হারাম, তা বর্জন কর।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৪৪)।
হারাম উপার্জন ধ্বংসের কারণ
ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। এতে ইহজীবন যেমন সুখময় ও প্রশান্তিদায়ক হয়, তেমনি পরকালীন জীবনও হয় পরম আনন্দময় ও সৌভাগ্যময়। আর অবৈধ পন্থায় রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেলেও তা দুনিয়া ও আখেরাত দু-কুলকেই ধ্বংস করে। ডেকে আনে ভয়াবহ বিপর্যয় ও চরম অধঃপতন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে শরীর হারাম দ্বারা গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (আত তারগিব : ১৭৩০)। একবার আলী ইবনে আবি তালেব (রা.) মসজিদে গেলেন। তার সঙ্গে একটি ঘোড়া ছিল। তিনি মসজিদের ভেতরে প্রবেশের আগে এক লোককে ঘোড়াটি দিলেন এবং বললেন, ঘোড়াটি যেন সে দেখে রাখে। লোকটি ঘোড়ার লাগাম চুরি করে নিয়ে গেল। মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় আলী (রা.) ভাবলেন, লোকটিকে ঘোড়া দেখে রাখার জন্য চার দিনার মজুরি দেবেন। তিনি বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, ঘোড়ার লাগাম হারিয়ে গেছে। তিনি তার সেবককে বললেন, ‘এই চার দিনার দিয়ে আমার জন্য বাজার থেকে একটি লাগাম নিয়ে এসো।’ সেবক বাজারে গিয়ে দেখল যে, এক ব্যক্তি লাগাম বিক্রি করছে। এ ছিল সেই ব্যক্তি, যে লাগামটি চুরি করেছিল। সেবকটি দামাদামি করে ওই ব্যক্তির কাছ থেকেই চার দিনারে লাগাম কিনে নিয়ে এলো। (বিপদ যখন নেয়ামত : ১/৫২)। ভাবার বিষয় হলো, লোকটি একটু অপেক্ষা করলেই বৈধভাবে চার দিনারই লাভ করত; কিন্তু সে তাড়াহুড়ো করে হারাম পন্থায় একই টাকা হাতিয়ে নিল। যার জন্য তাকে পরকালে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কঠিন জবাবদিহি করতে হবে। অতএব, হারামপন্থা নয়, সর্বাবস্থায় হালাল পন্থাকেই প্রাধান্য দিতে হবে। তবেই ইহ-পরকালে সাফল্য পদচুম্বন করবে।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম, কৈয়গ্রাম পটিয়া, চট্টগ্রাম