চীনা স্থাপত্যে মুসলিম প্রভাব
মুসা আল হাফিজ
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
চীনা স্থাপত্যের আছে একটি সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় ইতিহাস। যাতে প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় প্রভাবের সংমিশ্রণ। চীনা স্থাপত্যের উপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছে ইসলাম। চীন যাকে আমন্ত্রণ করেছিল সিল্ক রোড বাণিজ্য পথের মাধ্যমে। ইসলামিক এবং চীনা সভ্যতার মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া মুসলিম স্থাপত্যের উপাদানগুলোকে ঐতিহ্যগত চীনা কাঠামোতে গভীর অবস্থান দেয়। যার ফলে একটি অনন্য স্থাপত্যের মিশ্রণ ঘটেছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, মূল স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য এবং চীনা স্থাপত্যের উপর মুসলিম প্রভাবের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য অন্বেষণ করলে বিষয়টির একটি চেহারা স্পষ্ট হবে।
সিল্ক রোড সংযোগ ছিল একটি খোলা দরোজা। যার মাধ্যমে ইসলামি বিশ্ব এবং চীনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া চলে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। প্রাথমিকভাবে সিল্ক রোড বাণিজ্য রুটের মাধ্যমে যোগাযোগের বহুমাত্রিকতা নিশ্চিত হয়, এই বাণিজ্যরোড যা পূর্ব ও পশ্চিমকে সংযুক্ত করেছে। বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে পণ্য, ধারণা এবং সংস্কৃতির আদান-প্রদানকে সহজতর করেছে।
সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে, মধ্যএশিয়া এবং পারস্যের বণিক ও ভ্রমণকারীরা চীনে নিজেদের উপস্থিতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। অন্যান্য অঞ্চল থেকেও মুসলিম আগমন ও তাদের সমৃদ্ধ প্রভাব চীনের রাজনীতি, অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো স্থাপত্য শৈলীতেও নিজের উপস্থিতির জানান দেয়। ধীরে ধীরে চীনা স্থাপত্যে ইসলামি রুচি ও শৈলী একটি অমোচনীয় ও স্বাভাবিক চরিত্র লাভ করে।
মসজিদ ও দুই স্থাপত্যধারার একীকরণ
এখনো গোটা চীনে এর প্রতিফলন দেখা যাবে বিভিন্ন কাঠামোতে। এতে ইসলামি এবং চীনা স্থাপত্য শৈলীর সংমিশ্রণ স্পষ্ট। মসজিদ এবং ধর্মীয় ভবনগুলোর কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। এতে চীনা ল্যান্ডস্কেপে ইসলামিক স্থাপত্যের উপাদানগুলোর সবচেয়ে গভীর ও অবিচ্ছিন্ন সংযোজন লক্ষ্য করা যায়।
মসজিদগুলো ইসলামি সংস্কৃতি ও ইবাদতের প্রধান কেন্দ্র। চীনে তা দুই ঐতিহ্যের স্থাপত্য শৈলীর একীকরণের প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। চীনা মসজিদ সাধারণত কিংজেন সি নামে পরিচিত। এতে ইসলামি নকশা নীতির সঙ্গে ঐতিহ্যগত চীনা স্থাপত্য কৌশলগুলোর যে যৌথতা লক্ষ্য করা যায়, তা চীনের মুসলিমদের বিশেষ সাংস্কৃতিক মাত্রাকেই যেন ভাষাহীন প্রগলভতায় ব্যক্ত করে। চীনা মসজিদের মেহরাব ইসলামি জ্যামিতিক নিদর্শন, আরবেস্ক নকশা এবং ক্যালিগ্রাফিতে সমৃদ্ধ। জটিল মোজাইক এবং রঙিন টাইলস দেওয়াল এবং গম্বুজগুলোকে শোভিত করে, সৌন্দর্য এবং অলঙ্করণের উপর ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিকে নান্দনিক অবয়বে বর্ণনা করে।
চাইনিজ মসজিদে সাধারণত দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ভেতরের উঠোন দেখা যায়, এটি এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা চীনা স্থাপত্য ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই আঙিনাগুলো ইবাদত এবং প্রাকৃতিক সহজতার প্রতিফলন করে যেন। যা খোলামেলা এবং নির্মল, উদার আলো-বাতাসের অনুকূল। কিছু চীনা মসজিদে ঐতিহ্যগত চীনা প্যাগোডা আকারের ডিজাইন দেখা যায়। যা মিনারগুলোকে বিশিষ্ট উপায়ে চীনা চরিত্র দিয়েছে। এ ফিউশনটি একটি একক কাঠামোর মধ্যে ঘটেছে। কিন্তু তা অবলীল স্বাচ্ছন্দ্যে দুটি স্থাপত্য ঐতিহ্যের একীকরণ করেছে। যে স্বাচ্ছন্দ্য চীনের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্কের ঘরোয়া আয়োজনের প্রতিনিধিত্ব করে।
আবাসিক আর্কিটেকচারে দুই ধারার একীকরণ
ইসলামি স্থাপত্যের প্রভাব শুধু ধর্মীয় ভবনেই সীমাবদ্ধ নয়; নির্দিষ্ট অঞ্চলের আবাসিক স্থাপত্যকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে ইসলামি স্থাপত্য। গৃহনির্মাণকলা তো বটেই, ঐতিহ্যবাহী চীনা উঠানের ঘরগুলোও ইসলামিক নান্দনিকতা এবং কার্যকরী বিবেচনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, আকার লাভ করেছে। এই প্রভাবকে কয়েকটি ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। যেমন-
ক আঙিনা লেআউট : ইসলামিক স্থাপত্য প্রায়ই নারী এবং পরিবারের জন্য গোপনীয়তার উপর জোর দেয়। চীনা মুসলিমদের ঘরবাড়ি এ ধারায় তৈরি। কিন্তু মুসলিম নন, এমন চীনাদের ঐতিহ্যগত বাড়িতেও এই প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। যা এখনো বিদ্যমান একটি নীতি। পারিবারিক গোপনীয়তার উপর এই সাধারণ জোর তৈরি হয়েছে উভয় স্থাপত্য ঐতিহ্যের মিশ্রণের মধ্য দিয়ে। যা মুসলিম গৃহগঠনের অঙ্গন বিন্যাসের প্রথাকে চীনের পক্ষ থেকে একীকরণের নজির।
খ. শৈলীগত উপাদান : ইসলামণ্ডঅনুপ্রাণিত আলংকারিক উপাদান চীনা স্থাপত্যে স্থায়ী উপাদান হয়ে উঠে। বিশেষত উঠান-বাড়ির নকশায় এর প্রয়োগ ঘটে বেশি। যেমন জটিল কাঠের জালির পর্দা এবং টালির কাজ চীনা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। দুটি স্থাপত্য শৈলীকে নির্বিঘ্নে মিশ্রিত করার মধ্য দিয়ে এটা ঘটেছে।
গ. ছাদের নকশা : কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ইসলামি স্থাপত্যের প্রভাব দেখা যায় পিচ করা ছাদ এবং কাচের নকশায়ও। যা মধ্যপ্রাচ্যের বাড়ির ঐতিহ্যবাহী শৈলীর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
সাংস্কৃতিক তাৎপর্য : ইসলামিক এবং চীনা স্থাপত্য উপাদানের মিশ্রণ নিছক নান্দনিকতায় সীমিত নয়। বরং এটি এক সাংস্কৃতিক সংশ্লেষণের ধারাবাহিকতার প্রভাব, যা বহু শতাব্দী ধরে চলে আসছে। এই স্থাপত্য সংমিশ্রণ চীনা সমাজের মধ্যে বিভিন্ন সংস্কৃতির সুরেলা সহাবস্থানের সম্ভাবনার সাক্ষ্য বহন করে, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার সুবিধার পক্ষে কথা বলে।
চীনা স্থাপত্যে ইসলামি উপাদানের অন্তর্ভুক্তি ধর্মে ধর্মে ও সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিতে সংলাপ এবং বোঝাপড়ার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। ঐতিহ্যবাহী চীনা কাঠামোর সঙ্গে ইসলামিক নকশার নীতিগুলোকে একীভূত করার মাধ্যমে চীনা মন বিশেষ রং-এর স্বাক্ষর রেখেছে। স্থপতি এবং নির্মাতারা সাংস্কৃতিক ব্যবধান কমাতে চেষ্টা করেছেন অনেকটা অবচেতনভাবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের নন্দনবোধকে আলিঙ্গণ করেছে। তাদের কাজগুলো সেই শুভেচ্ছাকে প্রচার করছে।
চীনা স্থাপত্যের উপর মুসলিম প্রভাব চীনের ইতিহাসের বহুসাংস্কৃতিক প্রকৃতির জানান দেয়। এটি বুঝিয়ে দেয় বিভিন্ন সভ্যতার গলে যাওয়া পাত্র হিসাবে ভূমিকা রাখে দেশ। একটি রাষ্ট্র তার প্রতিটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ট্যাপেস্ট্রিতে অবদান রাখতে পারে। চীনা কাঠামোতে ইসলামিক স্থাপত্য উপাদানগুলোর অন্তর্ভুক্তির ফলে স্থাপত্য কৌশল এবং শৈলীর বিবর্তন ঘটেছে। প্রভাবের এই মিশ্রণ সমসাময়িক ডিজাইনারদের জন্য বহুমুখিতার আশ্বাস ও সুবিধা তৈরি করেছে। তাদের জন্য স্থাপত্য বিকল্পগুলোর বিচিত্র পথ খুলে দিয়েছে। তারা সেসব পথ ধরে হেঁটেছেন।
সিল্ক রোড বাণিজ্য ধারায় সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়াগুলোর স্থায়ী প্রভাবের একটি প্রমাণ পাওয়া যায় চীনা স্থাপত্যে মুসলিম প্রভাবের মধ্যে।
ঐতিহ্যগত চীনা স্থাপত্য শৈলীর সঙ্গে ইসলামিক নকশা নীতির একীকরণ একটি অনন্য স্থাপত্যের মিশ্রণ তৈরি করেছে। যা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, সহনশীলতা এবং শৈল্পিক উদ্ভাবনকে বিকশিত করে। এ স্থাপত্য সংমিশ্রণ শুধু সভ্যতার ঐতিহাসিক আন্তঃসম্পর্ককেই জাহির করে না বরং একটি বিশ্বায়িত বিশ্বে সাংস্কৃতিক পার্থক্যের সঙ্গে সদাচার এবং সম্প্রীতি বৃদ্ধির গুরুত্বের স্মারক হিসেবেও কাজ করে।
লেখক : গবেষক আলেম