সম্পদের মোহ শুধু সমাজ আর রাষ্ট্র নয়, ব্যক্তির হৃদয়কেও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। অতিরিক্ত চাই-চাই স্বভাব এবং অসুদোপায়ে হলেও সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার মানসিকতা সুস্থ সমাজ, পরিবেশ এবং শালীন ও সুস্থ ধারায় স্থিতিশীল সভ্যতাকে পঙ্কিল ও অস্থির করে তোলে। সভ্যতাকে সুস্থ ধারায় বহু দূর এগিয়ে নিতে হলে আত্মিক স্থিরতা প্রয়োজন। হৃদয়ের কোমলতা ও নিষ্কলুষতা অতীব জরুরি। যুগে যুগে সম্পদ বা ক্ষমতার লোভ থেকে সৃষ্ট অস্থিরতা মনুষ্য সমাজ ও সভ্যতাকে মলিন করেছে, করেছে ধ্বংস। একথা তো অনস্বীকার্য, জীবন ধারণ ও জীবিকার ব্যবস্থার জন্য অর্থোপার্জন মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উপরন্তু পরিবারের দায়িত্বশীলের জন্য তা আবশ্যকও বটে। তবে এই অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়তের বেশ কিছু নির্দেশনা ও বিধিনিষেধ রয়েছে। এসব নির্দেশনা ও বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে সম্পদ উপার্জনে অন্যায় পথ অবলম্বন করলে, তাতে কোনো ধরনের ঐশী বরকত ও মঙ্গল তো থাকবেই না- বরং উক্ত সম্পদই হয়ে উঠবে নিজ ও পরিবারের অমঙ্গলের কারণ।
অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে শরিয়তের অন্যতম একটি নির্দেশনা হলো, লাগামহীন লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকা। কেননা, অতিরিক্ত লোভলালসা মানুষকে এক পর্যায়ে অন্যায়ভাবে অর্থোপার্জন করা কিংবা অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করার ব্যাপারে উদ্ধুদ্ধ করে। আর মানুষও তখন সম্পদের মোহে অন্ধ হয়ে কোনরকম বাছবিচার না করেই এসব অন্যায় পথে অগ্রসর হয়। বাহ্যত তা অনেক সুখকর মনে হলেও বস্তুত তা মানবজীবনে সুখ সমৃদ্ধির পথে অন্তরায়। মানুষ কখনো কখনো তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ উপলব্ধি না করেই এর অশুভ পরিণাম ভোগ করে।
লাগামহীন লোভলালসার প্রথম ক্ষতি অন্তরের কঠোরতা ও নির্মমতা। সম্পদের প্রতি অতিরিক্ত লোভের কারণে এক পর্যায়ে মানুষের মধ্য হতে মানবিকতা, ভদ্রতা, শালীনতা, ন্যায়পরায়ণতা ও মায়া-মমতা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তখন মানুষ অর্থের ভালোবাসা ও সম্পদের মোহে অন্ধ হয়ে- অন্যের প্রতি নির্মমতা ও অমানবিকতা প্রদর্শন করে। অন্যায়ভাবে জুলুম করে বেড়ায়। অন্যের হক নষ্ট করে। তার অন্তরে দুর্বলের প্রতি কিংবা আত্মীয়স্বজন কারো প্রতিই সামান্যতম মায়া-দয়ার উদ্রেক হয় না। এ সম্পর্কে বান্দাকে সতর্ক করে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, তোমরা এতিমদের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ প্রদর্শন কর না। তোমরা মিসকীনদের খাদ্যদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না। তোমরা উওরাধিকার সম্পদ সম্পূর্ণভাবে গ্রাস কর। বস্তুত তোমরা ধন-সম্পদকে অধিক পরিমাণে ভালোবাস। (সুরা ফজর : ১৭-২০)।
এই আয়াতে উল্লিখিত অন্যায়কর্ম- এতিমের প্রতি কঠোরতা, দরিদ্রদের সহায়তা না করা ও অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে নেয়ার কারণ হিসেবে সম্পদের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তিকে নির্ণয় করা হয়েছে।
হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা অর্থের লোভের ব্যাপারে সাবধান থেকো। কেননা, তোমাদের পূর্ববর্তীরা এই লোভের কারণে ধ্বংস হয়েছে। অর্থলোভ তাদের কৃপণতার প্রতি উদ্ধুদ্ধ করেছে, ফলে তারা কৃপণতা অবলম্বন করেছিল। তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছে, তখন তারা তাই করেছিল। অর্থলোভ তাদের পাপাচারের প্রতি প্ররোচিত করেছে, তখন তারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত হয়েছে। (সুনানে আবু দাউদ : ১৬৯৮)।
আলোচ্য হাদিসেও সম্পদের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তিকে কৃপণতা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ও পাপাচারিতায় লিপ্ত হওয়ার কারণ হিসেবে নির্ণয় করা হয়েছে। অন্য আরেকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কঠোরতা এবং নির্মমতা মূলত ওইসব বেদুইন কৃষকদের মধ্যে (বেশি) পাওয়া যায়, যারা সূর্যের উদয়-অস্ত সর্বদা তাদের উট নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বোখারি : ৩৩০২)। আল্লামা খাত্তাবি (রহ.) বলেন, উক্ত হাদিসে বেদুইন কৃষকদের নিন্দা এজন্য করা হয়েছে যে, এজাতীয় লোকেরা নিজেদের পার্থিব কাজে এমনভাবে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে- পরিণামে তারা দ্বীনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ বেখবর হয়ে যায়। আর পার্থিব বিষয়ে এমন নিমগ্নতা যা মানুষকে আখেরাত ও তার প্রস্তুতির ব্যাপারে উদাসীন করে দেয়- যা মূলত তাদের অন্তরেরের কঠোরতা ও নির্মমতার কারণ।
হজরত মালিক ইবনে দীনার (রহ.) বলেন, দুনিয়াতে মানুষকে প্রদত্ত শাস্তির মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তি হলো, অন্তরের কঠোরতা ও নির্মমতা। আল্লাহতায়ালা যখন কোনো জাতি বা ব্যক্তির উপর রাগান্বিত হন, তখন তিনি তাদের অন্তরকে কঠোর করে দেন। অন্তর থেকে মায়া-মমতা বিলুপ্ত করে দেন। উপরন্তু অন্তরের কঠোরতার কারণে মানুষ থেকে তার প্রদত্ত নেয়ামত ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং তার উপর নানারকম বিপদাপদ আরোপিত হয়। উল্লেখ্য, সম্পদের প্রতি অতিরিক্ত লোভলালসাই মূলত অন্তরে কঠোরতা ও নির্মমতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
লেখক: গবেষক আলেম