মানুষ পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকে না। এই নশ্বর পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকার চেষ্টা করেও কেউ সফল হয় না। আগমন ও বিদায়ের এই সংস্কৃতিকে নিবিড়ভাবে আঁকড়ে রেখে নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত মানুষ এই পৃথিবীর আলো-বাতাস ও প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। আর যখন কোনো ব্যক্তির নির্দিষ্ট সময় ফুরিয়ে আসে, তখন এই পৃথিবীর আলো-বাতাস তাকে নিজস্ব সুযোগ-সুবিধা দিতে অপারগতা স্বীকার করে, ঠিক তখনই সেই ব্যক্তিটি ইহজগৎ ত্যাগ করে পাড়ি জমায় পরপারের দিকে। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, সেখানেই মৃত্যু তোমাদের গ্রাস করবে, যদিও তোমরা সুদৃঢ় কোনো দুর্গেই থাকো না কেন। (সুরা নিসা : ৭৮)।
হ্যাঁ, মৃত্যুর স্বাদ একদিন প্রতিটি প্রাণীকেই আস্বাদন করতে হবে। এটাই অমোঘ সত্য, এটাই নিখিল বিশ্বের চিরন্তন বিধান। তবুও কিছু মানুষের বিদায় হৃদয়ে রক্ত রক্তক্ষরণ ঘটায়। কিছু মানুষের চলে যাওয়া মেনে নেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের উস্তাদ হাফেজ নাজিম উদ্দিন (রহ.) এর বিদায় ঠিক এমনই ছিল। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের আগেই মৃত্যুর থাবা যেন উস্তাদজির জীবন-যাত্রাকে থামিয়ে দিল। তার মৃত্যুসংবাদ শুনে মধ্যরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে ওঠা স্বপ্নচারীর মতোই ছিল সবার অবস্থা।
সেদিন সবার বাকশক্তি থমকে গিয়েছিল, হারিয়ে ফেলেছিল সবাই কথা বলার ভাষাও। সব সময় হাসিমুখে থাকা এ মানুষটার না ফেরার দেশে চলে যাওয়া মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল আমাদেরও। তবুও মেনে নিতে হয় এটাই প্রকৃতির চিরাচরিত নিয়ম। স্রষ্টার বেঁধে দেওয়া নিয়ম। সমাজের বিত্তবান থেকে নিয়ে সব সাধারণ সবার সঙ্গেই তিনি হাসি মুখে মিলিত হতেন। মুচকি হেসে আপন পর সবাইকেই বরণ করে নিতেন। বিনয়ের সর্বোচ্চ মাত্রা প্রদর্শন করে কথা বলতেন, নিজের অবস্থান কাউকেই বুঝতে দিতেন না। রাস্তা পারাপারের সময় যাকেই পেতেন, বাইক দিয়ে আপন গন্তব্যে পৌঁছে দিতেন। তার চারপাশে সারাক্ষণ মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। কেউ হাদিয়া নিয়ে আসতেন, কেউ সাহায্য চাইতেন, কেউ পরামর্শ আবার কেউবা পানি পড়া নিতে আসতেন। এতে হুজুর একটুও বিরক্তিবোধ করতেন না।
রমজান ঘনিয়ে আসলে হুজুরের স্মৃতিগুলো আরো জীবন্ত হয়ে ওঠে, আরো সবুজ আরো সতেজ হয়ে ওঠে। হারিয়ে যাওয়া সেই হাসিমুখটা বড্ড পীড়া দিতে থাকে। কারণ ছাত্র জীবনের দু’একটি রমজান ছাড়া প্রায় প্রতিটি রমজানই বাড়িতে থাকতাম। সেই সুবাদে হুজুরের সান্নিধ্য সোহবতও বেশি পেতাম। হুজুর প্রায়ই আমাদের মসজিদে নামাজ পড়তেন। নামাজে শেষে সবার হাল ফুরসি করতেন, রমজানের অমূল্য সময়গুলোর যথাযথ মূল্যায়নের জন্য দিকনির্দেশনা দিতেন। এমনভাবে তিনি কথা বলতেন, জান্নাত জাহান্নামের বর্ণনা দিতেন যে, সবকিছু তার আলোচনায় জীবন্ত হয়ে উঠত। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় হুজুরের নসীহা শুনত। আর সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করত। হুজুরের খুব কাছে আমাকে বসাতেন, মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিতেন। বাবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকায় আমাকে একটু বেশিই মায়া করতেন।
প্রতি বছরই রমজান আসে, আবার চলেও যায়। কিন্তু এখন আর হুজুরের আলোচনা শোনা হয় না। হয় না কাছ ঘেঁষে বসাও। শোনা হয় না, তার মায়া জড়ানো কণ্ঠস্বর, ‘কেমন আছ বাবা? বাইকে উঠো তোমাকে মাদরাসায় পে*ৗছে দিই, ধরো টাকাগুলো দিয়ে মাদরাসা যাবার পথে ভাড়া দিও। সব সময় মনে রাখবা, জ্ঞানীরা কখনো অহংকার করে না। মানুষের জ্ঞান যতো বাড়ে, ততই তাদের বিনয় বাড়তে থাকে। তাই কখনও অহংকার করো না।’ খুব সুন্দর একটা উদাহরণ দিতেন তিনি ‘দেখো বাবা, পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কেউ যখন নিচে তাকায়, তখন সবকিছুই তার কাছে ছোট ছোট মনে হয়। নিজের দুই চোখ দিয়ে হাজারো মানুষকে সে ছোট করে দেখে। আবার যারা নিচে আছে তারাও তাকে ছোটই দেখে। তবে দুই চোখের পরিবর্তে এক হাজার মানুষের দুই হাজার চোখ তাকে ছোট করে দেখছে। অর্থাৎ অহংকার করে একজন যখন সবাইকে তুচ্ছ মনে করে, তখন এ অহংকারীকেও অন্য সবাই তুচ্ছ মনে করে।’ হুজুরের কথাগুলো আজও কানে বাজে, হুজুরের স্মৃতিগুলো আজও চোখে ভাসে। হৃদয়ের অনুভূতিকে নাড়া দিলেই উস্তাদজিকে পাওয়া যাবে। তার স্নেহ-ছায়ায় আর ভালোবাসায় এতটাই সিক্ত হয়েছি যে, মনে পড়লেই চোখ ভিজে যায়। কান্নায় ভেঙে পড়ি এক অব্যক্ত বেদনায়।
এমন উদারপন্থি, কোরআন প্রেমিক, সৎ, মিতব্যয়ী, সর্বগুণে গুণান্বিত শিক্ষক আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। সবাই তাকে চিনত এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র গড়ার কারিগর হিসেবে। মানুষটি আমাদের অনেক স্খলনের কথা জানতেন, বুঝতেন, তবুও স্নেহ করতেন। বলতে পারেন সাদা রুমাল দিয়ে তিনি আমাদের ঢেকে রাখতেন। যতদিন দুনিয়াতে ছিলেন আমাদের ভালোবেসেছেন এবং আমাদের তারাক্কির ফিকির করেছেন।
তাকে আমার আজও মনে পড়ে, কখনও স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট। পূর্ণিমার চাঁদ যেন ভেসে চলে কখনও মেঘের ফাঁকে ফাঁকে, কখনও মেঘের আড়ালে। তিনি আছেন আমার হৃদভূবণে। নূরে উদ্ভাসিত তার প্রশান্ত মুখখানা ছিল আমাদের জন্য সান্ত¦না। তার মন ভোলানো হাসি ছিল আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
সৎ মানুষের মৃত্যুতে নাকি আকাশ-বাতাস কেঁদে ওঠে! উস্তাদজি মারা যাবার দিনেও গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ আমাদের দিগন্তে এসে ধরা দিয়েছিল। হয়তো আকাশেরও সেদিন মন খারাপ হয়েছিল, মেঘেরাও হয়তো সেদিন চুপিচুপি কেঁদেছিল। বাতাসেরাও হয়তো সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। উস্তাদজির সঙ্গে মৃত্যুর প্রায় ১ মাস আগে দেখা হয়েছিল, যখন তিনি মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। তিনি তার অপূর্ণ স্বপ্নগুলোর কথা আমাকে বলেছেন আর কেঁদেছেন। সাদা কালো কত যে মেঘের আনাগোনা ছিল তার স্বপ্নের আকাশে... এখানে কলমে প্রবল স্রোত ছিল, চাইলে অনেক কিছুই লেখা যেত, কিন্তু কলম ও কলব উভয়টাকে সংযত রাখলাম। কিছু কথা না হয় নিজের কাছে রেখে দিলাম। শুধু বলি, স্বপ্নের যে ব্যথা ও বেদনা আছে, স্বপ্নের যে ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা আছে, স্বপ্ন যে হৃদয়ে কান্নার ঢেউ তোলে এবং চোখ থেকে অশ্রু ঝরায়, সেদিনই তা প্রথম অনুভব করলাম।
নিভৃত পল্লির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি গ্রামের মাটি ও মানুষকে নিয়েই ছিল তার স্বপ্ন। শরীরের ঘাম ঝরিয়ে ভালোবাসার বীজ বপন করে নিজ গ্রামের সেই উর্বর মাটিতে একটা দ্বীনের বাগান গড়ে তুলেছিলেন। সেই বাগানকে ঘিরে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। সেখানে ফুল ধরবে, ফুল কুড়িয়ে তিনি মালা গাঁথবে, কিন্তু ফুল ধরার আগেই মৃত্যুর ভেলা এসে ভিড়ে ছিল তার নদীর ঘাটে। ফলে তার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। মালির সেই অপূর্ণ স্বপ্নগুলোকে বাস্তবতায় রূপ দেবার জন্য বাগানের পরিচর্যার দায়িত্ব নিয়েছেন তার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের সবার শ্রদ্ধার পাত্র প্রিয় আকরাম ভাই। ভাইয়ার রাত দিনের নিরলস প্রচেষ্টা আর পরিচর্যায় সেই বাগানে ফুল ধরেছে। তালিব নামের সেই ফুলগুলোর সৌরভ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের মাধ্যমে দ্বীনপ্রিয় হাজারো মানুষ উপকৃত হচ্ছে। হাজারও পথভোলা পথিক সঠিক পথের উপর উঠে আসছে। পল্লি অবলার সহজ সরল সেই দরদি মালি স্বপ্নের বেদনাকে সঙ্গে নিয়েই মাদরাসার ছায়াঘেরা একটি কবরের নিচে শুয়ে আছে। রব তাকে সবটুকু মায়া-মমতা দিয়ে জড়িয়ে রাখুক, জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করুক- আমিন।
লেখক: তরুণ আলেম