ভয়াবহ ভাইরাসের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া এক অভিশপ্ত সামাজিক ব্যাধির নাম যৌতুক। যা এরই মধ্যে সমাজদেহের ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। এর বিষক্রিয়ায় গোটা সমাজ জর্জরিত হয়েছে। নারী জীবনে এ প্রথা অভিশাপস্বরূপ। প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হচ্ছে যৌতুকের কারণে। অসংখ্য নারীর সুখের সংসার ভেঙে যাচ্ছে যৌতুকের অভিশাপে। পিতৃবিয়োগের পর পৈতৃক সম্পদ ভাই বোনদের, দাদা লোকান্তরে তার ত্যাজ্য সম্পদ বাপ-চাচা ফুফুদের, তাদের ন্যায্য প্রাপ্য হিসেবে দিয়ে দেয়া দূরের কথা, নারীদের প্রাপ্য সম্পদে আজ তাদের কোনো অধিকার আছে বলেও স্বীকার করা হচ্ছে না। ফলে একদিকে যেমন মেয়েরা আল্লাহর বিধানগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে যৌতুকের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছে।
যৌতুক মুশরিক সমাজের প্রথা
যৌতুক উপমহাদেশীয় কুসংস্কারের অংশ। বর্তমানে যৌতুক প্রথার ভয়াবহতা বাড়লেও এর প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই। এর সূচনা মূলত হিন্দু সমাজে হয়েছে। হিন্দু সমাজে নারীরা সম্পদের উত্তরাধিকারী হতো না। তাই তাদের বিয়ের সময় যৌতুক দেয়ার প্রচলন ছিল। কিন্তু ইসলামধর্মে বিধানগতভাবেই নারীরা পৈতৃক সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়, তা সত্ত্বেও কালক্রমে মুসলিম সমাজে এ অভিশপ্ত প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটে। অথচ ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। তার রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি আর স্বকীয়তা। তাই তো ইসলামধর্মে ভিন্ন সংস্কৃতি গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং কঠোর হুঁশিয়ারি বার্তাও প্রদান করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪০৩১)।
যৌতুক নিপীড়নমূলক প্রথা
যৌতুক একটি নিপীড়নমূলক রেওয়াজ। এখানে কনেপক্ষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অন্যায়ভাবে তার পরিবার থেকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আদায় করা হয়। এটা শুধু জুলুম নয়, অনেক বড় জুলুম। আর তা শুধু ব্যক্তির ওপর নয়, গোটা পরিবার ও বংশের ওপর জুলুম। অথচ আল্লাহতায়ালা কাউকে জুলুম করে সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভক্ষণ করো না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৮)। যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজ জীবনে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। দেখা যায়, যৌতুকের অর্থের পরিমাণ সামান্য কম হলেই দরিদ্র পরিবারের মেয়ের ওপর নানা রকম অসহনীয় অত্যাচার ও নির্যাতন করে শ্বশুরবাড়ির লোকরা। মেয়েকে সুখে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আবদার মেটাতে গিয়ে অনেক দরিদ্র মেয়ের বাবাই নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে যায়। যৌতুকের চাহিদা মেটাতে না পেরে অনেক নারীকেই স্বামীগৃহ ত্যাগ করে পিতৃগৃহে ফিরে আসতে হয়। আবার অনেকে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়।
আর্থিক লেনদেনই যৌতুক নয়
সমাজে বিভিন্নভাবে যৌতুকের লেনদেন হয়ে থাকে। কখনও সরাসরি আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে, কখনো বা আসবাবপত্র, বাহন, জমি-জমা, ফ্ল্যাট, বিদেশ পাঠানোর খরচ, ব্যবসার ব্যবস্থা করে দেয়া ইত্যাদি। কিন্তু কিছু মানুষ আর্থিক লেনদেনকেই যৌতুক মনে করেন, আর্থিক লেনদেন ছাড়া অন্যান্য বিষয়কে যৌতুক মনে করেন না; বরং সেগুলোকে নিজেদের এক ধরনের হক ও প্রাপ্য মনে করেন, যদিও তা পূর্বশর্ত, সামাজিক চাপ বা প্রথার কারণে হয়ে থাকে। এটা তাদের নিতান্তই ভুল ধারণা। অথচ কারও স্বপ্রণোদিত ও স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ছাড়া প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষ চাপ প্রয়োগ করে কোনো কিছু গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হারাম। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাবধান! কারও জন্য তার ভাইয়ের কিছুমাত্র সম্পদও বৈধ নয়, যদি তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি না থাকে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৫৪৮৮)।
হারামের ব্যাপারে সতর্কতা
রাসুল (সা.) বলেন, ‘ওই দেহ বেহেশতে যাবে না, যা হারাম থেকে উৎপন্ন হয়েছে। দোজখের আগুনই তার অধিক উপযোগী।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ১৭২৩, ৪৫১৪)। তাই যৌতুক নেয়া কারও সামান্য জিনিস তুলে নেয়ার মতো বিষয় নয়; বরং সরাসরি লুণ্ঠন ও ডাকাতি। পার্থক্য শুধু এই যে, এখানে ছুরি-চাকুর বদলে বাক্যবান ও চাপের অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়। আর অন্যের সম্পদ লুট বা ডাকাতি করা কবিরা গোনাহ। বড় কোনো সম্পদ নয়, যদি জোর করে কেউ কারও একটি ছড়িও নিয়ে যায়, সেটাও লুণ্ঠন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেউ যেন তার ভাইয়ের জিনিস তুলে না নেয়; না ইচ্ছা করে, না ঠাট্টাচ্ছলে। একটি ছড়িও যদি কেউ তুলে নেয়, তা যেন অবশ্যই ফিরিয়ে দেয়া হয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭৯৪০)।
বিয়ে উপার্জনের জন্য নয়
বিয়ে হলো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং একটি পবিত্র বন্ধন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই একে অন্যের কাছে উপকৃত ও পরিতৃপ্ত হওয়ার মাধ্যম। এটি ব্যবসা বা অর্থ উপার্জনের উপায় নয়। তেমনি বর-কনেও ব্যবসার পণ্য নয়, যাদের বিক্রি করে পয়সা কামানো হবে। অতএব, একটি হালাল বন্ধনকে হারাম অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বানানো কোনো সুস্থ বিবেকবান ব্যক্তির কাজ থেকে পারে না। যৌতুক দাবির ফলে দাম্পত্য সম্পর্কের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। পরিবারে শান্তির বদলে অশান্তির আগুন জ্বলতে থাকে। ঝগড়া-বিবাদ, গালিগালাজ এমনকি মারধর পর্যন্ত গড়ায়। অনেক ফ্যামেলি আছে, যারা দিন আনে দিন খায়, অনেক টানাপড়নে সংসার চালায়, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এ রকম ফ্যামেলির অভিভাবকরা মেয়ের যৌতুকের টাকা পরিশোধ করতে করতে একসময় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। তবুও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেদের সর্বোচ্চটা বিলিয়ে দেয়।
উপহার প্রদান
তবে কন্যার বিয়ের সময় বা রুখসতির সময় পিতা নিজ সাধ্য অনুসারে তাকে যে গয়নাগাটি বা সামানপত্র শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উপহার দেয়, তা বৈধ। প্রচলিত যৌতুকের সঙ্গে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। তবে শর্ত হলো, তা হতে হবে কোনো ধরনের সামাজিক চাপ ছাড়া, স্বতঃস্ফূর্ত ও সন্তুষ্ট চিত্তে। রাসুল (সা.)-ও নিজ কন্যা ফাতেমা (রা.)-এর বিয়ের সময় উপঢৌকন হিসেবে একটি পশমণ্ডনির্মিত সাদা রঙের চাদর, একটি ইজখির ঘাস-নির্মিত বালিশ এবং চর্ম নির্মিত পানির মশক দিয়েছিলেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৬৪৩)। তবে উপঢৌকনের ক্ষেত্রে লোকমুখে খ্যাতি বা প্রশংসা কুড়ানোর জন্য অতিরঞ্জন করা মোটেও কাম্য নয়। এ ধরনের প্রতিযোগিতামূলক উপঢৌকন প্রদান ও প্রদর্শন মূলত রিয়া বা লোক দেখানো ও অহংকার প্রকাশের মাধ্যম বৈ অন্য কিছু নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভয় পাই, তা হলো শিরকে আসগর (ছোট শিরক)।’ সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! শিরকে আসগর কী?’ তিনি বললেন, ‘রিয়া বা লোক দেখানো আমল। কেয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের কর্মের প্রতিফল দেয়া হবে, তখন মহান আল্লাহ তাদের বলবেন, তোমরা যাদের দেখাতে, তাদের কাছে যাও। দেখ, তাদের কাছে তোমাদের পুরস্কার পাও কি না!’ (মুসনাদে আহমদ : ৪২৮-৪২৯)।
যৌতুক নেয়ার কারণ ও প্রতিকার
যৌতুক প্রথার সঙ্গে প্রত্যেক্ষ-পরোক্ষভাবে বিভিন্ন কারণ জড়িত। এসব কারণের মধ্যে সামাজিক কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস, সামাজিক প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠা লাভের মোহ, দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, উচ্চাভিলাষী জীবনযাপনের বাসনা, পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের নিম্ন আর্থসামাজিক মর্যাদা ও অসহায়ত্ব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব জাহেলি সংস্কৃতি নির্দিষ্ট কোনো সময় বা স্থানের গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়, বরং তা হচ্ছে হৃদয়, আত্মা, চিন্তা, বুদ্ধি ও জীবনের একটা বিশেষ রূপ ও প্রকৃতি। যা তখনই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যখন মানবজীবনের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত মৌলিক মূল্যবোধগুলোর পতন ঘটে এবং ওইসব কৃত্রিম মূল্যবোধ তার স্থলবর্তী হয়, যার ভিত্তি হচ্ছে লোভণ্ডলালসা, ভোগবাদ ও বস্তুবাদ। ১৪ বছর আগের মতো আজও বিশ্বমানবতার উদ্দেশ্যে মুসলিম উম্মাহর প্রতি একই দাওয়াত, একই পয়গাম (অর্থাৎ ‘হে মানুষ! এক আল্লাহকে বিশ্বাস কর। আল্লাহর রাসুলের নিঃশর্ত অনুসরণ করো। আখেরাত ও বিচার দিবসে বিশ্বাস করো। লোভণ্ডলালসা পরিত্যাগ কর। মানুষের সম্পদ অন্যায় আর অন্যায্যভাবে নিজ আয়ত্তে আনার মানসিকতা পরিহার করো) রয়েছে। তা পালনে সোচ্চার হতে হবে। তবেই এসব অভিশপ্ত অপসংস্কৃতি আর কুসংস্কার সমাজ থেকে চিরতরে বিদায় নেবে। বিশেষভাবে নারীকে পণ্যদ্রব্য হিসেবে বিবেচনা না করে নিজেদের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে সঠিক মর্যাদা দিতে হবে। পুরুষদের অর্থলোভ ত্যাগ করে নারীর গুণ ও গৌরবের তাৎপর্য উপলব্ধি করে সমাজে নারীর শরয়ি প্রাপ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যৌতুক দেয়া ও নেয়াকে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।