অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফিলহাল
আব্দুল্লাহ মাসুম
প্রকাশ : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এতে ধনী-গরিবের মধ্যে বৃহদাকার তফাৎ সৃষ্টি হয়। সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন হয় না। দুঃখজনক হলেও সত্য, পুঁজিবাদে এর কোনো সমাধান নেই। পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, সমাজে বিরাজিত আয়ের এ বিশাল বৈষম্য মূলত প্রকৃতির নিয়ম ও অনিবার্য বিষয়। এমনটা হবেই। তারা দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য সম্পদ ও আয়ের পুনর্বণ্টনের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিকল্প হিসেবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ পেরিটো (Pareto) বলেন, ‘যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে মোট আয়ের বৃদ্ধির হার বেশি না হয়, তবে আয়ের বৈষম্য কমানো সম্ভব নয়।’ (প্রাগুক্ত : ৬৯)। ড. এম উমর চাপরা বলেন, ‘পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক ও রক্ষণশীল শিবিরের অর্থনীতিবিদগণ আয়ের সুষম বণ্টনের পরিবর্তে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন।’ থুরো (Thurow) এ ধরনের চিন্তাকে সংক্ষেপে এভাবে ব্যক্ত করেন, ‘যদি কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়, তবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং সবার জন্য অধিকতর আয়ের পথ সুগম হবে। জনগণ তাদের অধিকতর আয় অর্জনের কারণে বিত্তশীলদের অবস্থার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেই সুখী থাকবে। সমাজ তখন আর ধন বৈষম্য ঘোচানো নিয়ে মাথা ঘামাবে না। শেষ পর্যন্ত অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে আয় বৈষম্যের ফারাক ক্রমেই কমে আসবে।’ (প্রাগুক্ত : ৬৯)।
পর্যালোচনা
প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এর ওপর এতটা গুরুত্বারোপ করা ও একেই একমাত্র সমস্যার সমাধান মনে করাটা সঠিক নয়। কারণ প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির কারণে দরিদ্র শ্রেণির যদিও ভোগের মাত্রা বেড়ে যায়, তবে অভাব দূর হয় না। কারণ এর সঙ্গে সমানভাবে পাল্লা দিয়ে ধনাঢ্য শ্রেণিরও ভোগের মাত্রা বেড়ে যায় নিঃসন্দেহে। ফলে অধিক প্রবৃদ্ধি ধনী-দরিদ্রের ফারাক আরো বাড়িয়ে দেয়। কোলকো (কড়ষশড়)-এর মতে যতদিন আয় বৈষম্য বিরাজ করবে, ততদিন ধনী ও দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে ভোগের বিরাট ব্যবধানও থেকে যাবে। (প্রাগুক্ত : ৭০)। বোঝা গেল, অধিক প্রবৃদ্ধি প্রকৃতপক্ষে বিত্তশ্রেণির আয় ও বিত্তকে আরো ফাঁপিয়ে তোলে। এতে বৈষম্য বৈষম্যের স্থানেই থেকে যায়। যেমন- সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি করা হলো। প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেল। সঙ্গে সঙ্গে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি কোম্পানিগুলো বিনা কারণে তাদের পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে দেয়। ফলে অংকে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় ঠিকই, তবে বাস্তবে সেই আগের অবস্থাই বহাল থাকে। তা ছাড়া প্রবৃদ্ধি কখনও একটানা চলতে থাকে না। মাঝেমধ্যে দেখা দেয় মন্দা ও বেকারত্ব। এটি সবার জন্য ক্ষতিকর হলেও দরিদ্র শ্রেণির জন্য এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক। সুতরাং একতরফা শুধু প্রবৃদ্ধির প্রতি মনোযোগী হওয়া আয়-বৈষম্য হ্রাসের সঠিক কোনো পদ্ধতি নয়।
বাংলাদেশের আয় বৈষম্য চিত্র
বাংলাদেশে এখন যে আয়-বৈষম্য বিরাজ করছে, তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। একদিকে করোনা মহামারি, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি। এ কঠিন সময়ও এমন এমন আইন ও বিধি সরকার প্রণয়ন করছে, যা রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্যকে উৎসাহিত করছে। ২০২১ সালে দেশে শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর আয় মোট জাতীয় আয়ের ৪৪ শতাংশ। একই সময় দেশের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর আয় ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে পিছিয়ে থাকা ৫০ শতাংশ মানুষের আয় ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ শীর্ষ আয়ের মানুষের সঙ্গে নিম্নআয়ের মানুষের আয়ের ব্যবধান যোজন যোজন। ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত। বিপরীতে নিচু তলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মোট আয়ের মাত্র ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। যা দরিদ্রতার পাশাপাশি বাংলাদেশকে একটি অসাম্যের দেশ হিসেবে রূপ দিয়েছে। এমন চিত্র উঠে এসেছে প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের ‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব’ প্রকাশিত অসাম্য প্রতিবেদন ‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২’-এ। যেখানে বাংলাদেশের কোনো র্যাঙ্কিংই করা হয়নি।
দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন। তাতে সমিতির সভাপতি অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত মন্তব্য করেছেন, ‘করোনা মহামারিতে কেউ কেউ কল্পনাতীত ধনী হয়েছেন। একই সময়ে দেশে আয়-বৈষম্য ও সম্পদণ্ডবৈষম্য বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। অন্যদিকে করোনায় নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষ।’ তাই করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ধনীদের সম্পদ গরিবের মধ্যে পুনর্বণ্টনের সুপারিশ করেছেন তিনি। তিনি আরো বলেছেন, ‘করোনার আগে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪০ লাখ। গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৬৬ দিনের টানা বিধিনিষেধের সময় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৬ কোটি ৮০ লাখে ঠেকেছে।’ অর্থাৎ করোনার কারণে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হলে ধনীদের সম্পদ গরিবের মধ্যে পুনর্বণ্টন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে গত বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক কোটিপতি আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন। চলতি বছরের মার্চ শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৪ হাজার ২৭২ জন। ফলে করোনার ১ বছরে দেশে নতুন কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে ১১ হাজার ৬৪৭ জন। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম ৩ মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বেড়েছে ৩৮২ জন। শুধু তাই নয়, ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ। বহুল আলোচিত ওয়েলথ এক্সের হিসাব অনুযায়ী ২০১০-১৯ সময়কালে বাংলাদেশে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। অপরদিকে মহামারির আঘাতে দেশে নতুন করে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হয়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। যা আগের বছরের জুন পর্যন্ত ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে এসব কথা বলা হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানেও আয়-বৈষম্য নিষেধ করা হয়েছে। সংবিধানের ১৯ (২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ সুতরাং রাষ্ট্র যদি বৈষম্য তৈরিতে পৃষ্ঠপোষকতা করে, তবে বিষয়টি শুধু যে নৈতিকভাবেই অগ্রহণযোগ্য, তা নয়; সাংবিধানিকভাবেও অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ পৃষ্ঠপোষকতা হচ্ছে।
চলতি বাজেটে (২০২১-২২) কর্পোরেট কর হ্রাস করা হয়েছে। কিন্তু ভ্যাট ও আয়কর যথারীতি বহাল থেকেছে। আর্থিক প্রণোদনার সিংহভাগ বিত্তবানদের কপালে জুটেছে। এভাবে নানাভাবে অর্থনীতির সেই পুরোনো ও অকার্যকর নীতি ‘ট্রিকল ডাউন থিউরি’ অনুসৃত হচ্ছে। এতে স্পষ্টভাবে বৈষম্য সৃষ্টিতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রতীয়মান হয়। তাই দেশের প্রথম সারির বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান অকপটে মন্তব্য করেছেন, ‘সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে বৈষম্য বেড়ে চলছে।’ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় বৈষম্য এমনিতেই স্বাভাবিক ইস্যু। এর মধ্যে অতিরিক্ত পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে চরম আকার ধারণ করতে বাধ্য।
জিডিপির সংখ্যাভিত্তিক পরিমাণ বেড়েছে। দেশের অর্থনীতির আকার এখন প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। তবে বাস্তবতা হলো, এর প্রকৃত হিসাব মূলত ‘গরুর হিসাব শুধু কাজীর খাতায়, গোয়ালে তেমন গরু নেই’-এর মতো। বিজ্ঞজন মনে করেন, দেশে বৈষম্যের মাত্রা বর্তমানে যে হারে বাড়ছে, তাতে এ থেকে সহসা মুক্তি পাওয়ার হয়তো কোনো উপায় নেই। ক্ষমতা কাঠামোর বর্তমান বিন্যাসের দিকে তাকালে তেমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ সম্পদ বণ্টন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো যারা নিচ্ছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সুবিধাভোগী বিত্তবানদেরই প্রতিনিধি। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এ প্রক্রিয়ায় গৃহীত বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত তাদেরসহ অন্য বিত্তবানের পক্ষে যাচ্ছে। এ ব্যবস্থা না পাল্টালে সম্পদের বিদ্যমান বণ্টন প্রক্রিয়া থেকে ভিন্নতর সিদ্ধান্ত না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
লেখক : সিএসএএ, অ্যাওফি, বাহরাইন
প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আইএফএ কনসালটেন্সি লি.