আবু খুবাইব আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) বলেন, জামাল যুদ্ধের দিন আমার বাবা আমাকে ডাকলেন। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, ‘আজকের দিনে যারা খুন হবে, তারা অত্যাচারী বা অত্যাচারিত হবে। মনে হচ্ছে, আজ আমি অত্যাচারিত হয়ে খুন হব। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় চিন্তা হলো, আমার ঋণ। কেননা, তা আমার কিছু সম্পদ অবশিষ্ট রাখবে। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধ করার পরেও কিছু সম্পদ অবশিষ্ট থেকে যাবে। তুমি আমার সম্পদ বিক্রি করে আমার ঋণ পরিশোধ করে দিও। যদি ঋণ শোধ করার পর কিছু সম্পদ থেকে যায়, তাহলে তার এক-তৃতীয়াংশের এক-তৃতীয়াংশ তোমার ছেলেদের জন্য।’
এভাবে বাবা তার ঋণের ব্যাপারে আমাকে অসিয়ত করতে থাকলেন। বললেন, ‘যদি তুমি ঋণ পরিশোধ করতে অপারগ হও, তাহলে এ ব্যাপারে আমার মওলার সাহায্য নিও।’ আল্লাহর কসম! আমি তার কথার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘আব্বাজান! আপনার মওলা কে?’ বললেন, ‘আল্লাহ।’ আল্লাহর কসম! এরপর আমি তার ঋণের ব্যাপারে যখনই কোনো অসুবিধায় পড়েছি, তখনই বলেছি, হে যুবাইরের মওলা! তুমি তার পক্ষ থেকে তার ঋণ আদায় করে দাও। সুতরাং আল্লাহতায়ালা তা আদায় করে দিয়েছেন।
যে যুদ্ধে আমার বাবা মারা গেলেন, তখন নগদ বলতে একটি দিনার-দিরহামও রেখে যাননি; শুধু জমি-জায়গা রেখে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ‘গাবাহ’ নামক একটি জমি ছিল; মদিনায় ১১টি, বসরায় দুটি, কুফায় একটি এবং মিসরে একটি ঘর ছিল। বাবা এভাবে ঋণী হয়েছিলেন যে, কেউ তার কাছে আমানত রাখার জন্য মাল নিয়ে এলে তিনি বলতেন, ‘আমানত হিসেবে নয়, তা আমার কাছে ঋণ হিসেবে থাকবে। কেননা, আমি তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। আর আমানত নষ্ট হয়ে গেলে তা আদায় করা জরুরি নয়, কিন্তু ঋণ আদায় করা সর্বাবস্থায় জরুরি।’ আমার বাবা কখনও গভর্নর হননি। তিনি ট্যাক্স, খাজনা বা অন্য কোনো অর্থ আদায় করার দায়িত্ব নিতেন না।
একদিন আমি তার ঋণ হিসেব করে সর্বমোট ২২ লাখ পেলাম। এরপর হাকিম ইবনে হিজাম আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, ‘ভাতিজা! আমার ভাই যুবাইরের ওপর কত ঋণ আছে?’ আমি তা গোপন করে বললাম, ‘এক লাখ।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমার মনে হয় না যে, তোমাদের সম্পদ এ ঋণ পরিশোধে যথেষ্ট হবে।’ বললাম, ‘যদি ২২ লাখ হয়?’ তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় না যে, তোমরা তা পরিশোধ করার ক্ষমতা রাখ। তাই বলছি, তোমরা যদি কিছু পরিশোধ করতে অসমর্থ হয়ে পড়, তাহলে আমার সহযোগিতা নিও।’ এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন। আমার বাবা ১ লাখ ৭০ হাজারের বিনিময়ে ‘গাবাহ’ জমিটি কিনেছিলেন। আর আমি সেটি ১৬ লাখের বিনিময়ে বিক্রি করলাম। দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলাম, ‘আমার বাবার ওপর যার যার ঋণ আছে, সে যেন আমার সঙ্গে গাবাহ জমিতে সাক্ষাৎ করে।’ ঘোষণা শুনে আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.) আমার কাছে এলেন। তিনি আমার বাবাকে ৪ লাখ ঋণ দিয়েছিলেন। বললেন, ‘তোমরা যদি চাও, তবে এ ঋণ তোমাদের জন্য মওকুফ করে দেব?’ আমি বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘যদি তোমরা চাও যে, ঋণ এখন আদায় না করে পরে আদায় করবে, তাহলে তাও করতে পার।’ আমি বললাম, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি আমাকে এ জমির এক অংশ দিয়ে দাও।’ আমি বললাম, ‘এখান থেকে ওই স্থান পর্যন্ত আপনার।’
এরপর ওই জমি ও বাড়ির কিছু অংশ বিক্রি করে বাবার ঋণ পরিপূর্ণরূপে পরিশোধ করলাম। আর ওই গাবাহর সাড়ে চার ভাগ বাকি থাকল। এরপর আমি মুআবিয়া (রা.)-এর কাছে এলাম। তখন তার কাছে আমর ইবনে ওসমান, মুনজির ইবনে যুবাইর এবং ইবনে যামআ (রা.) উপস্থিত ছিলেন। মুআবিয়া (রা.) আমাকে বললেন, ‘গাবাহর কত দাম হয়েছে?’ বললাম, ‘ভাগ প্রতি এক লাখ।’ তিনি বললেন, ‘কয়টি ভাগ বাকি রয়েছে?’ বললাম, ‘সাড়ে চার ভাগ।’ মুনজির ইবনে যুবাইর বললেন, ‘এক লাখের বিনিময়ে আমি এক ভাগ নিলাম।’ আমর ইবনে ওসমান বললেন, ‘আমিও এক ভাগ নিলাম।’ ইবনে যামআ বললেন, ‘আমিও এক ভাগ নিলাম।’ অবশেষে মুআবিয়া (রা.) বললেন, ‘আর কত ভাগ বাকি থাকল?’ বললাম, ‘দেড় ভাগ।’ তিনি বললেন, ‘আমি দেড় লাখে তা নিলাম।’ পরবর্তীতে আবদুল্লাহ ইবনে জাফর তার ভাগটি মুআবিয়া (রা.)-এর কাছে ছয় লাখে বিক্রি করে দিলেন।
এরপর আমি যখন আমার বাবার ঋণ পরিশোধ সম্পন্ন করলাম, তখন আমার ভাইয়েরা বলল, ‘এবার তুমি আমাদের মধ্যে আমাদের উত্তরাধিকার বণ্টন করে দাও।’ বললাম, ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের মধ্যে তা বণ্টন করব না, যতক্ষণ না আমি চার বছর হজের মৌসুমে ঘোষণা করব যে, আমার বাবার ওপর যার ঋণ আছে, সে যেন আমার কাছে আসে, আমি তা শোধ করে দেব।’ এরপর আমি প্রত্যেক বছর হজের মৌসুমে ঘোষণা করতে থাকলাম। অবশেষে যখন ৪ বছর পেরুল, তখন তাদের মধ্যে উত্তরাধিকার বণ্টন করে দিলাম। আর এক-তৃতীয়াংশ মাল যাদের দেওয়ার অসিয়ত ছিল, তাদের দিলাম। আমার বাবার চারজন স্ত্রী ছিলেন। প্রত্যেকের ভাগে ১২ লাখ করে পড়ল। তার সর্বমোট পরিত্যক্ত সম্পদ ছিল ৫ কোটি ২ লাখ। (বোখারি : ৩১২৯)।