অবৈধ উপার্জনের পরিণতি
আবদুল কাইয়ুম শেখ
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সৎপথে উপার্জনের জন্য আল্লাহতায়ালা মানুষকে শক্তি-সামর্থ্য, মেধা-বুদ্ধি ও হাত-পা দিয়েছেন। পরিশ্রম করে হালাল পথে জীবিকা নির্বাহের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। হালাল পথের উপার্জনেই রয়েছে সম্মান ও মর্যাদা, আর হারাম পথের উপার্জনে রয়েছে অসম্মান ও অমর্যাদা। হালাল পন্থায় উপার্জন করায় রয়েছে পার্থিব সম্মান ও বন্দনা, অপরদিকে হারাম পন্থায় উপার্জন করায় রয়েছে পরকালীন লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা। কোরআন ও হাদিসে হালাল পন্থায় উপার্জন করার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে হারাম হতে বিরত থাকার জোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হারাম পন্থায় উপার্জন করার কদর্যতা, ভয়াবহতা ও পরিণামের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া জরুরি।
হারাম উপার্জন ঘৃণ্য : হারাম পন্থায় উপার্জন করা ঘৃণ্য, মন্দ ও নিন্দনীয়। হারাম উপায়ে উপার্জনকারী ব্যক্তিরা ঘৃণার্হ, তুচ্ছ, হীন, নিচ ও অধম। হারাম পন্থায় উপার্জন করার কারণে অধিকাংশ সময় অন্যের হক নষ্ট হয়। অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন, হরণ ও আত্মসাৎ করা হয়। অন্যকে ঠকানো হয়। এগুলোর সবই অকল্যাণকর, নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য। হারাম উপায়ে উপার্জনকে নিতান্ত মন্দ কর্ম আখ্যায়িত করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি তাদের অনেককে দেখবেন, দৌড়ে দৌড়ে পাপে, সীমালঙ্ঘনে এবং হারাম পানাহারে পতিত হয়। তারা অত্যন্ত মন্দ কাজ করছে। দরবেশ ও আলেমরা কেন তাদের পাপ কথা বলতে এবং হারাম পানাহার করতে নিষেধ করে না? তারা খুবই মন্দ কাজ করছে।’ (সুরা মায়িদা : ৬২-৬৩)।
সম্পদের হিসাবদান : বহু লোক হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়। বহুবিধ উপায়ে মানুষকে ঠকানোর কারণে রাতারাতি তাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়। আরামণ্ডআয়েশ, ভোগ-বিলাসের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসায়। তবে এসব লোককে মনে রাখতে হবে, এ জীবন শেষ জীবন নয়। এ জীবনের পর অবিনশ্বর অন্য এক জীবন রয়েছে। সম্পদ কোন পথে উপার্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে, তার পুঙ্খানপুঙ্খ হিসাব সেই জীবনে দিতে হবে। সম্পদের যথাযথ হিসাব দেওয়ার আগে কারও পা-চুল পরিমাণ নাড়াতে পারবে না। আবু বারজা আসলামি (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামত দিবসে কোনো বান্দার পদযুগল এতটুকুও সরবে না, যে পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞাসাবাদ না করা হবে- কোথা হতে তার ধন-সম্পদ উপার্জন করেছে ও কোন কোন খাতে ব্যয় করেছে?’ (তিরমিজি : ২৪১৭)।
হারামখোর জাহান্নামে যাবে : হারাম পন্থায় উপার্জিত সম্পদের মাধ্যমে হারামখোর যদিও সাময়িকভাবে সুখী হয়; বাহ্যিক আরামণ্ডআয়েশ ও ভোগ-বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন করতে থাকে। কিন্তু হারাম ভক্ষণ পরকালে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। হারাম খাওয়ার কারণে তাকে নরকের আগুনে প্রজ্জ্বলিত হতে হবে; দোজখের সীমাহীন যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে। হারাম সম্পদের মাধ্যমে দেহের যে অংশটুকু পরিপুষ্ট হয়, তা জাহান্নামে যাবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে দেহের গোশত হারাম মালে গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হারাম মালে গঠিত দেহের জন্য জাহান্নামই সমীচীন।’ (মসনাদে আহমদ)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘এমন দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যাকে হারাম খাবার দ্বারা পরিপুষ্ট করা হয়েছে।’ (সহিহ তারগিব : ১৭৩০)।
হারামখোর জান্নাতে যাবে না : হারাম পন্থায় যারা উপার্জন করে, তারা অনেক সময়ই অন্যের অধিকার নষ্ট করে। এ ক্ষেত্রে তারা কসম খেতেও দ্বিধাবোধ করে না। অথচ কসমের মাধ্যমে যদি কোনো ব্যক্তি কারও হক নষ্ট করে, তাহলে তার জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব এবং জান্নাত হারাম হয়ে যায়। তাই অন্যের হক নষ্ট করার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া নিতান্ত জরুরি। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কসমের মাধ্যমে কোনো মুসলমানের হক নষ্ট করে, তার জন্য আল্লাহ জাহান্নাম ওয়াজিব করে রেখেছেন এবং জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন।’ তখন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! অতি সামান্য বস্তু হলেও?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘বাবলা গাছের মতো এক ধরনের কাঁটাযুক্ত গাছের ডাল হলেও এ শাস্তি দেওয়া হবে।’ (মুসলিম : ২৫০)।
ধোঁকাবাজ পরিত্যাজ্য : হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জনকারী ব্যক্তিরা অনেক সময়ই ধোঁকাবাজি, ধাপ্পাবাজি ও কপটতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। প্রতারণা, শঠতা ও কূটকৌশলের মাধ্যমে মানুষকে ঠকানোর কাজ আঞ্জাম দেয়। এসব লোক নামে মুসলমান হলেও তাদের কাজ অমুসলিমদের মতো। প্রতারক ও প্রবঞ্চক লোকদের সঙ্গে মহানবী (সা.) নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) খাদ্য শস্যের একটি স্তূপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি স্তূপের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। ফলে হাতের আঙুলগুলো ভিজে গেল। তিনি বললেন, ‘হে স্তূপের মালিক! এ কী ব্যাপার?’ লোকটি বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টির পানি লেগেছে।’ তিনি বললেন, ‘সেগুলো তুমি স্তূপের ওপরে রাখলে না কেন? তাহলে লোকরা দেখে নিতে পারত। জেনে রাখ, যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজি করে, আমার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।’ (মুসলিম : ১৮৫)।
মিথ্যায় বরকত নষ্ট : ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে খুব কম ব্যবসায়ীই এমন আছে, যারা মিথ্যা কথা বলে না; কম দামি জিনিসকে বেশি দামি বলে চালিয়ে দেয় না। মানসম্পন্ন নয়, এমন জিনিসকেও তারা মানসম্পন্ন বলে আখ্যায়িত করে। ক্রেতা কোনো দাম বললে ব্যবসায়ীরা অনেক সময় বলে, ‘এই দামে আমি কিনতেও পারিনি।’ এ জাতীয় মিথ্যা বলে তারা অধিক মুনাফা অর্জন করতে চায়। কিন্তু ব্যবসা করতে গিয়ে মিথ্যা বলা হলে বরকত নষ্ট হয়ে যায়। তাই ব্যবসায়ী সমাজের জন্য সমীচীন হলো, ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার মিথ্যা কথা বর্জন করে চলা। মহানবী (সা.) বলেন, ‘ক্রেতা-বিক্রেতা একে অপর হতে বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের উভয়ের ইচ্ছাধিকার থাকবে। যদি তারা উভয়ে সত্য কথা বলে ও পণ্যের দোষ-ত্রুটি যথাযথ বর্ণনা করে, তবে তাদের কেনাবেচায় বরকত হবে; আর যদি মিথ্যা বলে ও ত্রুটি গোপন করে, তবে তাদের কেনাবেচার বরকত নষ্ট হয়ে যাবে।’ (বোখারি : ২১১০)। তাই ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মঙ্গল বিবেচনায় হালাল পথে উপার্জনে মনোনিবেশ করা প্রতিটি দায়িত্বশীল ব্যক্তির কর্তব্য।