ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলায় ওয়াকফের ইতিকথা

লুকমান হাসান
বাংলায় ওয়াকফের ইতিকথা

ইসলামের শুরু যুগ থেকে শিক্ষাব্যবস্থা মসজিদ কেন্দ্রিক চলে আসছে। মসজিদ থেকে আলাদা করে শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র মাদ্রাসা-ভবন নির্মাণের ধারা শুরু হয় হিজরি চতুর্থ শতাব্দীতে। বাংলাদেশেও যখন ইসলামের আলো পৌঁছে, তাও ছিল মসজিদ কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা কবে সূচিত হয়, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে প্রতীয়মান, প্রথম হিজরি শতাব্দীতেই শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশ তথ্য বাতায়নের তথ্য অনুযায়ী অতিসম্প্রতি লালমনিরহাট জেলায় একটি প্রাচীন মসজিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। তাতে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। যাতে স্পষ্টাক্ষরে আরবিতে খোদাই রয়েছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, হিজরি ৬৯’। বর্তমান রংপুরে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় হিজরি তৃতীয় শতকের শেষের দিকে নির্মিত একটি রিবা মসজিদ ও তৎসংলগ্ন ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। গবেষকগণ অনুমান করছেন, সম্ভত এখানে বিরাট আকারে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। যাতে অসংখ্য শিক্ষার্থী লেখাপড়া করত। তা ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে আরব বণিকগণ নিজেদের বসতি গড়ে তুলেছিলেন। তাতে তারা নিজেদের প্রয়োজনে মসজিদ গড়ে তুলেছিলেন। সেসব মসজিদে ব্যাপক হারে ধর্মীয় শিক্ষা চর্চা হতো। ৪০০ হিজরির আগে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে হাওকাল (রহ.) মসজিদভিত্তিক এ শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপকতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘যেকোনো মসজিদে গেলেই ছাত্রদের শোরগোল শোনা যায়। দলে দলে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা পরিলক্ষিত হয়।’ (হাদিস অধ্যয়নের মূলনীতি : ৪৭৭)। মোগল আমলে ভারতবর্ষের প্রতিটি নগরে-গঞ্জে হাজার হাজার মাদ্রাসা ছিল। ১৯২২ সালে মিসর থেকে প্রকাশিত ‘সুবহুল আশা’ গ্রন্থের বর্ণনানুসারে রাজধানী দিল্লিতেই এক হাজার মাদ্রাসা ছিল। প্রফেসর মার্কমিলসের বর্ণনানুসারে ব্রিটিশ শাসনের আগে শুধু বাংলাদেশেই ছিল ৮০ হাজার মাদ্রাসা। (দেওবন্দ আন্দোলন : ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান : ১৫৮)।

সোনারগাঁয়ে উপমহাদেশের প্রথম হাদিসের পাঠশালা : শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.) নামের বিখ্যাত একজন হাদিস বিশারদ ও ফকিহ বাংলার সোনারগাঁয়ে আগমন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ইয়ামেনের অধিবাসী। আনুমানিক ১২৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দিল্লিতে আগমন করেন। তখন ছিল গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমল। গিয়াসউদ্দিন বলবন তখন আবু তাওয়ামাকে অনুরোধ করে বাংলায় পাঠিয়ে দেন। তিনি বাংলায় এসে সোনারগাঁয়ে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এটাই হলো উপমহাদেশে ইলমে হাদিসের প্রথম দিককার শিক্ষাকেন্দ্র। যার অবস্থান প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ অন্তর্গত মোগড়াপাড়া গ্রামে। ধারণা করা হয়, তখন ওই মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর ইলমে দ্বীনের খেদমত করার পর ১৩০০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। যতদূর জানা যায়, তার মৃত্যুর পর মাদ্রাসাটি বেশি দিন স্থায়িত্ব পায়নি। ইতিহাসখ্যাত পর্যাটক ও দার্শনিক শায়খ ইবনে বতুতা (রহ.) ছিলেন মরক্কোর অধিবাসী। বাংলায় তিনি আগমন করেন ১৩৪৫ সালে। বাংলায় তখন ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের রাজত্ব ছিল। ইবনে বতুতা তার বিখ্যাত গ্রন্থে এ মাদ্রাসাটির মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। (নুজহাতুল খাওয়াতির : ১/১০২)।

বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে ধ্বংস করা হয় : ইংরেজরা বাংলার শাসনভার গ্রহণ করার পর লক্ষ্য করল, সমগ্র দেশের সিকির ভাগই রাষ্ট্র থেকে ওয়াকফের খাতে চলে গেছে। তখন তারা মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো দীর্ঘ ১৮ বছরের প্রচেষ্টায় আত্মসাৎ করল। তাদের অন্যায় আত্মসাতের পরের চিত্র একটি প্রতিবেদন থেকে সামান্য স্পষ্ট হয়। স্যার ইউলিয়াম হান্টার লিখেছেন, ‘১৮২৮ সালে (বাজেয়াপ্তের জন্য) শাসন বিভাগ ও ব্যবস্থা পরিষদ একযোগে একটা জোরালো পন্থা অবলম্বন করতে অগ্রসর হলো। এ জন্য বিশেষ আদালত বসানো হলো। তারপর পুরো ১৮ বছর ধরে গোটা প্রদেশ সংবাদদাতা, মিথ্যুক সাক্ষী এবং নির্দয় ও কঠোর বাজেয়াপ্তি কর্মচারিতে ভরে গেল। ফলে শত শত মুসলিম পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের শিক্ষাপ্রণালি (যা এতদিন তাদের লাখেরাজ ওয়াকফের জমি-জমার ওপর নির্ভরশীল ছিল) মারাত্মক আঘাত পেল। আলেমসমাজ প্রায় ১৮ বছরের হয়রানির পর একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল। বাজেয়াপ্তিকরণের সময় থেকে মুসলিম শিক্ষাপ্রণালির অবসানও সূচিত হলো। এ সত্যটা স্বীকার না করার কোনো মানে হয় না, মুসলমানরা বিশ্বাস করে, আমরা যদি এ উদ্দেশ্যে আমাদের ওপর ভারার্পিত সম্পত্তিগুলোকে সাধুতার সঙ্গে কাজে লাগাতাম, তাহলে এ সময় বাংলাদেশে আমরা সবচেয়ে মহৎ ও কার্যকরী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকারী থাকতাম।’ (দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস : ১২২-১২৪)।

ওয়াকফ ব্যবস্থার ব্যাপকতার ফলে তৎকালীন ইউরোপের বহু দেশের চেয়ে বাংলা অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতি ছিল সর্বোচ্চ। বাংলা উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে বখতিয়ার খিলজীর গৌড় জয়ের পরে ও দিল্লি সালতানাত আমলে অত্র অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পরে। ইউরোপবাসীরা শাহী বাংলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী বাণিজ্য দেশ হিসেবে গণ্য করত। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী মোগল আমলে বিশ্বের মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশ উৎপন্ন হতো সুবাহ বাংলায়। যা সে সময় সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের জিডিপির চেয়ে বেশি ছিল। হুগলির ওয়াকফ : ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান ভারতের সৈয়দপুর জেলার হুগলী শহরে হাজী মুহাম্মদ মহসিন মৃত্যুর আগে তার বিশাল ভূসম্পত্তি ওয়াকফ করেন। ইংরেজ সরকার ১৮১৬ সালে একটি অন্যায় অজুহাতে তা দখল করে নেয়। ১৮১৭ সালে সরকার তা ইজারা দিয়ে ইজাদারদের কাছ থেকে ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা আদায় করেছিল। তা ছাড়া বার্ষিক আদায় থেকেও প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা জমা হয়েছিল। উক্ত ওয়াকফ সম্পত্তি সম্পর্কে ইউলিয়াম হান্টার লিখেছেন, ‘এই ওয়াকফ করা হয়েছিল ধর্মীয় কাজের জন্য। ওয়াকফনামায় এসব কাজের বিশদ বর্ণনা রয়েছে। যেমন- কতগুলো ধর্মীয় অনুষ্ঠান-উৎসব পালন করা, হুগলীর সুবৃহৎ মসজিদ বা ইমামবাড়ি মেরামত করা, একটি কবরগাহের রক্ষণাবেক্ষণ করা, কতগুলো মাসোহারা দেওয়া এবং বহুবিধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পালন করা। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অসিয়তের কাজের তালিকায় পড়ে। কিন্তু সেটা হতে হবে মুসলমানদের ইচ্ছানুযায়ী এবং ঠিক যেমন খোদ ওয়াকফকারী অনুমোদন করতেন। গরিব ছাত্রদের জন্য একটি মাদ্রাসা স্থাপন মুসলিমণ্ডঅধ্যুষিত দেশগুলোতে চিরকালই ধর্মীয় কাজ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।’ (প্রাগুক্ত : ১২৪, বাংলা পিডিয়া : ২/৯৬)। বর্তমান ওয়াকফের হালচাল : ২০১৪ সালে ধর্ম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ে নিবন্ধিত থাকা সম্পত্তির মধ্যে ৮৫ হাজার ৫৭২ একর ভূমি হাতছাড়া হওয়ার একটি হিসেব এক প্রতিবেদনে দাখিল করা হয়। কোনো জমি উদ্ধার হওয়ার খবর পরবর্তীতে জানা যায়নি। দেশে ওয়াকফ সম্পত্তির মোট পরিমাণ সম্পর্কেও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। বিভিন্ন বেসরকারি হিসেবে যত সংখ্যক ওয়াকফ এস্টেট ও ভূসম্পত্তির কথা জানা যায়, তার আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশের কম সরকারি ওয়াকফ প্রশাসকের অফিসে নিবন্ধিত আছে। হালনাগাদ তথ্য অনুসারে বর্তমানে নিবন্ধিত এস্টেট সারা দেশে ২১ হাজার ৯৩৯টি। এগুলোর অধীনে জমি আছে ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৭১ দশমিক ৭৪ একর। অন্যান্য সূত্র মনে করে, দেশে ৯ লাখ একরের মতো ওয়াকফ জমি আছে। বর্তমানে (২০১৭-এর তথ্য অনুযায়ী) ঢাকাসহ সারা দেশে ওয়াকফ প্রশাসনের মোট জনবল ১১১ জন। ৬৪ জেলার মধ্যে অফিস আছে ৩৮ জেলায়। জনবল সংকট নিরসনে ১ হাজার ৪৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি প্রস্তাব বেশ আগে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ খাতের সম্পত্তি থেকে জনকল্যাণের কাজ সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনার জন্য ব্রিটিশ আমলে প্রথম ১৯৩৪ সালে বেঙ্গল ওয়াকফ অ্যাক্ট পাস হয়। পরে পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ২০১৩ সালে সংশোধিত আইন হয়। কিন্তু আইনের দুর্বলতা, সরকারি প্রশাসনের দুর্বলতাণ্ডদুর্নীতি, দৃঢ় ব্যবস্থাপনার অভাব প্রভৃতির সুযোগে মূল ওয়াকিফ দাতার মৃত্যুর পর তার ওয়ারিশ হিসেবে ভুয়া নামে অথবা ওয়ারিশদের প্রভাবিত করে কিছু লোক ওয়াকফ সম্পত্তি কেনাবেচা বা দখল করছে বলে সূত্রগুলো জানায়। নিয়মিত আয়ও আত্মসাৎ হয়। এসব আলোচনা দ্বারা বোঝা যায়, একসময় ওয়াকফের ওসিলায় বাংলা ছিল বিশ্বের মধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থবিত্তের দিক থেকে উন্নত দেশ। কিন্তু ব্রিটিশদের চক্রান্তে তা অবহেলিত একটি ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে। আফসোস, অবহেলার সেই ধারা আজও বহাল।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত