ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

উপার্জনে নির্দেশনা

আবদুল আউওয়াল
উপার্জনে নির্দেশনা

দুনিয়ায় চলতে ফিরতে ধন-সম্পদের প্রয়োজন আছে। ইসলাম সে প্রয়োজনের কথা শুধু স্বীকারই করে না, বরং এর জন্য মন-মেধা, কায়িক শ্রমণ্ডদক্ষতা ও পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করে উপার্জন ও অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। স্ত্রী-সন্তান, উপার্জনে অক্ষম মা-বাবা, ভাইবোন ও নিকটাত্মীয়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্বভার প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। বৈরাগ্যবাদের ব্যাপারে কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে। সুতরাং সম্পদ উপার্জনের বিকল্প নেই। ফরজ ইবাদতগুলো পালনের পর সম্পদ উপার্জন-অনুসন্ধানও একটি আবশ্যিক দায়িত্ব। কিন্তু এ সম্পদ উপার্জনে ইসলাম কিছু মৌলিক দিকনির্দেশনা দিয়েছে; যা অনুসরণ করে সম্পদ উপার্জন করলে একজন মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হতে পারবে। সেসব নির্দেশনা হলো-

বিশ্বাস ঠিক রাখা : সম্পদের প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ। আমরা শুধু আহরণকারী। সাময়িক ভোগ-বিলাসের ক্ষমতা রাখি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ? যেসব কৃষিজাত পণ্য তোমরা উৎপন্ন কর, তা তোমরা অঙ্কুরিত কর নাকি আমি করি?’ (সুরা ওয়াকিয়া : ৬৩-৬৪)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তারা কি দেখছে না, আমার সৃষ্ট প্রাণীদের মধ্যে কিছু চতুষ্পদ প্রাণীও আমি তাদের জন্য সৃষ্টি করেছি। ফলে তারা এর মালিক বনে গেছে!’ (সুরা ইয়াসিন : ৭১)। তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, এরপর সেই পানি দ্বারা আমি বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি। তোমরা তা থেকে ভক্ষণ কর এবং প্রাণীদের চরাও।’ (সুরা তহা : ৫৩)। সুতরাং স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, আসলে সম্পদের প্রকৃত মালিক কে! এ বিশ্বাস অন্তরে বদ্ধমূল থাকলে সম্পদ উপার্জিত হলে নানা অন্যায়-অপরাধ থেকে বাঁচা সম্ভব হবে। নইলে অভিশপ্ত কারুনের মতো নিজেকেই সম্পদের প্রকৃত মালিক ভেবে কৃপণ স্বেচ্ছাচারী ও দাম্ভিক হয়ে উঠবে। কারুনকে যখন হজরত মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায়ের লোকেরা দান-খয়রাতের কথা বলতেন, তখন সে বলত, ‘আমি তো এ ধনভাণ্ডার প্রাপ্ত হয়েছি আমার জ্ঞানের বলে।’ (সুরা কাসাস : ৭৭-৭৮)। হজরত শোয়াইব (আ.) যখন তার জাতিকে সম্পদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ভয় দেখাতেন, তখন তারা বলত, ‘হে শোয়াইব, তোমার সালাত কি এ নির্দেশ করে যে, আমরা সম্পদের যথেচ্ছা ব্যবহার ছেড়ে দিই?’ (সুরা হুদ : ৮৭)।

আল্লাহর হুকুম জেনে উপার্জন করা : জীবন ধারণের জন্য সম্পদ প্রয়োজন। এ সম্পদ আল্লাহতায়ালা প্রকৃতিতে রেখে দিয়েছেন। মানুষের দায়িত্ব তার শ্রম, মেধা ও যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে সে সম্পদ আহরণ করে নেয়া। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর ওপর ভরসা করে হাত গুটিয়ে বসে থেকে বলবে, ‘তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ’ মানে আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করলাম। তিনিই মুখে রিজিক তুলে দেবেন বা ঘরে পৌঁছে দেবেন, তা হবে না। বরং রিজিক খুঁজে নিতে হবে। এটাই আল্লাহর নির্দেশ। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘যখন সালাত শেষ হবে, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়। আর আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর; যাতে সফল হতে পার।’ (সুরা জুমা : ১০)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হালাল রিজিক অনুসন্ধান করা ইসলামের মৌলিক ফরজগুলোর পর অন্যতম ফরজ।’ (কানযুল উম্মাল : ৯২৩১)। সুতরাং একজন মানুষ যখন কর্মক্ষেত্রে যাবে বা কাজের উদ্দেশ্যে বেরুবে, তখন তার মাথায় এ বিষয়টি ভালোভাবে গেঁথে নিতে হবে যে, আমি আমার রবের বিধান পালন করার জন্য বেরিয়েছি। তখন ব্যক্তির মধ্যে দায়িত্ববোধ ও কাজের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে। আলস্যভাব তার থেকে দূর হবে। সর্বোপরি ইবাদতের সওয়াব মিলবে।

পরকাল না ভোলা : দুনিয়ার জীবনই শেষ জীবন নয়। এ জীবনের পর আরও একটি জীবন আছে। সেটি হবে অনন্তকালের জীবন। সে জীবনের সফলতাই প্রকৃত সফলতা। আর সে জীবনের বিফলতাই প্রকৃত বিফলতা। সে জীবনের ভোগ-বিলাস হবে চিরস্থায়ী। আর এ জীবনের ভোগ-বিলাস হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং দুনিয়ার সম্পদ উপার্জন করতে গিয়ে সে জীবনের কথা ভোলা যাবে না। এমনটি অবশ্যই নিন্দনীয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। আর যারা এরূপ করবে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা মোনাফিকুন : ৯)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। এমনকি (এ অবস্থায়) তোমরা কবরে উপস্থিত হও। এটা ঠিক নয় (এর পরিণতি সম্পর্কে) অচিরেই তোমরা জানতে পারবে।’ (সুরা তাকাসুর : ১-৩)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ, অথচ পরকালের জীবন সর্বোত্তম ও স্থায়ী।’ ( সুরা আলা : ১৬-১৭)। দুনিয়ার জীবন নিয়ে যারা আহ্লাদিত, তাদের সম্পর্কে বলেন, ‘তোমরা কি দুনিয়ার জীবন (ও এর ভোগ্যসমাগ্রী) নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ দুনিয়ার ভোগ্যসামগ্রী আখেরাতের তুলনায় অতি নগণ্য!’ (সুরা তওবা : ৩৮)। দুনিয়ার জীবনের অস্থায়িত্ব বোঝাতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দুনিয়ার জীবনের উপমা তো এমন যে, আমি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি, এরপর তা দ্বারা উদ্ভিদরাজি উদ্গত হয়; যা থেকে মানুষ ও জীবজন্তু আহার করে। অতঃপর যখন ভূমি সুশোভিত হয় এবং নয়ন ভোলানো রূপ ধারণ করে ও এর অধিকারীরা মনে করে যে, এসব তাদের আয়ত্বাধীন, তখন আমার (গজবের) নির্দেশ দিনে কিংবা রাতে (তাদের কাছে) এসে উপস্থিত হয়। অতঃপর আমি এগুলোকে এমনভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিই, যেন এর আগে এগুলোর কোনো অস্তিত্বই ছিল না।’ (সুরা ইউনুস : ২৪)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া তো এমন, যেন তোমাদের কেউ সমুদ্রে তার আঙুল ডুবিয়ে সামান্য পানি আনল।’ (মুসলিম : ২৮৫৮)। সুতরাং দুনিয়ার সম্পদ উপার্জন করতে গিয়ে পরকাল ভোলা যাবে না। এটা মোনাফেক ও কাফেরের খাসলাত। সে দুনিয়ার জীবনকেই একমাত্র জীবন মনে করে। আর এ কারণেই দুনিয়ার সম্পদের প্রতি তার লোভ অতিমাত্রায় হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সে (কাফের) সম্পদের ভালোবাসায় অতিশয় নিমজ্জিত।’ (সুরা আদিয়াত : ৮)।

বৈধ পন্থায় উপার্জন করা : সম্পদ উপার্জনে খুব গভীরভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তা বৈধ পথে উপার্জিত হচ্ছে নাকি অবৈধ পথে! হালাল বস্তু উপার্জন করা হচ্ছে নাকি হারাম বস্তু! এটি পবিত্র না অপত্রিত! কারণ, যে সম্পদ ভোগ-ব্যবহার করে ইবাদত-বন্দেগি করা হবে, তা আল্লাহর কাছে কবুল হওযার জন্য বিশুদ্ধ ও পবিত্র হওয়া শর্ত। তাই ইসলাম এ বিষয়টির প্রতি কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। সুদণ্ডঘুষ, চুরি-ডাকাতি, পতিতাবৃত্তি, জবরদখল, জুয়া, ধোঁকাবাজি, ঠকবাজি ইত্যাদি পন্থা অবলম্বন করে অর্জিত সম্পদকে হারাম ঘোষণা করেছে। সৎপথে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও চাকরি-বাকরি করে জীবিকা নির্বাহের তাগিদ দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের যে জীবনোপকরণ দিয়েছেন, তা থেকে যা বৈধ ও পবিত্র, তা আহার কর। আর আল্লাহর শোকর আদায় কর, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদতকারী হও।’ (সুরা নাহল : ১১৪)। এ নির্দেশ শুধু সাধারণ মানুষের জন্য নয়; বরং নবী-রাসুলদের প্রতিও ছিল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর এবং নেক কাজ কর।’ (সুরা মোমিনুন : ৫১)। নবীজি (সা.) বলেন, ‘ওই গোশত (শরীর) জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যা হারাম (খাবার) থেকে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর যোগ্য স্থান।’ (তিরমিজি : ৬১৪)। অপর এক হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন কোনো মানুষ নিজের স্থান থেকে এক বিন্দু পরিমাণ সরতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে চারটি প্রশ্নের জবাব দিতে না পারবে। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন হলো, ধন-সম্পদ সে কোত্থেকে উপার্জন করেছে, আর কোথায় ব্যয় করেছে?’ (তিরমিজি : ২৪১৭)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত