বিশ্বনবীর বিশ্বশান্তির মিশন
গোলাম রাজ্জাক কাসেমী
প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসুল। তোমাদের যে কোনো দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মোমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।’ (সুরা তওবা : ১২৮)। তিনি মুহাম্মদ (সা.)। বিশ্ব মানবতার এক মহান আলোকবর্তিকা। আকাশ থেকে নেমে আসা শান্তির পায়রা। তার আগমনে ভেঙেছে বর্বরতার ঘোর। রেঙেছে সভ্যতার ভোর। মুক্তির আনন্দে হেসে উঠেছে নিখিল বিশ্ব। আলোকিত হয় জগৎসংসার। তিনি আঁধারে নিমজ্জিত মানবতার আকাশে রাতের চাঁদ, দিনের সূর্য। তিনি দয়ার পরশ, রহমতের শবনম। যার শানে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা এসেছে, ‘হে নবী! আমি আপনাকে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)। মানবতার ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত রাসুল (সা.)-এর মতো মানবদরদী আর নেই। মানব সভ্যতার প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছেন তিনি। নবুওয়ত পরবর্তী মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধানে পৃথিবীজুড়ে যে শান্তির মিশন বাস্তবায়ন করেছেন, তার দৃষ্টান্ত বিরল। তার ছিল না অর্থ-ঐশ্বর্য কাড়ি-কাড়ি। ছিল না ক্ষমতার দাপট। পৃথিবী তখন নিকষ আঁধারে নিমজ্জিত। জাহেলিয়াতের অন্ধকারে মানুষ জ্ঞানশূন্য। যারা পশুর চেয়েও নিচে নেমে গিয়েছিল। মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। মানবতার সেই কঠিন সংকটপূর্ণ মুহূর্তে মাত্র গুটিকয়েক অনুসারী নিয়ে আরবের ক্ষুধা-অনাহারে জর্জরিত, বর্বরতা ও মূর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে সুখণ্ডসমৃদ্ধি, মর্যাদা ও গৌরবের সোনালি মানুষে রূপান্তর করেছেন। অথচ আজ পৃথিবীতে মুসলমানদের সংখ্যা কোটি কোটি। তাদের আছে ধন-সম্পদ কাড়ি-কাড়ি। নেই কোনো অভাব-অনটন। আধুনিকতার ছোঁয়ায় তারা এখন আকাশে ভাসছে। তবু সুখণ্ডশান্তি যেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আমাদের হারিরে যাওয়া শান্তি-সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে এবং প্রাণহীন সভ্যতাকে প্রাণবন্ত করতে রাসুল (সা.)-এর চিন্তা-চেতনাকে লালন করতে হবে। তার আদর্শকে বুকে ধারণ করতে হবে। যিনি অন্তরের স্বচ্ছতা, আত্মার মহত্ত্ব, ধৈর্য, সহনশীলতা, সততা, বিনম্রতা, বদান্যতা, বিশ্বস্ততা সুরুচিপূর্ণ মনোভাব, ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতাসহ সর্বোত্তম চরিত্রের প্রবাদ পুরুষ ছিলেন। যিনি ছিলেন একাধারে স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহশীল, ছিলেন বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সমাজ সংস্কারক, সাহসী যোদ্ধা, ন্যায়বিচারক, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক এবং সফল ধর্মপ্রচারক। মোটকথা, কল্যাণকর প্রতিটি কাজেই রাসুল (সা.) ছিলেন সর্বোত্তম আদর্শ ও পথিকৃৎ। তার অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহজাব : ২১)।
১৯৭৮ সালে মাইকেল এইচ হার্ট The Hundred নামের একটি বই প্রকাশ করেন। এ বইয়ে যুগ-যুগান্তের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ১০০ জন ব্যক্তির জীবনী উল্লেখ করেছেন। তিনি ইতিহাস অনুসন্ধান করে সেসব ব্যক্তির জীবনী এ গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন, যারা বিশ্বের মানবজাতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। এ গ্রন্থে আইজ্যাক নিউটন, অ্যারিস্টটল, গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, যিশু, হিটলার, প্লেটো এবং মহাত্মা গান্ধীসহ বিশ্বের বরিত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করেছেন। এ বিখ্যাত গ্রন্থে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে মূল্যায়ন করে যে স্থানটি নির্ধারণ করেছে, তার মধ্যে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্থান সর্বপ্রথম। একজন অমুসলিম গবেষকের নিরপেক্ষ গবেষণায়ও নবী মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। মাইকেল এইচ হার্ট নিজের বক্তব্যের দৃঢ়তা প্রদর্শন করে বলেছেন, ‘আমি একজন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী হয়েও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রথম স্থানে রাখায় হয়তো অনেকেই চমকে যাবেন, বাস্তবেই এমনটি হওয়ার কথা। কিন্তু সত্যি বলতে, তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দ্বীন ও দুনিয়া উভয় ক্ষেত্রে সফলতার আকাশ ছুঁয়েছেন। তিনি এমন এক সময় পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যখন আরবের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় ঠেকেছিল। তিনি সেই প্রতিকূলের মধ্যে একজন রাজনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় সফল নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ইসলামের শান্তির মিশন বাস্তবায়ন করে এক বিশাল রাজত্ব গড়ে তোলেন। ইসলামকে বিশ্বের বুকে একটি শান্তির ধর্মরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। যার দাপট আজ পর্যন্ত দুনিয়াজুড়ে বিরাজমান।’ রাসুল (সা.)-এর মহত্ত্ব অনুভব করতে সেই বিস্ময়কর সমাজ সংস্কার আন্দোলন উল্লেখ করাই যথেষ্ট, যা আরব ভূখণ্ডের চেহারা পরিবর্তন করে দিয়েছে। আরব জাতিকে অজ্ঞতার অভিশাপ ও মূর্তিপূজার দুর্ভাগ্য থেকে বের করেছেন। যারা ছিল ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত, বহুরূপী মূর্খতায় দিকভ্রান্ত এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। নবুওয়তের পূর্বাপর ইতিহাস পড়লে যে কেউ চমকে যাবে এবং থমকে দাঁড়াবে, সেখানে মানুষ হতাশায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, ফেতনার নষ্ট পথে বিচরণ করছিল, প্রবৃত্তি তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে, দাম্ভিকতায় তাদের পা আকাশে চড়ে, তাদের বর্বরতা ও ভ্রষ্টতা দেখে শয়তানও লজ্জা পেত। বিশ্বনবীর আগমনের আগে তাদের হিংস্রতা, পাশবিকতা ও নারকীয়তা যে স্তরে পৌঁছেছিল, সে নিষ্ঠুরতার গল্প শুনলে শিউরে উঠতে হয়। দারিদ্র্যের ভয়ে বাবা নিজের সন্তানকে হত্যা করত। লজ্জা ও গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে নিজের কন্যাসন্তানকে জীবিত দাফন করা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। বাজারে পণ্যের মতো দাস-দাসী বিক্রি হতো। ধর্মের নামে মানুষ বলি হতো। মারামারি-কাটাকাটি সব সময় লেগেই ছিল। ন্যায়-নীতির নামগন্ধও ছিল না। ধনী-গরিবের ওপর জুলুম করত। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতার অপব্যবহার করত। মোটকথা, চারদিকে ছিল শুধু অন্যায় ও নৈরাজ্যের অমানিশা। ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবীতে বর্ষিত হয় রহমতের শবনম, জাতির ভাগ্যাকাশে উদিত হয় মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম। তিনি রহমাতুল্লিল আলামিন। তার অবিশ্রান্ত সংগ্রাম ও প্রচেষ্টায় আরবের পরবর্তী যে চেহারা, সেটি হলো পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ। সব অন্যায়, অসত্য, শোষণ ও জুলুমের রাজত্ব চিরতরে বিলুপ্ত হয়। আরবের বর্বর ও অসভ্য জাতি সুশৃঙ্খল ও সভ্য মানবে রূপান্তর হয়। যারা সমকালীন ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও হয় আলোকবর্তিকা।
রাশিয়ান বিখ্যাত লেখক টলস্টয় বলেন, ‘নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক। মানবসমাজকে এগিয়ে নিতে তার ভূমিকা তুলনাহীন। তার সফলতার দলিল হিসেবে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বর জাতিকে সত্যের আলোর দিশা দিয়ে তাদের তিনি শান্তি ও নিরাপত্তায় ফিরিয়ে আনেন। নিজে সাদামাটা জীবন প্রাধান্য দিয়েছেন। রক্তপাত ও মানুষ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন। মানবতার জন্য উন্নতি, সমৃদ্ধি ও সভ্যতার পথ বিকশিত করেছেন; যা শুধু একজন শক্তিমান ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। এমন মহান মানবের জন্য হাজারো স্যালুট।’ বিশ্ববিখ্যাত লেখক জর্জ বার্নার্ডশ বলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর ধর্মের প্রতি লাখো শ্রদ্ধা। আমি তার বিস্ময়কর প্রাণশক্তি দ্বারা মুগ্ধ। আমার বিশ্বাস পৃথিবীর বুকে এটিই একমাত্র ধর্ম, পরিবর্তনশীল জীবনের সঙ্গে রয়েছে যার অপার সামঞ্জস্য, প্রতিটি যুগের সঙ্গেই রয়েছে তার উপযুক্ততা। আমি এ মহান মানবের জীবনী পাঠ করে মনে হলো, তার নাম হওয়া উচিত মানবতার মুক্তিদাতা।’ সত্যিই তিনি মানবতার মুক্তিদাতা, তার আনীত ধর্ম হলো জীবনঘনিষ্ঠ ও শান্তিতে পরিপূর্ণ। রাসুল (সা.)-এর হাত ধরেই পৃথিবীর শান্তি-শৃঙ্খলা, উন্নতি ও অগ্রগতির সূচনা হয়েছে। তিনি এসে দিশেহারা জাতিকে মুক্তির অমীয় বাণী শোনালেন, যার মাধ্যমে তাদের সামনে সভ্যতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় এবং বিশ্বশান্তির পথ আলোকিত হয়। আজকের সমস্যায় জর্জরিত, মানবতা বিবর্জিত, অশান্ত ও অসভ্য পৃথিবীতে মানবতা, শান্তি-সমৃদ্ধি ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের আবার ফিরে যেতে হবে সেই চৌদ্দশ’ বছর আগে। জীবনকে ঢেলে সাজাতে হবে মহানবী (সা.)-এর সুমহান আদর্শে।