প্রাচীন ফিকহের গ্রন্থাবলিতে চুক্তির উভয় পক্ষের অধিকারগুলো একসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যাপক শব্দে যাকে ‘খেয়ারাত’ বা অপশনস বলা হয়। এর মধ্যে একটি অংশ হলো, ভোক্তা অধিকার। ইসলামে মৌলিকভাবে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কে ভোক্তা গণ্য করা হয়। ইসলামে ভোক্তা অধিকার নিয়ে ফিকহের গ্রন্থাবলিতে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। ত্রয়োদশ হিজরি শতাব্দীতে উসমানি শাসনামলে রচিত ‘মাজাল্লাতুল আহকামিল আদলিয়্যা’ তথা ইসলামি দেওয়ানি আইন এ ক্ষেত্রে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া আধুনিক ইসলামি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়নকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘এ্যাওফি’ এ বিষয়ে ধারাভিত্তিক তিনটি শরিয়া স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়ন করেছে।
ভোক্তা অধিকারের প্রকার : এ্যাওফির শরিয়া স্ট্যান্ডার্ডের আলোকে ইসলামে ভোক্তা অধিকারকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১. আমানাহ তথা ক্রেতা-বিক্রেতার বিশ্বস্ততাভিত্তিক অধিকার। এটি তিনভাবে হতে পারে। যথা-
ক. ন্যায্য মূল্যের চেয়ে অধিক মুনাফার আশায় বিক্রেতাকে মৌখিকভাবে অসত্য বিবরণ দ্বারা প্রভাবিত করা। যেমন- বাংলাদেশে তৈরি মোবাইল চায়না থেকে তৈরি বলে বিক্রি করা অথবা নিলামের ক্ষেত্রে দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে দাম হাঁকা। এ ধোঁকা প্রমাণিত হলে ক্রেতা এককভাবে চুক্তি রহিত করার অধিকার লাভ করবে এবং সে পণ্য ফেরত দিতে পারবে।
খ. পণ্যটি এমনভাবে উপস্থাপন করা, যার ফলে পণ্যের ব্যাপারে অসঠিক ধারণা তৈরি হয়। যেমন- নকল লোগো যুক্ত করে উপস্থাপন করা অথবা লাইটিং ইত্যাদির মাধ্যমে নিম্নমানের জিনিসকে উন্নতমানের মতো দেখানো কিংবা পুরোনো বস্তু রং বদলে নতুন হিসেবে বিক্রি করা ইত্যাদি। এ ধরনের ধোঁকার শিকার হলে ক্রেতা পণ্যটি ফেরত দেওয়ার অধিকার লাভ করবে। আর বিক্রেতা ফেরত নিতে বাধ্য থাকবে।
গ. অত্যধিক অতিরিক্ত মূল্যে পণ্য বিক্রি করা। অর্থাৎ ন্যায্য বাজার মূল্যের চেয়ে অত্যধিক মূল্যে পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করা। ব্যবসায়িক মহলে যে মূল্যটিকে খুব অতিরিক্ত মনে করা হয়, সেটিই অত্যধিক অতিরিক্ত মূল্য। এ ক্ষেত্রে ক্রেতা না জেনে ওই মূল্যে পণ্য বা সেবা ক্রয় করলে, জানার পর চুক্তিটি বাতিল করার অধিকার লাভ করবে। অবশ্য জেনে-বুঝে অধিক মূল্যে ক্রয় করলে, পরে তার কোনো এখতিয়ার থাকবে না।
২. সালামাহ তথা পণ্য দোষমুক্ত থাকা, কাঙ্ক্ষিত কোয়ালিটি লাভ করা ইত্যাদি সম্পর্কিত অধিকার। এটিও তিন ভাগে বিভক্ত- ক. পণ্যে দোষ থাকা। দোষ থাকার অর্থ হলো, চুক্তির পর পণ্যে এমন কোনো দোষ বা ত্রুটি দেখা যাওয়া, যা পণ্যের দাম হ্রাস করে অথবা পণ্যটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। অবশ্য সে দোষটি বিক্রেতার হাতে থাকাবস্থায় ছিল- এ কথা নিশ্চিত হতে হবে। দোষটি যদি স্বাভাবিকভাবে দূর করা সম্ভব না হয়, তাহলে ক্রেতা চুক্তি বাতিল করে পণ্যটি ফেরত দিতে পারবে। অবশ্য দোষটি সম্পর্কে ক্রয় করার আগে জানা গেলে এ অধিকার বহাল থাকবে না।
খ. চুক্তির সময় কাঙ্ক্ষিত কোনো কোয়ালিটি শর্ত করা হলো। পরে দেখা গেল যে, সেই কোয়ালিটি নেই। তাহলে ক্রেতার চুক্তি বাতিল করে পণ্য ফেরত দেওয়ার অধিকার থাকে। যেমন- কাপড় ক্রয় করার সময় ক্রেতা বলল, কাপড়টি সম্পূর্ণ সুতি হতে হবে। পরে দেখা গেল, আংশিক সুতি। তাহলে ক্রেতা চুক্তি বাতিল করার অধিকার লাভ করবে।
গ. চুক্তি বিভাজন হয়ে যাওয়ার কারণে ক্রেতার অধিকার। এর অর্থ হলো, একটি চুক্তিতে যে পণ্য লাভ করার কথা, তার সবটুকু না পাওয়া। যেমন- কেউ একটি জমি কিনল। পরে জানতে পারল, এখানে বিক্রেতার জমির সঙ্গে অন্য কারো জমিও যুক্ত আছে। সেই অন্য ব্যক্তির অংশ তার অনুমতি ছাড়া বিক্রি করা হয়েছে। ফলাফল হলো, চুক্তিটি অনুমতিহীন জমির অংশকে অন্তর্ভুক্ত করছে না। এমতাবস্থায় ক্রেতা চাইলে চুক্তি বাতিল করতে পারবে অথবা যে অংশটুকু সে লাভ করছে, তার ন্যায্য মূল্য প্রদান করবে।
৩. তারাউবি বা রি-কনসিডার সংক্রান্ত অধিকার। এটিও তিন প্রকার-
ক. শর্ত করে ক্রেতা অথবা বিক্রেতা নিজ অধিকার লাভ করা। এর অর্থ হলো, চুক্তির সময় এ মর্মে শর্ত করা যে, ক্রেতা অথবা বিক্রেতা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাইলে এককভাবে চুক্তি বাতিল করতে পারবে। যেমন- কেউ এক জোড়া জুতা কিনতে গেল। পছন্দ হলো এবং কিনে নিল। কিন্তু ক্রয় করার পর অপছন্দ হলে তো আর ফেরত দিতে পারবে না। তাই চুক্তির সময় শর্ত করল, আমি তিন দিনের মধ্যে চাইলে পণ্যটি ফেরত দিতে পারব। বিক্রেতা সম্মত হয়ে চুক্তি করল। তাহলে ক্রেতা এখানে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চুক্তি বাতিল করার অধিকার লাভ করল। আর তা শর্ত করার কারণে লাভ করছে। একইভাবে বিক্রেতাও এমন শর্ত করতে পারে।
খ. নির্দিষ্ট সময়ে মূল্য পরিশোধ না করলে বিক্রেতা বা ভাড়াদাতার চুক্তি বাতিল করার অধিকার। যেমন- একজন ব্যক্তি একটি পণ্য কিনল। নগদে মূল্য পরিশোধ করবে; কিন্তু একটু সময় চাইল। বিক্রেতা বলল, ‘যদি দুদিনের মধ্যে মূল্য পরিশোধ না করো, তাহলে আমি এককভাবে চুক্তি বাতিল করতে পারব।’ সুতরাং নির্দিষ্ট সময় পর বিক্রেতা তার এ অধিকার কার্যকর করার সুযোগ পাবে।
গ. পণ্য নির্দিষ্টকরণের অধিকার। কখনও কখনও এমন হয়, একটি পছন্দ করে বাকিগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য আমরা একাধিক পণ্য একসঙ্গে নিয়ে থাকি। যেমন- বাসা থেকে যেটি পছন্দ করবে, সেটি রেখে বাকিগুলো ফেরত দেওয়ার শর্তে একাধিক শাড়ি ক্রয় করা হলো। এভাবে ক্রয় করা হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্রেতা এ সুযোগ লাভ করবে।
ভোক্তা অধিকারের বৈশিষ্ট্য : ইসলামে ভোক্তা অধিকারের মূল কথা হলো, পারস্পরিক সন্তুষ্টি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না; তবে পারস্পরিক সন্তুষ্টিক্রমে ব্যবসার মাধ্যমে হলে তা বৈধ।’ (সুরা নিসা : ২৯)। সঠিকভাবে মূল্য পরিশোধ করার পর একজন ভোক্তা যেন সঠিক পণ্য, সঠিক সেবা ও কাঙ্ক্ষিত মানের পণ্য বা সেবা লাভ করতে পারেন, তা নিশ্চিত করাই ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সুতরাং এ সন্তুষ্টি বিঘ্নিত হয়, এমন সব বিষয়কে রোধ করা হয়েছে। এ কারণে ইসলামের ভোক্তা অধিকার উভয় পক্ষের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক রক্ষা করে। তাদের প্রতি সুবিচার ও ইনসাফ নিশ্চিত করে। মোটা দাগের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো-
১. ইসলামি আইন অনুযায়ী ভোক্তা তার অধিকার তাৎক্ষণিক কার্যকর করার সুযোগ লাভ করে। ফলে ক্রেতা বা বিক্রেতার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না।
২. ভোক্তার নিজ অধিকার লাভের জন্য শুরুতেই আদালতের দ্বারস্ত হতে হয় না। এতে খুদে গ্রাহকরাও তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় না। অপরদিকে দেশীয় আইনে অধিকাংশ সময় তারা এ সুযোগ গ্রহণ করতে অনুৎসাহিত হন। তা ছাড়া আদালতকে যেনতেন ইস্যুতে জড়িত করার প্রয়োজন হয় না। বরং ক্রেতা-বিক্রেতার অধিকার প্রথমে নৈতিকতা ও পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করা হয়। আর তারা মীমাংসায় যেতে না পারলে তা আদালত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে আদালতে গিয়ে একে অপরের প্রতিপক্ষ হওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। এতে ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক যেমন সুন্দর থাকে, তেমনি পরস্পরের অধিকার আদায় নৈতিকতার মাধুরী দিয়ে সুসম্পন্ন করা সম্ভব হয়।
৩. ইসলামি আইনে যে কোনো পর্যায়ের ক্রেতা ও গ্রাহক এবং বিক্রেতা ও সরবরাহকারীকে ভোক্তা বলে গণ্য করা হয়। কারণ, একজন বিক্রেতাও পণ্য কিংবা পরিষেবা বিক্রি করে মূল্য ও বিনিময় ভোগ করছে। সুতরাং সেও ভোক্তা হওয়াটা বাস্তবসম্মত। দেশীয় আইন এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংকোচিত ও শ্রেণবিশেষের জন্য প্রযোজ্য। কারণ, দেশীয় আইনে ভোক্তা মানে যে কোনো সেবা বা পণ্যের সর্বশেষ ব্যবহারকারী। সুতরাং সর্বশেষ ব্যবহারকারী না হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নেই।
৪. দেশীয় আইনে ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য দণ্ড বা আর্থিক দণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রদান করা হয়। অপরদিকে ইসলামি আইনে প্রথমে ভোক্তার প্রাপ্য নিশ্চিত করা হয়। আর অধিকার প্রাপ্তিতে প্রয়োজন হলে আদালতের সহযোগিতা গ্রহণ করা হয়।
৫. ইসলামি আইন নৈতিকতাসমৃদ্ধ। ইসলাম মানবতাকে সামনে রেখে আইন প্রয়োগ করে।
৬. ভেজাল নিয়ন্ত্রণ ও ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক দুর্নীতি দমনের ব্যবস্থা ইসলামের দৃষ্টিতে বাজার ব্যবস্থাপনার অংশ। যা পরোক্ষভাবে ভোক্তার অধিকার নিয়ন্ত্রণ করে। দেশীয় আইনে এমন পদ্ধতিকে ভোক্তার অধিকার রক্ষার মূল পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এটি রাষ্ট্রের বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সরাসরি ভোক্তার অধিকার রক্ষার পদ্ধতি এটি নয়।
৭. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, মানব রচিত আইন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী শ্রেণি দ্বারা প্রভাবিত এবং তা মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে নয়। যার ফলে সব যুগের সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। একটি যুগ পেরিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করলে উক্ত আইন সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়। অতঃপর যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল কোনো নতুন আইন প্রণয়নের মধ্যে অনুপযুক্ত বিদ্যমান আইনের দ্বারা মানুষের অধিকার খর্ব হয়। অপরদিকে ইসলামি আইন অহির ইলম থেকে গৃহীত। যা মৌলিকভাবে অপরিবর্তনীয় এবং সব যুগের মানুষের মৌলিক অধিকার পরিপূর্ণ ইনসাফের সঙ্গে নিশ্চিত করতে সক্ষম। একই সঙ্গে তা মানবীয় দুর্বলতা এবং প্রভাব থেকে মুক্ত। এতে সব শ্রেণির মানুষকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা।