ধন-সম্পদ ও অর্থবিত্ত ঘূর্ণয়মান বস্তু। তা সর্বদা একজনের কাছে গচ্ছিত থাকে না। দিনরাতের আবর্তনে পালাবদল হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যেন তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান, ঐশ্বর্য শুধু তাদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।’ (সুরা হাশর : ৭)। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সম্পদের ঘূর্ণন প্রক্রিয়া বিরাজমান। ধন-সম্পদ ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসের মতো এই আছে, এই নেই। কবির ভাষায়, ‘নদীর এপার ভাঙে, ওপার গড়ে। এইতো নদীর খেলা। সকালবেলার ধনীরে তুই, ফকির সন্ধ্যাবেলা!’ ধন-দৌলত ছাড়া জীবনের সচল চাকা অচল হয়ে পড়ে। স্থবির হয় জীবনযাত্রা। কেননা, এর ওপর প্রতিষ্ঠিত মানব ও মানবতার কাঙ্ক্ষিত বাঁধন। অথচ সবসময় সবার কাছে অর্থের প্রাচুর্য থাকে না। সর্বদা থাকে না কোটিপতির কাছেও অর্থ-কড়ি। কাড়ি কাড়ি সম্পদের মালিকও হঠাৎ অর্থ-সংকটে ভুগতে পারে। এ এক চরম বাস্তবতা। তাই ইসলাম আকস্মিক সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে দান করেছে একে অপরকে কল্যাণকর ঋণদান প্রথা।
কোরআনে ঋণদানের নির্দেশনা : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কে আছে, যে আল্লাহকে উত্তম পন্থায় ঋণ দেবে। ফলে তিনি তার কল্যাণে তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন? আল্লাহই সংকট সৃষ্টি করেন, তিনিই সচ্ছলতা দান করেন। তাঁরই কাছে তোমাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে।’ (সুরা বাকারা : ২৪৫)। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ চির অমুখাপেক্ষী। তাঁর ধনভাণ্ডারে কোনো অভাব নেই। সবাই কাঙাল বেশে তাঁর কাছেই হাত পাতে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ‘আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবাই তাঁরই কাছে চায়। তিনি রোজ একেকটি শানে থাকেন।’ (সুরা আর রহমান : ২৯)। আল্লাহকে উত্তম পন্থায় ঋণদানের অর্থ হলো, একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি লাভে তাঁর পথে ব্যয় করা, গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা, বিপদগ্রস্তদের ঋণ প্রদান করা।
ঋণ প্রদানে সদকার সওয়াব : কর্জপ্রথা জীবনকে সহজ, সুখময় ও নির্মল করে তোলার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ঋণদানে একদিকে যেমন পারস্পরিক মমতা, ভালোবাসা, সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়; তেমনি এর মাধ্যমে লাভ করা যায় অবারিত সওয়াব। বিশ্বমানবতার চিরকল্যাণকামী বন্ধু প্রিয়তম নবী (সা.) উম্মতকে ঋণ প্রদানে উৎসাহিত করেছেন পরম মমতায়। ঋণ দেওয়াকে সদকা আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘সব ঋণ সদকা।’ (সুনানে বায়হাকি : ৩৫৬৩)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কোনো মুসলমান যদি অপর মুসলমানকে দু’বার ঋণ দান করে, তাহলে সে একবার তা দান করার সওয়াব পাবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪৩০)।
ঋণের নেকি দানের চেয়েও বেশি : প্রয়োজনে ঋণ দেওয়া শুধু সামাজিক ও মানবিক দাবিই নয়, মহাপুণ্যময় কল্যাণকর আমল। অনেক ক্ষেত্রে ঋণ প্রদান দান করার চেয়েও অধিক নেকি। কেননা, অভাবগ্রস্ত ভিখারিরা যখন-তখন যার কাছে ইচ্ছে হাত পাততে পারে। ১০ দুয়ারে ঘুরে হলেও নিজের কাঙ্ক্ষিত প্রয়োজন মেটাতে পারে। কিন্তু ভদ্র সম্মানিত মধ্যবিত্ত অভাবীরা সামাজিক মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বের কারণে যার-তার কাছে হাত পাততে পারে না। অভাব-অনটনের খানাখন্দে বাস করলেও অন্যকে বলতে পারে না। দরিদ্র্যের কষাঘাতে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, নিরুপায় হয়ে তখন অন্যের কাছে কর্জ চায়। তাই তাদের দাবি পূরণ করা নৈতিক ও মানবিকভাবেও যেমন অধিক গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিতে তাৎপর্যপূর্ণ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি মেরাজের রাতে বেহেস্তের দরজায় লেখা দেখেছি- দানের প্রতিদান দশগুণ আর ঋণদানের প্রতিদান আঠারোগুণ।’ আমি তখন জিবরাইল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দানের চেয়ে ঋণের মর্যাদা বেশি কেন?’ তিনি বললেন, ‘ভিখারী (সম্পদ) থাকা সত্ত্বেও হাত পাতে, আর ঋণগ্রহীতা শুধু ঠেকায় পড়েই ঋণ চায়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪৩১)। তাইতো প্রখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমি কাউকে কোনো কিছু একবার দান করার চেয়েও তা দু’বার ঋণ দেওয়া অধিক পছন্দ করি।’ (সুনানে বায়হাকি : ৩/১৩১১)।
ঋণ নিতে হবে পরিশোধের মানসে : ঋণ অন্যের হক। বিপদে প্রয়োজনে ঋণ করলেও তা গ্রহণ করতে হবে পরিশোধ করার নিয়তে। অন্যথায় তা হবে অন্যের হক আত্মসাতের মতো ভয়াবহ গোনাহ। আদায় করার মানসে কর্জ করলে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন, ঋণ পরিশোধ করার তৌফিক দেন। উম্মুল মুমিনিন মায়মুনা (রা.) ধার-কর্জ করতেন। তার পরিবারের কেউ কেউ বলল, ‘আপনি ধার করবেন না।’ তারা তার এ কাজ অপছন্দ করল। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি আমার নবী (সা.) ও প্রিয়তমকে বলতে শুনেছি, ‘যে কোনো মুসলমান ধার-কর্জ করে এবং আল্লাহ জানেন যে, তা পরিশোধ করার ইচ্ছে তার রয়েছে, তাহলে দুনিয়াতেই আল্লাহ তার ওই কর্জ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪০৮)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে উত্তমরূপে কর্জ পরিশোধ করে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪২৩)। পক্ষান্তরে আদায় না করার উদ্দেশে ঋণ নিলে তাকে নবীজি (সা.) ‘চোর’ আখ্যা দিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করল এবং তা পরিশোধ না করতে সংকল্পবদ্ধ হলো, (কেয়ামতের দিন) সে আল্লাহর সঙ্গে চোর হিসেবে সাক্ষাৎ করবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪১০)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘মোমিন বান্দার আত্মা তার দেনার সঙ্গে ঝুলন্ত থাকে, যতক্ষণ না তার পক্ষ থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪১৩)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি এক বা দুই দিরহাম দেনা নিয়েও মারা যায়, তাহলে তার ওই দেনা তার অর্জিত নেকি থেকে আদায় করা হবে। আর সেখানে কোনো দিনারও থাকবে না, দিরহামও থাকবে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪১৪)।
ঋণ হতে হবে সুদমুক্ত : অধুনা ঋণদানের এ মহান ও মানবিক প্রথা সুদের মিশেলে ভয়াবহ কলংকের শিকার। মানুষের দুর্বলতার সিঁড়ি বেয়ে অভাব-অনটনকে পুঁজি করে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে মানবতার চিরন্তন শত্রু নানা এনজিও সংস্থার অসংখ্য সুদের আস্তানা। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে সবখানেই এ মারাত্মক পাপের ক্রমবর্ধমান ঘৃণ্য অগ্রযাত্রা। ফলে বিপদে পাচ্ছে না কেউ সুদমুক্ত ঋণের ভরসা। অথচ ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে, ঋণ হতে হবে সুদমুক্ত। মুনাফাযুক্ত ঋণ সুদ হিসেবে গণ্য। আর সুদখোরের বিরুদ্ধে মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যে যুদ্ধে সুদখোর জয়লাভ করার কোনো সম্ভাবনা নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমরা যদি প্রকৃত মোমিন হয়ে থাক, তবে সুদের যে অংশই (কারও কাছে) অবশিষ্ট রয়ে গেছে, তা ছেড়ে দাও। তবুও যদি তোমরা পরিত্যাগ না করো, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হয়ে যাও।’ (সুরা বাকারা : ২৭৮-২৭৯)।
ঋণ আদায়ে অক্ষমকে ছাড় দেওয়া কাম্য : যারা বিপদে পড়ে ধার করে, রীতিমতো সময় নির্দিষ্ট করে ঋণ নেয়, তারা যদি বাস্তবসম্মত কোনো সমস্যায় পড়ে যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হয়, তাহলে মানবিক কারণে তাদের ছাড় ও সুযোগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজনে মাফ করে দেওয়া উচিত। এতে আল্লাহতায়ালা ঋণদাতাকে বিপদে ও সংকটে অলৌকিকভাবে সাহায্য করবেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মোমিনের পার্থিব কষ্টগুলো থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে, (এর প্রতিদানে) আল্লাহ কেয়ামতের বিপদগুলো থেকে তার কোনো বিপদ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়াতে ছাড় দেয়, আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মোমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে যায়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৯৪৬)। উপরন্তু করুণাময় রব তাকে নিজ ছায়ায় স্থান দেবেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার ছায়ায় থাকতে চায়, তার ঋণগ্রহীতা অভাবীকে অবকাশ দেওয়া কিংবা তার দেনা (বা ঋণের কিয়দাংশ) মাফ করে দেওয়া উচিত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪১৯)।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম।