ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিকাশ ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বিধান

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
বিকাশ ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বিধান

যে কেউ কোম্পানির এজেন্টদের কাছে গিয়ে নির্ধারিত ফরম পূরণের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধাগুলো নেওয়ার জন্য একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। (যদিও টাকা প্রেরণ ও গ্রহণের জন্য নিজস্ব অ্যাকাউন্ট না থাকলেও চলে। সে ক্ষেত্রে এজেন্টদের মাধ্যমে তা করা যায়)। বিকাশ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং, এম ক্যাশসহ কয়েকটি কোম্পানির অ্যাকাউন্ট খোলার ফরম ও নিয়মাবলি পড়ে দেখা গেছে, সেগুলোতে মৌলিকভাবে শরিয়া পরিপন্থি কোনো শর্ত পাওয়া যায়নি। তবে ভবিষ্যতে নিয়মাবলি পরিবর্তন করার একক অধিকার কোম্পানি বহন করবে, এমন শর্ত শরিয়তের ‘আল ইজারা’ নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; বরং উভয় পক্ষের সম্মতিতে এমনটি করাই শরিয়তের নিয়ম। বিকাশের অ্যাকাউন্ট ফরমের অপর পৃষ্ঠায় ছাপানো শর্তাবলির ১১নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘গ্রাহককে কোনো পূর্ব ঘোষণা অথবা বিজ্ঞাপন জারি ব্যতিরেকে যেকোনো সময়ে যেকোনোভাবে বর্তমান নিয়মাবলি সংশোধন, উন্নয়ন, পরিবর্তন করার ক্ষমতা বিকাশ সংরক্ষণ করে।’ এটা একটা অনৈতিক আইন। এ ধরনের একচ্ছত্র ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন করে কী করে? কেন না, একটি চুক্তি মানেই হলো তাতে একাধিক পক্ষ জড়িত। সেখানে কোনো এক পক্ষের এত নিরঙ্কুশ অধিকার ভোগ করা কোনোক্রমেই ইনসাফপূর্ণ নয়। বিষয়টি এমনো হতে পারত, কোনো সময় নিয়মাবলি পরিবর্তন, সংশোধনের প্রয়োজন হলে তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করে এবং গ্রাহকের মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানানো হবে। তবে যেহেতু একজন অ্যাকাউন্ট হোল্ডার যে কোনো সময় কোনো খরচ ছাড়াই তার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে পারে, তাই উপরিউক্ত শর্তের কারণে অ্যাকাউন্ট খোলা নাজায়েজ হবে না। বিকাশ ফরমের ৭নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘গ্রাহক হিসেবে জমাকৃত তহবিল নিরাপত্তা জামানত বিবেচিত হবে। বিকাশ এর নিকট কৃত অঙ্গীকার এবং দায়িত্ব অগ্রাহ্য অথবা যথাযথ পূরণ না করা হলে কোনো পূর্ব ঘোষণা প্রদান ব্যতিরেকে উক্ত তহবিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ব্যবহারের অধিকার বিকাশ সংরক্ষণ করে।’ এ ধারাটি দেখলে কারো হয়তো ফিকহে ইসলামির ‘রাহান’ বলে সন্দেহ হতে পারে। বাস্তবে এটি ‘রাহান’ নয়। কারণ ‘রাহান’ হয় কোনো জিম্মা বা পাওনার নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটি উল্টো। অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের টাকা বরং কোম্পানির কাছে জমা থাকে। কোম্পানি তার কাছে কিছু পাওনা থাকে না। এটি হয়তো প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ফিকহে ইসলামির ‘আয যফার বিল হক’র মাসআলার সঙ্গে মিলতে পারে।

বিকাশের শর্তাবলির ১৩নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিকাশ অ্যাকাউন্টে জমাকৃত টাকার ওপর কোনো প্রকার সুদ প্রদান করা বা না করার যাবতীয় অধিকার বিকাশ সংরক্ষণ করে।’ বলা নিষ্প্রয়োজন যে, একজন মুসলমানের কোনোক্রমেই সুদ গ্রহণ করার সুযোগ নেই। তাই ভবিষ্যতে কখনো মোবাইল অ্যাকাউন্টধারীকে সুদ দেওয়া হলে কিছুতেই তা ব্যবহার করবে না, এমন সংকল্প ফরমে স্বাক্ষর করার সময়ই মনে রাখতে হবে। ইসলামী ব্যাংকের এমক্যাশের প্রচারপত্রে এজেন্টদের জন্য একটি অতিরিক্ত শর্ত রয়েছে। তা হচ্ছে, এজেন্টকে ২৫ হাজার টাকা ইসলামী ব্যাংকে এফডিআর করে রাখতে হবে, যার ওপর তাকে মুনাফা দেওয়া হবে। এটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয় শর্ত। মোটকথা, মোবাইল অ্যাকাউন্টে যেহেতু সামান্য টাকাই জমা রাখার সুযোগ আছে, তাই এর ওপর সুদ বা মুনাফা দেওয়ার বিষয়টি জড়িত করার কোনোই দরকার নেই।

ক্যাশইন : মোবাইল অ্যাকাউন্ট খোলার পর গ্রাহক নিজ অ্যাকাউন্টে এজেন্টের মাধ্যমে টাকা জমা করতে পারেন। কোনো কোনো মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি তাদের ব্যাংকে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থাকলে সেখান থেকেও মোবাইল অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের সুবিধা দিয়ে থাকে। এ সুবিধাগুলো বিনামূল্যে বা ন্যূনতম (ফ্ল্যাট রেটে) মাশুলে (৫-১০ টাকা) হয়ে থাকে। অতএব, এতে শরঈ দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো অসুবিধা নেই।

সেন্ড মানি : একজন মোবাইল অ্যাকাউন্টধারী তার হিসাব থেকে অন্য অ্যাকাউন্টধারীর হিসাবে নির্ধারিত পরিমাণে টাকা পাঠাতে পারে। এটিকে সেন্ড মানি বলে। ২ থেকে ৫ টাকার ফ্ল্যাট রেটে এ সুবিধা দেওয়া হয়। এতেও শরঈ দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো সমস্যা নেই।

ক্যাশ আউট : মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বহুল ব্যবহৃত সুবিধা এটি। নিজ অ্যাকাউন্ট থেকে অথবা এজেন্টের কাছে প্রেরিত টাকা উত্তোলনই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। দুঃখজনক সত্য হলো, এ সেবাটির জন্যই মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি অনেক বেশি মাশুল নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের চার্জ হচ্ছে, ১.৮৫ শতাংশ তথা প্রতি ১০০ টাকায় ১ টাকা ৮৫ পয়সা, আর হাজারে ১৮.৫০ টাকা। সংশ্লিষ্ট এজেন্ট, ডিস্ট্রিবিউটর, মোবাইল অপারেটরকে এ টাকা থেকে নির্ধারিত কমিশন প্রদানের পর অবশিষ্টাংশ কোম্পানি তথা ব্যাংক পেয়ে থাকে। ফিকহে ইসলামির দৃষ্টিতে এটি ‘আল ইজারা’র অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে টাকা জমা বা উত্তোলনকারী হচ্ছে শ্রম বা সেবা গ্রহীতা বা মুসতাজির। আর এজেন্ট হচ্ছে শ্রম বা সেবাদাতা, যাকে বলা হয় আজির (আলোচিত ক্ষেত্রে মূল আজিরের প্রতিনিধি)। এক সময় ডাক বিভাগের মানি অর্ডারকেও তখনকার ওলামায়ে কেরাম এভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন। আল ইজারার মৌলিক শর্তগুলো থাকায় বিষয়টিকে জায়েজ বলা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। যথা- ১. ক্যাশ আউটের বর্তমান চার্জ সার্বিক বিবেচনায় পরিমাণে বেশি। যেহেতু কোম্পানিকে কোনো পর্যায়েই নিজ থেকে কোনো টাকা দিতে হয় না; বরং বিভিন্ন পর্যায়ে ডিস্ট্রিবিউটর, এজেন্ট ও গ্রাহকের অনেক অনেক টাকা তাদের কাছে জমা থাকে, তাই এ সার্ভিসটির চার্জ আরো কম হওয়া উচিত। জনবহুল বাংলাদেশে সেবাগ্রহণকারীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় সামান্য চার্জ নিলেও তা একত্র হয়ে মোটা অঙ্কের টাকায় পরিণত হবে। সরকারি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকেরও এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলে মনে করি।

২. বর্তমান নিয়মে টাকা যত বাড়বে, চার্জও একই হারে বাড়বে। এটি সংশোধন করে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ একটি সীমা নির্ধারণ করা দরকার। কারণ, টাকার অঙ্ক বাড়লেও সার্ভিস তো সমানই হচ্ছে। বর্তমান নিয়মে কোনো প্রবাসী যদি আপনজনের মোবাইল অ্যাকাউন্টে ১ লাখ টাকা প্রেরণ করে, তবে সে টাকা ক্যাশ আউট (উত্তোলন) করতে গিয়ে তাকে গুণতে হবে ১ হাজার ৮৫০ টাকা, যা অবশ্যই জুলুম।

৩. অভিযোগ আছে, কোনো কোনো এজেন্ট ক্যাশ আউটের ক্ষেত্রে নির্ধারিত হারের চেয়েও বেশি রাখে। এটি কোনোক্রমেই জায়েজ হবে না। মনে রাখতে হবে, এজেন্টরা হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির নিযুক্ত শ্রম বা সেবাদাতা প্রতিনিধি। কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত চার্জের বেশি নেওয়ার অধিকার তাদের নেই। ব্যাংকের কাউন্টারে অফিসার কর্তৃক নির্ধারিত চার্জের অতিরিক্ত নেওয়া যেমন ঘুষ তথা উৎকোচের শামিল, এ ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমন দাঁড়াবে। কোম্পানিগুলোকে এ দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। যেন সাধারণ মানুষ তাদের কোনো এজেন্ট কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

৪. কেউ কেউ পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট দ্বারাও ব্যবসা করে থাকে। আইন অনুযায়ী এটি নিষিদ্ধ। এমনটি করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৫. কোনো কোনো কোম্পানি এটিএম থেকে ক্যাশ আউটের হার হাজারে ২০ টাকা রাখে। অথচ এখানে এজেন্ট বা ডিস্ট্রিবিউটরের কোনো মধ্যস্থতা নেই। শুধু এটিএমের সঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিং সফটওয়্যারের লিংক স্থাপিত করলেই হলো। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এটিএম থেকে নিজের জমা টাকা তুলতে ২ শতাংশ চার্জ দেওয়া কতটুকু জুলুম, তা ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। হয়তো সেসব কোম্পানি তাদের এজেন্ট বা ডিস্ট্রিবিউটরদের সুবিধা দিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর মানসেই এ কৌশল করেছে। কিন্তু গ্রাহকদের স্বার্থ কী উপেক্ষিত থাকবে? এ ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই ৫ থেকে ১০ টাকার বেশি চার্জ হওয়া উচিত নয়। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের চার্জ এ ক্ষেত্রে বর্তমানে কম ও যুক্তিসঙ্গত।

মোবাইল রিচার্জ : মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের নিজ নিজ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মোবাইল ফোন রিচার্জের সুযোগও দিয়ে থাকে। এজন্য বাড়তি কোনো ফি নেওয়া হয় না। তবে মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে তারা কমিশন পেয়ে থাকে নিশ্চয়ই। শরিয়তের দৃষ্টিতে এতে কোনো সমস্যা নেই।

রেমিট্যান্স গ্রহণ : বিদেশ থেকে প্রেরিত টাকা মোবাইল অ্যাকাউন্টে গ্রহণের সেবাকে রেমিট্যান্স বলে। প্রেরণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা না দিতে হলেও উত্তোলনের ক্ষেত্রে ক্যাশ-আউটের পুরো ফি-ই গ্রাহককে প্রদান করতে হয়। আগেই বলা হয়েছে, বর্তমানে তা হাজারে ১৮.৫০ টাকা ও লাখে ১ হাজার ৮৫০ টাকা। মানুষের কষ্টে অর্জিত অর্থের ওপর এটি অন্যায় হস্তক্ষেপ। তবে কোনো গ্রাহক মোবাইল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে রেমিট্যান্স গ্রহণ করলে, তা নাজায়েজ হবে না।

পেমেন্ট : মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলো বর্তমানে গ্রাহকদের নিজ নিজ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থান থেকে খরিদকৃত পণ্য ও সেবার মূল্য পরিশোধেরও সুযোগ দিচ্ছে। এর জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে অতিরিক্ত চার্জ করা হয় না। পণ্য বিক্রয়কারী বা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় ‘মার্চেন্ট’। গ্রাহকের মোবাইল অ্যাকাউন্ট এবং এজেন্ট বা ডিস্ট্রিবিউটরের অ্যাকাউন্টের মতো তাদেরও থাকে মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট। কোম্পানি মার্চেন্ট থেকে কমিশন পেয়ে থাকে।

এটিকে ডেবিটকার্ড ও প্রিপেইড কার্ডের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের সঙ্গে তুলনা করা যায়। মৌলিকভাবে এটি জায়েজ। তবে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়; তা হচ্ছে, যদিও বাহ্যিকভাবে এসব সেবার মাধ্যমে মানুষ ক্যাশ টাকা বহন করার ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়ে থাকে, কিন্তু ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল অ্যাকাউন্ট থেকে পেমেন্ট ইত্যাদি সুবিধা ব্যাংকগুলো তাদের লাভের জন্য আবিষ্কার করেছে। এসবের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো মার্চেন্ট তথা ব্যবসায়ীর লাভে ভাগ বসিয়ে থাকে।

বিভিন্ন হারে কমিশন নিয়ে থাকে, যা সুস্পষ্ট মধ্য স্বত্বভোগ। কারণ, আধুনিক মার্চেন্টরা এসব কমিশন ও চার্জের কথা মাথায় রেখেই তাদের পণ্য বা সেবার মূল্য বাড়িয়ে ধরে থাকে, যার মাশুল গুণতে হয় সাধারণ ভোক্তাকে। ইসলাম এ ধরনের মধ্য স্বত্বভোগকে নিরুৎসাহিত করে থাকে। সার্বিক বিবেচনায় বর্তমানে প্রচলিত মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম জায়েজ। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষরাকে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া দরকার। তবে বর্তমান তথ্য অনুযায়ী আলোচনা করা হলো।

ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি কোনো নতুন নিয়ম করলে, সে ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমের কাছ থেকে পুনরায় মাসআলা জেনে নিতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত