ব্যবসার নিয়ম
নূর মুহাম্মদ রাহমানী
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আমরা বিভিন্ন উপায়ে অর্থ উপার্জন করি। এর মধ্যে ব্যবসা উত্তম ও শ্রেষ্ঠ পন্থা। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিজের পালনকর্তার কাছে রিজিক অন্বেষণ করাতে কোনো অসুবিধা নেই।’ (সুরা বাকারা : ১৯৮)। তবে এর জন্য কিছু নীতিমালা রয়েছে; যা আদর্শ ব্যবসায়ীর জন্য মেনে চলা কর্তব্য।
হারাম বস্তু বেচাকেনা না করা : হারাম বস্তুতে লাভ বেশি হলেও সেদিকে অগ্রসর না হওয়া কর্তব্য। আল্লাহ বলেন, ‘একশ্রেণির লোক আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অন্ধভাবে অবাস্তব কথাবার্তা সংগ্রহ করে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। তাদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ (সুরা লোকমান : ৬)।
ব্যবসায় কারো ক্ষতি না করা : ব্যবসায় মানুষের উপকারের মানসিকতা রাখতে হবে। কারো ক্ষতি যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বা অন্যের ক্ষতি করা কোনোটিই উচিত নয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৩৪১)।
ধোঁকা-প্রতারণা ও ফাঁকিবাজি না করা : মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেওয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশ্রণ করে ধোঁকা দেওয়া হারাম। একদিন রাসুল (সা.) বাজারে গিয়ে একজন খাদ্য বিক্রেতার পাশ কেটে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেখলেন, ভেতরের খাদ্যগুলো নিম্নমানের। রাসুল (সা.) বললেন, ‘এটা কী?’ লোকটি বলল, ‘এতে বৃষ্টি পড়েছিল।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি সেটা খাবারের ওপরে রাখলে না কেনো; যেন লোকরা দেখতে পারে? যে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত নয়।’ (মুসলিম : ১০২)।
ওজনে নিজ স্বার্থরক্ষায় কমবেশি না করা : অন্যকে পণ্য দেওয়ার সময় ওজনে কম দেওয়া, আর নেওয়ার সময় বেশি করে নেওয়া জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ বলেন, ‘যারা পরিমাপে কম দেয়, তাদের জন্য ধ্বংস; যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে; আর যখন তাদের মেপে বা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ১-৩)।
পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথ না করা : মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রির পরিণতি খুবই ভয়াবহ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামত দিবসে আল্লাহতায়ালা তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন হলো, যে তার ব্যবসায়িক পণ্যকে মিথ্যা কসম করে বিক্রি করে।’ (মুসলিম : ১০৬)।
ঠকা যাবে না, ঠকানোও যাবে না : এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে বেচাকেনায় প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ করল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘যখন তুমি ক্রয়-বিক্রয় করবে, তখন বলে দেবে, কোনো প্রতারণার দায়িত্ব আমি নেব না। তোমার জন্য তিন দিন পর্যন্ত পণ্য ফেরত দেওয়ার অধিকার আছে।’ (বোখারি : ৬৯৬৪)।
ব্যবসার সঙ্গে সুদকে না মেশানো : ব্যবসার নামে কোনো প্রকার সুদ চালু করা যাবে না। আল্লাহ বলেন, ‘যারা সুদ খায়, তারা কেয়ামতের দিন শয়তানের প্রভাবে মোহাবিষ্টদের মতো দাঁড়াবে। কারণ, তারা বলে, ক্রয়-বিক্রয় (ব্যবসা) তো সুদের মতো। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)।
অপরের মাল হরণ করার চেষ্টা না করা : ব্যবসার জটিল মারপ্যাঁচে অন্যের মাল হরণ করা হারাম। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ কোরো না। কেবল তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয়, তা বৈধ।’ (সুরা নিসা : ২৯)।
মালিকানাহীন জিনিস বেচাকেনা না করা : হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমাকে এমন বস্তু বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন, যা আমার কাছে নেই।’ (তিরমিজি : ১২৩৫)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো খাবার ক্রয় করে, তা ওই সময় পর্যন্ত বিক্রি করবে না, যতক্ষণ না বস্তুটি পুরোপুরি আয়ত্বে আসে।’ (বোখারি : ২১৩৬)।
পরস্পরের সন্তুষ্টিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া : ব্যবসায় লেনদেনের ক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা পরস্পর সন্তুষ্টিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া। বিক্রেতা নিজ খুশিমতো বিক্রি করবে এবং ক্রেতাও নিজ খুশিমতো ক্রয় করবে। কোনো পক্ষ থেকে বাধ্য করলে বিক্রয় বৈধ হবে না। আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা একে অপরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেও না। তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা।’ (সুরা নিসা : ২৯)।
ক্রেতাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া : অনেক সময় ক্রেতা বা গ্রাহক অনভিজ্ঞ হওয়ায় ব্যবসায়ীর কাছে পরামর্শ চায়। ভালো জিনিস বাছাই করে দিতে বলে। এ ক্ষেত্রে ক্রেতা বা গ্রাহককে সঠিক পরামর্শ দেওয়া কর্তব্য। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যার কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়, সে আমানতদার।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৭৪৫)।
দাম নির্ধারণ করা ও অস্পষ্ট না রাখা : নগদ বা বাকিতে বিক্রিত বস্তু ও দাম নির্ধারিত হতে হবে। পরস্পর সন্তুষ্টিতে পণ্য ও মূল্য বিনিময় করতে রাজি থাকতে হবে। অজানা ও অনির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে বিক্রয় শুদ্ধ হবে না। কেন না, এ ক্ষেত্রে একে শরিয়তের পরিভাষায় ক্রয়-বিক্রয় বলা হবে না। (ফিকহুস সুন্নাহ : ৮৯৮)।
বাকি লেনদেন লিখে রাখা : ব্যবসায় বাকিতে লেনদেন হলে লিখে রাখা অবশ্য কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট করে উভয় পক্ষের নাম, মূল্য পরিশোধের সময় ও পরিশোধের পদ্ধতি লিখে নিতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিনগণ! যখন তোমরা পরস্পর কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাকিতে কোনো লেনদেন করো, তখন তা লিখে রাখো। এটা প্রমাণপত্র লেখার নির্দেশ।’ (সুরা বাকারা : ২৮২)।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ