অল্পে তুষ্টি অনন্য পুঁজি
আবদুল কাইয়ুম শেখ
প্রকাশ : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মানুষের চাহিদার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তার আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো সমাপ্তি ও পরিসমাপ্তি নেই। সে যত ইচ্ছা কামনা করতে পারে। আরো চাই, আরো চাই করতে পারে। প্রত্যাশার ঘোড়াকে দ্রুতবেগে দৌড়াতে পারে। কিন্তু যেসব লোক আশা-আকাঙ্ক্ষার পেছনে পড়ে নিজের চাওয়া-পাওয়ার ইচ্ছাকে সবল করে অধিক পাওয়ার ইচ্ছায় সর্বদা ব্যস্ত থাকে, তারা দণ্ডে দণ্ডে ও পলে পলে না পাওয়ার বেদনায় কাতর হয়। অভাব-অনটন তাদের লেগেই থাকে। দারিদ্র্যের কষাঘাত হতে তারা বেরুতে পারে না। বঞ্চনার বেদনা হতে রক্ষা পাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। স্বল্পতার যন্ত্রণা ও অভাবের যাতনা তাদের কুড়ে কুড়ে খায়। তাই জীবন চলার পথে আত্মিকভাবে বিত্তশালী ও অভাবমুক্ত হওয়ার জন্য অল্পে তুষ্টির বিকল্প নেই। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ধনের আধিক্য হলে ধনী হয় না; অন্তরের ধনীই প্রকৃত ধনী।’ (বোখারি : ৬৪৪৬)।
লালসা না করার নির্দেশ : পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ নেই, যার চেয়ে অধিক সম্পদ, সুখ ও মান-মর্যাদার অধিকারী অন্য কোনো লোক নেই।
কারও হয়তো অর্থবিত্ত আছে, কিন্তু সুখ নেই। আবার কারও বিত্ত-বৈভব তেমন না থাকলেও সুখ-শান্তির অভাব নেই। এখন যদি কেউ অন্যের ধনৈশ্বর্য বা সুখ-শান্তির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে নিজেকে অসহায় ও অভাবগ্রস্ত মনে করে, তাহলে সে দুঃখ ও পরিতাপে কাতর হবে। তার দুর্ভোগ ও দুর্দশা বেড়ে যাবে। তাই অন্যের সুখ-শান্তি ও ধন-সম্পত্তির প্রতি লোভ না করার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের কাউকেও কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লালসা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে, তা তার প্রাপ্য অংশ।
আর নারী যা অর্জন করে, তা তার প্রাপ্য অংশ। আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নিসা : ৩২)। অন্যের সুখ-শান্তি ও ভোগ-বিলাসের উপকরণের প্রতি নেত্রপাত না করার আদেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘আমি এদের বিভিন্ন প্রকার লোককে পরীক্ষা করার জন্য পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যস্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, আপনি সেসব বস্তুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন না। আপনার পালনকর্তার দেওয়া রিজিক উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।’ (সুরা তহা : ১৩১)।
নিম্নস্তরের লোকের দিকে তাকানো : যদি কেউ তার চেয়ে অধিক সম্পদশালী ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি দেয়, তাহলে তার কাছে নিজেকে অসহায় ও অভাবগ্রস্ত মনে হয়। এতে তার আফসোস, পরিতাপ ও যাতনা বেড়ে যায়।
বঞ্চনার হাহাকার নিজের মধ্যে বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে কেউ যদি তার চেয়ে কম সম্পদের অধিকারী লোকের প্রতি তাকায়, তাহলে তার মধ্যে সুখী হওয়ার বোধ জাগ্রত হয়। এতে সে না পাওয়ার বেদনা হতে মুক্তি পায়। তাই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার স্বার্থে মানুষের জন্য সমীচীন হলো, জাগতিক বিষয়ে নিজের চেয়ে নিম্নস্তরের লোকের প্রতি তাকানো। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পার্থিব ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে কম সম্পদশালী মানুষদের প্রতি দৃষ্টি দিও; তোমাদের চেয়ে ধনী লোকদের দিকে নয়।
এতে করে তোমাদের কাছে আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতসমূহ নগণ্য মনে হবে না।’ (তিরমিজি : ২৫১৩)। নিজের চেয়ে অধিক সম্পদ ও মান-মর্যাদার অধিকারী লোকের দিকে না তাকানো কল্যাণকর। এরপরও যদি কাউকে বেশি সুখী মনে হয়, তাহলে নিজের চেয়ে নিম্নস্তরের কোনো লোকের দিকে তাকাবে। এতে হীনম্মন্যতা কেটে যাবে। দুঃখ ও পরিতাপবোধ অপসৃত হবে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি ধন ও সৃষ্টিগত (সুন্দরের) দিক থেকে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিপাত করে, তাহলে সে যেন সঙ্গে সঙ্গে তার চেয়ে নিম্নস্তরের ব্যক্তিদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে, যাদের ওপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছে।’ (মুসলিম : ৭৩১৮)।
স্রষ্টা ও সৃষ্টির ভালোবাসা লাভ : কথায় আছে, অর্থই সকল অনর্থের মূল। সম্পদ অনেক সময় অন্যায়, অনাচার ও পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়। জাগতিক উন্নতি ও অগ্রগতির অতিশয় আসক্তি পরকাল ভুলিয়ে দেয় ও করুণাময় আল্লাহকে বিস্মৃত করিয়ে দেয়। তাই যে ব্যক্তি জাগতিক লোভণ্ডলালসা বর্জন করে দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি অবলম্বন করে, আল্লাহতায়ালা তাকে ভালোবাসেন। অনুরূপভাবে জাগতিক বিষয়াশয়ের প্রতি অনাসক্ত লোককে মানুষও ভালোবাসে। যদি কেউ বিপদাপদে লোকদের পাশে দাঁড়ায় ও সাহায্য করে, তাহলে সে মানুষের ভালোবাসা পায়।
পক্ষান্তরে যেসব লোক অন্যের কাছে হাত পাতে, তারা লোকের ভালোবাসা হারায়। তাই পার্থিব আসক্তি বর্জন করার মাধ্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টির ভালোবাসা লাভ করা সম্ভব। সাহল ইবনে সাদ সাঈদি (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবীজি (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এমন একটি কাজের কথা বলে দিন, যা করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং লোকেরাও আমাকে ভালোবাসবে।’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি অবলম্বন করো। এতে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর মানুষের কাছে যা আছে, তুমি তার প্রতি অনাসক্ত হয়ে যাও, তাহলে তারাও তোমাকে ভালোবাসবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪১০২)।
সফলতা লাভ : জীবন ধারণের জন্য সহায়-সম্পদ ও অর্থবিত্তের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু সেই প্রয়োজনের পরিমাণ ও পরিধি কতটুকু? খুব বেশি নয়। হালাল রিজিকের ওপর নির্ভর করে যদি পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবনযাপন করা যায়, তাহলেই যথেষ্ট। কিন্তু বহু মানুষ দিনরাত দুনিয়ার পেছনে ছুটে চলে। অঢেল সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বিরাম নেই। বিশ্রাম নেই। হালাল-হারামের ধার ধারে না। নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা করে না। এমন মানসিকতার লোককে সফল বলা যায় না। এসব লোক ব্যর্থ, ক্লান্ত ও শ্রান্ত। এমন লোকগুলোই কেবল সফল, যারা হালাল পন্থায় জীবনযাপন করতে পারে ও অল্পতে তুষ্ট থাকে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির ইসলাম কবুল করার সৌভাগ্য হয়েছে, যাকে প্রয়োজন পরিমাণ রিজিক দেওয়া হয়েছে এবং আল্লাহতায়ালা তাকে যে সম্পদ দিয়েছেন, এর ওপর তুষ্ট থাকার শক্তি দিয়েছেন, সে-ই সফলতা লাভ করেছে।’ (মুসলিম : ২৩১৬)।
অনিশ্চিত ভ্রমণ : জীবন মানেই অনিশ্চিত ভ্রমণ। কখন কার প্রাণপাখি উড়ে যায় ও পথচলা থেমে যায়, বলা যায় না। পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রতিটি ব্যক্তিই পথচারীর মতো। আর বুদ্ধিমান পথচারী কেবল ততটুকুই বহন করে, পথ চলার জন্য যতটুকু প্রয়োজন। মানুষের জীবন যেহেতু অনিশ্চিত ভ্রমণের মতো, তাই হাদিস শরিফে লোকদের পথিকের মতো জীবনযাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) একবার আমার দু’কাঁধ ধরে বললেন, ‘তুমি দুনিয়াতে থাক, যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথচারী।’ (বোখারি : ৬৪১৬)। মানুষের চাহিদা ও চাওয়া-পাওয়ার কোনো সীমারেখা নেই। সে যত পায়, তত চায়। একটি বাড়ির মালিক হলে, আরেকটি বাড়ির স্বপ্ন দেখে। একটি গাড়ি থাকলে, অন্য গাড়ির মালিক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করে। আপন সত্তার মধ্যে অল্পে তুষ্ট থাকার গুণ সৃষ্টি করতে না পারলে মানুষের মনে শান্তি ও স্বস্তি আসে না। উগ্র বাসনা হতে নিস্তার পাওয়া সম্ভব হয় না।
আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যদি আদম সন্তানের সোনাভরা একটা উপত্যকা থাকে, তবু সে তার জন্য দুটি উপত্যকা হওয়ার কামনা করবে। তার মুখ মাটি ছাড়া অন্য কিছুতেই ভরবে না।’ (বোখারি : ৬৪৩৯)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা