ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দান-সদকার নীতিমালা

আবদুল্লাহ নোমান
দান-সদকার নীতিমালা

পৃথিবীর কোনো পদাধিকার সহজলভ্য নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কোনো পদ লাভ করতে পারলেও যে কোনো মুহূর্তে তা হারানোর ভয় থাকে। থাকে হিংসুক ও শত্রুদের ক্ষতির আশঙ্কা। কারও পদ দীর্ঘ সময় বহাল থাকলেও বেলা শেষে তাকে পদচ্যুত হতে হয়। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছাড়তে হয় স্বাদের চাকরি। জেনে অবাক হবেন, এমন একটি পদ আছে, যা একদিকে লাভ করা যেমন সহজ, তেমনি হারানোর ভয়ও নেই আমৃত্যু। এ পদে আসীন হলে কেউ হিংসাও করে না। চরম নিন্দুকও তাকে সেই পদ থেকে সরানোর নীল নকশা আঁকে না। তাই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পদ হারানোর শঙ্কাও থাকে না। বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়লেও রিটায়্যার্ডের নোটিশ আসে না। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করা পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকা যায় নিশ্চিন্তে। হয়তো জানতে চাচ্ছেন, এ কাঙ্ক্ষিত পদের নাম কি? সেই পদের নাম হচ্ছে ‘মানবসেবার পদ’। ত্যাগ ও আত্মত্যাগের পর্যায় পেরিয়ে দান-অনুদানের স্নাতকোত্তর পাস করলে যে ডিগ্রি অর্জিত হয়, তার নাম খেদমতে খালক। আর অনন্য এ ডিগ্রিধারীর নাম হয় মানবতার সেবক। পরকালের স্বপ্নমুখর আগামীটা হাতের মুঠোয় নিতে যারা মানবসেবার মধুর প্রতিযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারাই জাতির শ্রেষ্ঠ মানব, স্বর্ণ পুরুষ। তাদের স্বর্গীয় ভাবনার ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে পরকালীন জীবন-সাফল্যের মন্ত্র। থাকে আসমানি ভালোবাসার প্রাণময় ব্যাকরণ। প্রত্যেক কাজের কিছু নীতিমালা ও নির্দেশনা থাকে। মানবসেবাও এর ব্যতিক্রম নয়। সেই নির্দেশনা অনুসরণ করে কাজ সম্পাদন করলেই মেলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল। অন্যথায় সব প- শ্রমে পর্যবসিত হতে পারে। কাজেই এ গুরুত্বপূর্ণ আমলটিরও নির্দেশনাগুলো আমাদের জানা দরকার। যাতে দান-অনুদানের যথাযথ প্রতিদান পাই। পাই এর সওয়াব বহুগুণ বর্ধিত হয়ে পরকালে।

খোঁটাযুক্ত দানে নেই প্রতিদান : দান করতে হয় শুধু আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে। তার কাছেই এর প্রতিদান পাওয়ার সৎ মানসে। পার্থিব কোনো হীন স্বার্থ চরিতার্থ করা বা কৃতজ্ঞতায় মোড়ানো স্তুতিবাক্য অর্জনের জন্য দান করা আল্লাহভীরু মোমিনের দান হতে পারে না। এমন ঘৃণ্য উদ্দেশ্যমূলক দান আল্লাহর কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেকে অসহায়কে দান করে নিজের একান্ত অনুগত এবং তার কথায় ওঠবোস করার ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে। ন্যায়-অন্যায় বাছবিচার না করে জনগণের ভোট ও সাপোর্ট হাতিয়ে নিতে পারলেই যেন দান স্বার্থক। পরে যখন সেই মতলববাজ দাতা আশানুরূপ ফল না পায়, তার প্রত্যাশা বুমেরাং হয়, চাওয়াটা পাওয়ায় রূপান্তরিত না হয়, তখন রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়ে। আর পদে পদে দানের খোঁটা দিয়ে বসে। হৃদয় বিদীর্ণ করে দেয় কটু কথা ও তীর্যক ভাষায়। আফসোস, সেই অভাগা দাতা দানের খোঁটা দিয়ে একদিকে যেমন দানের বিশাল নেকি থেকে বঞ্চিত হয়, তেমনি মানুষকে কষ্ট দেওয়ার মতো কঠিন পাপেও লিপ্ত হয়। মনে রাখতে হবে, দান পরবর্তী খোঁটায় দানকৃত পাহাড়সম সোনাদানাও হারিয়ে যায় বানে ভেসে যাওয়া খড়-কুটোর মতো। বঞ্চিত হতে হয় রাশি রাশি সওয়াব ও ভারি ভারি নেকি থেকে। মনুষ্যত্বের প্রাচীর ডিঙিয়ে দানের খোঁটা দেওয়া নিচু মানুষদের নিকৃষ্ট অভ্যাস। এটাই দানে ইখলাস শূন্যতার নির্ভেজাল প্রমাণ। এমন দানে সওয়াবের আশাও অমূলক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা কত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় এ কাজ থেকে আমাদের নিষেধ করেছেন, ‘হে মোমিনগণ! খোঁটা ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদকাকে সেই ব্যক্তির মতো নষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এমন, যেমন এক মসৃণ পাথরের ওপর মাটি জমে আছে; অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং তা (সেই মাটিকে ধুয়ে নিয়ে যায় এবং) সেটিকে (পুনরায়) মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে, তার কিছুমাত্র তারা হস্তগত করতে পারে না।’ (সুরা বাকারা : ২৬৪)।

দরিদ্রদের সঙ্গেও সদ্ব্যবহার কাম্য : ধনীদের আল্লাহতায়ালা ধন দিয়েছেন অনুগ্রহ করে। তাই তাদের উচিত, গরিবদের নিঃস্বার্থভাবে দান করা। অনেক ধনকুবের দান করে কল্পনার স্বর্গরাজ্যের বিচরণ করে। আর নিজেকে অলংকৃত করে মহাদানবীরের সুউচ্চ আসনে। তারা মনে করে, দান গরিবদের প্রতি এহসান। তাই পান থেকে চুন খসলেই গরিবদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করে। গালিগালাজ করে অকথ্য ভাষায়। তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে মারমুখো হয়ে যায়। অনেক দাম্ভিক জালেম মানবেতর জীবন যাপনকারী অসহায় মানুষদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না। ভাগ্যের লিখনী গরিব হওয়ার অপরাধে চালায় নির্যাতনের স্টিমরোলার। পথচারীরাও সাগর তীরের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। যেন ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই নির্বিকার। ভাবে, গায়ে পড়ে ঝামেলায় জড়ানোর কী দরকার! কেউ কেউ সামান্য কয়টা টাকা দান করে মনে করে, গরিবের প্রতি যারপরনা-ই অনুগ্রহ করেছে। তাই তাদের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতামূলক আচরণ করা যেন তার প্রাপ্য অধিকার। দান নয় যেন অপমানের বিস্ফোরিত বারুদ। সহযোগিতা নয় যেন অসম্মানের বিষাক্ত ত্রাণ। যেন পার্থিব জীবনে অসহায়দের ভাগ্যলিপিই হলো ব্যর্থতা আর বঞ্চনা। কুখ্যাত মানবরূপী দানবগুলো নিজেকে মনে করে শুধুই উৎকৃষ্ট আর গরিবকে ভাবে অতি তুচ্ছ। অথচ ইসলামে গরিবদের সঙ্গে ধমকের সুরে কথা বলাও নিষেধ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না এবং সাহায্যপ্রার্থীকে ধমকাবেন না।’ (সুরা দোহা : ৯-১০)।

দান-সদকা গরিবের হক : আমরা কি এমনটা ভাবতে পারি না যে, অসহায় মানুষগুলো দান গ্রহণ করে মূলত আমাদের প্রতিই এহসান ও করুণা করে! কেননা, তারা দান গ্রহণ করে বলেই মানবসেবার মহাসৌভাগ্য আমরা অর্জন করতে পারি। তারা সদকা নেয় বলেই আমরা এর অবারিত কল্যাণ ও নেকি লাভ করতে পারি! তা ছাড়া দান-অনুদান গরিব-দুঃখীর হক, তাদের প্রাপ্য। এমনটিই বলছে কোরআনে কারিম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যাদের সম্পদে নির্ধারিত হক (অধিকার) রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের।’ (সুরা মাআরিজ : ২৪-২৫)। সুতরাং কোনো হকদারকে যদি তার হক কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তা কি তার প্রতি করুণা মনে করা হয়? নিশ্চয় না। তাই দান করতে পেরে অহংকার নয়; বরং দান গ্রহণ করায় গরিবের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়াই শুভবুদ্ধির পরিচয়। খেদমতে খালকের তৌফিক হওয়ায় রবের দরবারে সেজদাবনত হওয়া এবং কৃতজ্ঞতায় ন্যুয়ে পড়াই কাম্য। স্রষ্টার দেওয়া ধন স্রষ্টার আদেশে সৃষ্টিকে অর্পণ করার মধ্যে নিজের কী কৃতিত্ব আছে? সব সৃষ্টিকর্তারই একান্ত করুণা ও দয়া বৈ কী? দৃশ্য-অদৃশ্য সব নেয়ামত তার অনুগ্রহের সূত্রে প্রাপ্ত। বস্তুত ধনবল, জনবল ও বাহুবল নিয়ে গর্ব করা চরম বোকামি ও নির্বুদ্ধিতা। এসবের মাঝে কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব শুধু স্রষ্টার পরিচয় লাভের মধ্যে; তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্যে; তার সঙ্গে মধুময় সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্যে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদের এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)।

আত্মীয়দের দানে মেলে দ্বিগুণ নেকি : অনেক ধনবান দূরের মানুষকে মুক্তহস্তে দান করলেও নিজের গরিব-আত্মীয়স্বজনের দিকে মোটেও খেয়াল রাখে না। তাদের হালপুরসিও করে না। কালেভদ্রে সাক্ষাৎ হলে আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজন অনুভব করে না ঘুণাক্ষরেও। বিপদে-দুর্যোগে তাদের আগলে রাখে না বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে। দানে-অনুদানে পাশে দাঁড়ায় না স্বতঃস্ফূর্তভাবে। অথচ দান-সদকায় নিকটাত্মীয়দেরই প্রাধান্য দেওয়া ইসলামের শিক্ষা। এতে যেমন আত্মীয়তার সম্পর্কটা সুদৃঢ় ও সুসংহত হয়, তেমনি মানবিকতা ও দয়াদ্রতার চর্চাও হয় চমৎকারভাবে। বৃদ্ধি পায় পরস্পরের প্রতি হৃদ্যতা ও ভালোবাসার টান। ফোটে প্রীতি ও সম্প্রীতির সুরভিত ফুল। ভাঙে অনভিপ্রেত ঝগড়া-বিবাদ ও মনোমালিন্যের শত ভুল। মজার বিষয় হলো, আত্মীয়দের দান করাকে দ্বিগুণ সওয়াব লাভের মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রিয় নবী (সা.)। এর প্রতি আমাদের উৎসাহিত করেছেন নববি ভাষ্য ব্যঞ্জনায়। বলেছেন, ‘মিসকিনকে দান করলে শুধু দান করার সওয়াব লাভ হয়। আর আত্মীয়-স্বজনকে দান করলে দুটি সওয়াব-দান করার সওয়াব এবং আত্মীয়তার হক আদায় করার সওয়াব।’ (তিরমিজি : ৬৫৮)। তবে আত্মীয়দের বেলায় শুধু উদার হস্ত আর অপরাপর ছিন্নমূল হতদরিদ্রদের ক্ষেত্রে চরম কৃপণ; এটাও নিন্দনীয়। বরং যদি নিজের স্বজনদের চেয়ে অন্যদের অভাব ও প্রয়োজন বেশি দেখা দেয়, তখন তাদের দিকেও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে সাহায্যের হাত বাড়ানো বাঞ্ছনীয়।

দান হোক স্বপ্রণোদিত ও স্বতঃস্ফূর্ত : দানে ধন বাড়ে, বালা দূরে সরে; কে না জানে? তাই বলে কি শুধু বালা-মসিবতে পড়লেই দানের প্রতি মনোযোগী হব? সুখের সময় গরিব-দুঃখীদের বেমালুম ভুলে থাকব? আনন্দের বসন্তকালে কৃপণতার ভাঙা চেয়ারে বসে দখিনা বাতাস খাব আর নির্লজ্জের মতো রাতদিন ভোগবিলাসে মত্ত থাকব, তা কি হয়? না, ইসলাম আমাদের এমন শিক্ষা দেয় না। ইসলাম বলে, দান কারও সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, স্বচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, সব সময়, সর্বাবস্থায়। অবশ্য আর্থিক অবস্থার ব্যবধানে দানের মানে ও পরিমাণে পার্থক্য হতে পারে। তাই প্রত্যেকের উচিত, সাধ্য অনুযায়ী অল্প হলেও দান করা। দানের পুণ্যময় ধারা যতটুকু সম্ভব জারি রাখা। কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল (সর্বাবস্থায় আল্লাহর জন্য অর্থ) ব্যয় করে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩৪)।

দান করার শ্রেষ্ঠ সময় : জানেন কি, মানুষ যখন সুস্থ-সবল থাকে, থাকে সম্পদের প্রতি প্রবল আকর্ষণ, কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সঞ্চয় করে রাখতে মনে চায়, এ আকর্ষণকে জলাঞ্জলি দিয়ে, মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে যখন সে কষ্টার্জিত সম্পদ দান করতে পারে হাসিমুখে, তখন সে হয় শ্রেষ্ঠ দানবীর। এ দান আল্লাহতায়ালার খুব পছন্দনীয়। এটিই দান-সদকার শ্রেষ্ঠ সময়, মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত; এক লোক এসে রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, ‘কখন দান করা উত্তম?’ তিনি বললেন, ‘যখন তুমি (অতি প্রয়োজন বা লোভের কারণে) মাত্রাতিরিক্ত মিতব্যয়ী বা হাড়কিপটে হও এবং সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা কর অথবা যখন তুমি সুস্থাবস্থায় দীর্ঘায়ুর প্রত্যাশা করো, তখন সদকা করা। এত দেরি করো না যে, মৃত্যু এসে যায় আর তখন তুমি (অসিয়ত করে) বলছ, আমার সম্পদগুলো অমুকের জন্য, অমুকের জন্য! অথচ (তুমি না বললেও) তা তাদের জন্য হয়েই আছে।’ (মুসনাদে আহমদ : ৯৭৬৮)।

লেখক : সিনিয়র মুফতি, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম, কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত