ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হালাল ব্যবসা যেভাবে হারাম

ইসমাঈল হুসাইন
হালাল ব্যবসা যেভাবে হারাম

মহান আল্লাহ মানবজাতির জন্য যখন কোনো কিছু হালাল করেছেন, তখন তা ব্যাপকার্থে ব্যবহার করেছেন। আর যখন কোনো কিছু হারাম করেছেন, তখন একটা একটা নাম ধরে নির্দিষ্ট করে হারাম করেছেন। আর যখন আল্লাহতায়ালা কোনো একটা হারাম করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে এর বিকল্পে অন্যকিছু নির্ধারণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ- জিনা বা ব্যভিচার করা হারাম। এর বিকল্পে বিয়ে হালাল ইত্যাদি। অনুরূপভাবে আল্লাহতায়ালা সুদ হারাম করেছেন। এর বিকল্পে ব্যবসা হালাল করেছেন। আল্লাহতায়ালা যা হালাল সাব্যস্ত করেন, কারও সাধ্য নেই তা হারাম করার। আর যা হারাম করেছেন, কারও সাধ্য নেই তা হালাল করার। অতএব, মানুষ ব্যবসা করতে গিয়ে যদি তাতে হারামের মিশ্রণ ঘটায়, তাহলে ব্যবসা হালাল হলেও তা হারামে রূপ নেয়। আর যে ব্যক্তি এমনটা করবে, আল্লাহতায়ালা তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা সুদ খায়, তারা তার ন্যায় (কবর থেকে) উঠবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়। এটা এ জন্য যে, তারা বলে, ব্যবসা সুদের মতো। অথচ আল্লাহ ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতএব, যার কাছে তার রবের পক্ষ থেকে উপদেশ আসার পর সে বিরত হলো, যা গত হয়েছে তা তার জন্য ইচ্ছাধীন। আর তার ব্যাপারটি আল্লাহর ওপর ন্যাস্ত। আর যারা ফিরে গেল, তারা আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫)।

বর্তমান ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ভেজাল সংযুক্তকরণ, প্রতারণা ও মিথ্যা শপথের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ব্যবসার বিভিন্ন ক্ষেত্র রয়েছে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাধারণ পদ্ধতিতে কিংবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে হারামের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নাপাক অর্থ উপার্জনে ব্যবসায়ী ভাইয়েরা খুব বেশি তৎপর। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবসায় লিপ্ত আছেন। সারাদিন পরিশ্রম করেন অর্থের তাগিদে। পরিশ্রমটা যদি বিফলে যায়, তাহলে এর মূল্য কি-ই বা আছে? হালাল উপার্জনের তাগিদে ব্যবসায় লিপ্ত আছেন এবং পরিশ্রম শেষে অর্থ ও খাদ্য নিয়ে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু পরিশ্রমের টাকা হারাম উপায়ে অর্জিত হওয়ার ফলে সম্পূর্ণ অর্থ ও খাদ্যগুলো কোনো হালাল কাজের পরিচয় বহন না করে হারাম কাজের পরিচয় বহন করে থাকে। পরকালে যখন উপস্থিত হবেন, তখন দেখবেন, সব উপার্জনই ছিল হারাম। যে উপার্জন ছিল পরিশ্রমের কষ্টিপাথরে গড়া, তা আমলনামার খাতায় সওয়াবের পরিবর্তে হারাম লেখা থাকা। মুহূর্ত বড়ই বিষাদের হবে সেদিন। আর ওই মুহূর্তে দুঃখ-আফসোস করেও কোনো কাজে আসবে না। নবীজি (সা.) বলেন, ‘এমন এক যুগ আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে, সে কোথা হতে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল হতে না হারাম হতে।’ (বোখারি : ২০৫৯)। তাই ইসলাম আমাদের এ সম্পর্কে কী তথ্য পরিবেশন করেছে ও ব্যবসার ক্ষেত্রে আমাদের কোন কোন বিষয়ের প্রতি সঠিক জ্ঞান রাখতে হবে, সে অনুযায়ী আমল করার ফলাফল জানার চেষ্টা করি। এ পর্যায়ে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর বৈশিষ্ট্যের চিত্র তুলে ধরা হলো। যার ফলে উক্ত ব্যবসা হালাল থেকে হারামে রূপ নিচ্ছে।

প্রথম বৈশিষ্ট্য : মহান আল্লাহ বলেন, ‘মন্দ পরিণাম তাদের, যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পুরো মাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য মাপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন : ১-৩)। এ আয়াতের শিক্ষা হলো, ওজনে কম না দেওয়া। এ আয়াতে হুঁশিয়ারির মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা আমাদের সতর্ক করেছেন, যেন আমরা মাপে কম না দিই। যখন ব্যবসায়ীরা নিজেরা পণ্য ক্রয় করেন, তখন পূর্ণ মাত্রায় তা ওজন করে নেন। কিন্তু অন্যকে বিক্রির সময় ওজন কমিয়ে দেন। এটা চরম প্রতারণা ও অন্যের হক নষ্ট করা। বর্তমানে এ রোগটা এত বেশি প্রচলিত, যার থেকে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা দুরূহ। আপনি যখন কোনো ক্রেতাকে পণ্য বিক্রি করেন, তখন ওজনের সময় একটি চালের দানা পরিমাণও যদি কম দেন, তা আপনার ওপর ততক্ষণ পর্যন্ত হক থেকে যাবে, যতক্ষণ না তাকে তার হক পূর্ণ করে দেন কিংবা সে আপনাকে ক্ষমা করে দেন। অন্যথায় কেয়ামতের দিন তার হক পরিশোধ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে নিশ্চিত। আর তা কখনও পণ্যের মাধ্যমে হবে না, বরং আপনার আমলের বিনিময়ে পরিশোধ করা হবে। কেননা, সেখানে কোনো পণ্যের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকবে না। ওজনে কম দেওয়া ও ঠকানোর মাধ্যমে একজন ক্রেতার হক নষ্ট করা হয়; যা তার অধিকার। ক্রয়কৃত প্রতিটি দানা ক্রেতার সম্পদ। একটি দানার মাধ্যমেও প্রতারণা করা হলে তা অবশ্যই তার সম্পদ নষ্ট করা হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেও না। তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা।’ (সুরা নিসা : ২৯)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের ন্যায়পন্থা, অনুগ্রহ ও নিকটাত্মীয়দের হক প্রদানের নির্দেশ দেন এবং অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে নিষেধ করেন।’ (সুরা নাহল : ৯০)।

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য : কিছু ব্যবসায়ীর মধ্যে অন্য একটা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তা হলো জুলুম করা। অর্থাৎ একটা পণ্য ১০০ টাকায় ক্রয় করে তা বহুগুণ দাম বৃদ্ধি করে বিক্রি করা। নিশ্চিত একজন ক্রেতার ওপর এটা বড় জুলুম। জুলুমের হাজার প্রকার-পদ্ধতি থাকতে পারে। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জুলুমের শিকার হতে পারে। কিন্তু জুলুম শুধু জুলুমই হয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জালেমরা কখনও সফলকাম হয় না।’ (সুরা আনআম : ৫৭)। তিনি আরও বলেন, ‘অচিরেই জালেমরা জানতে পারবে, তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল কোথায় হবে।’ (সুরা শুআরা : ২২৭)। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! আমি আমার জন্য জুলুম হারাম করেছি। আর জুলুম তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও হারাম করেছি। অতএব, তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম কোরো না।’ (মুসলিম : ৬৭৩৭)।

তৃতীয় বৈশিষ্ট্য : পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে পণ্য বিক্রি করা অন্যতম জঘন্য প্রতারণা। বিশেষত এ প্রতারণা করার টেকনিক হলো, ১০টা ভালোর মধ্যে ১-২টা ত্রুটিযুক্ত পণ্য চালিয়ে দেওয়া; যা সাধারণত আলাদা করে বিক্রি করা সম্ভব নয়। এ ধরনের প্রতারণাও নিষিদ্ধ। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে (বরং গোপন করে) বিক্রয় করে, সে সর্বদা আল্লাহর গজবের মধ্যে থাকে। ফেরেশতারা সব সময় তাকে অভিশাপ করতে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৪৭)। এছাড়া পণ্যের ত্রুটি গোপন করার মধ্য দিয়েও ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত কমে যায়। নবীজি (সা.) বলেন, ‘ক্রেতা-বিক্রেতা যতক্ষণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হয়, ততক্ষণ তাদের এখতিয়ার থাকবে (ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা বা বাতিল করা)। যদি তারা সত্য বলে এবং অবস্থা ব্যক্ত করে, তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি মিথ্যা বলে এবং দোষ গোপন করে, তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত মুছে ফেলা হয়।’ (বোখারি : ২০৭৯)।

চতুর্থ বৈশিষ্ট্য : মিথ্যা শপথ গ্রহণের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা। এ জুয়াচুরি বিষয়টা সবচেয়ে বেশি মাত্রায় লক্ষ্য করা যায় কাপড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে এর মাত্রা আরও তীব্রতর রূপ ধারণ করে যখন রমজান মাস উপস্থিত হয়। ঈদের কেনাকাটা অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে, তারা এর সুযোগ ব্যবহার করে বেশি অর্থ আয়ের জন্য অসৎ পথ অবলম্বন করে থাকেন। ভিন্ন ভিন্ন কথার কারিশমা দিয়ে বলে, ভাই! আমার এ জিনিসটার ক্রয়মূল্য এত টাকা, আপনাকে এত টাকা দিতে হবে; না হয় আমাদের লোকসান হবে। অথবা বলে, আপনাকে একবারে কেনা দরে দিয়ে দিচ্ছি ইত্যাদি। মিথ্যা মানবতাবোধকে লোপ করে, নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়। মিথ্যাবাদীর ওপর আল্লাহর অভিশাপ। মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামত দিবসে আল্লাহ তিন ব্যক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন হলো, যে তার ব্যবসায়িক পণ্য মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে।’ (মুসলিম : ১০৬)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত