যিনি সর্বপ্রথম জমি আবাদ করেছেন, তিনিই ওই জায়গার মালিক। পতিত জমির ব্যাপারে রাসুল (সা.) প্রাচীন রীতি বহাল রাখেন। যার ভিত্তিতে দুনিয়ার জমির মালিকানা তৈরি হয়েছে। পৃথিবীতে মানুষের বসবাসের শুরু থেকে এ নিয়ম চলে আসছে। যে ব্যক্তি যে উপায়ে ব্যবহারের উপযোগী করেছে, তা কাজে লাগানোর অধিকার তার। প্রকৃতির সব অবদানের ওপর মানুষের মালিকানার অধিকারের এটাই নীতি। এ নীতিতে পাহাড়-পর্বতে, বন-জঙ্গলে ও মরুভূমিতে মানুষের ভূমির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাসুল (সা.) বিভিন্ন সময়ে নিজের বক্তব্যের মাধ্যমে এ কথার সমর্থন করেছেন। উরওয়া ইবনে যুবায়ের (রা.) বলেছেন, ওমর (রা.) তার খেলাফতকালে এর ওপর আমল করেছেন। (বোখারি : ২৩৩৫)। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মৃত (অনাবাদি) ভূমি জীবিত (আবাদযোগ্য) করেছে, সে জমি তার।’ (তিরমিজি : ১৩৭৯)।
আবাদকারীই হবে জমির মালিক : সাঈদ ইবনে যায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত; নবীজি (সা.) বলেন, ‘কেউ কোনো পতিত জমি আবাদ করলে সেটা তার। অন্যায়ভাবে দখলকারীর পরিশ্রমের কোনো মূল্য নেই।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩০৭৩)। ইয়াহইয়া ইবনে উরওয়াহ (রহ.)-এর পিতার সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো অনাবাদি জমি আবাদকারীই হবে ওই জমির মালিক।’ এরপর উরওয়াহ (রহ.) বলেন, যিনি আমাকে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন, তিনি আমাকে আরও জানিয়েছেন, দুই ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে তাদের বিবাদের মীমাংসার জন্য এলো। তাদের একজন অন্যজনের জমিতে একটি খেজুরগাছ লাগিয়েছিল। তিনি জমির মালিকের পক্ষে জমি তারই বলে রায় দিলেন। আর খেজুরগাছের মালিককে জমি থেকে গাছ তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি দেখলাম, গাছটির গোড়ায় অবিরত কোদাল পড়ছে। গাছটি খুব লম্বা ছিল। অতঃপর গাছটি সেখান থেকে তুলে ফেলা হয়। (সুনানে আবি দাউদ : ৩০৭৪)। উরওয়াহ (রহ.) বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, রাসুল (সা.) ফয়সালা করেছেন, জমিন আল্লাহর, বান্দাও আল্লাহর। যে ব্যক্তি পতিত জমি আবাদ করবে, সে-ই এর অগ্রাধিকারী প্রাপক। (সুনানে আবি দাউদ : ৩০৭৬)।
রাষ্ট্রের অনুমতির প্রয়োজন নেই : কিন্তু পতিত জমি অধিকারের পর তিন বছর অনাবাদি ফেলে রাখলে সেই অধিকার ইসলামি সরকার কেড়ে নিতে পারে। সালেম বিন আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেছেন, ওমর (রা.) মিম্বরে উঠে এক ভাষণে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো পতিত অনাবাদি জমিকে চাষাবাদযোগ্য করে, সে জমি তার। কিন্তু অনাহুতভাবে যারা জমি আটকে রাখে, তিন বছর পর এতে তার কোনো অধিকার থাকবে না।
সে সময় কেউ কেউ কোনো চাষাবাদ না করে এমনিতেই জমি আটকে রাখত; এ কারণে এ ঘোষণা দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।’ (আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ)। এ ব্যাপারে ইসলামি আইনজ্ঞরা একমত। তবে মতভেদ হলো, আবাদযোগ্য করার দ্বারাই কি কোনো ব্যক্তি পতিত জমির মালিক হয়ে যায়? অথবা মালিকানা প্রমাণের জন্য সরকার থেকে অনুমতির প্রয়োজন আছে? এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) রাষ্ট্রের অনুমতির প্রয়োজন মনে করেছেন। কিন্তু ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.), ইমাম শাফেঈ (রহ.) ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহ.) প্রমুখের মত হলো, এ সম্পর্কে হাদিস একেবারেই সুস্পষ্ট। তাই আবাদকারীর মালিকানার অধিকারের জন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর দেওয়া হক অনুযায়ী আবাদকারী এ জমির মালিক হয়ে যাবে।
জমি যে নির্দেশের অধীন নয় : এরপর ব্যাপারটা যখন রাষ্ট্রের কাছে পেশ করা হবে, তখন এ কাজ হবে আবাদকারীর হককে মেনে নেওয়া। আর যদি এ নিয়ে কলহ বাঁধে, তাহলে রাষ্ট্র তার হকই বলবৎ রাখবে।
ইমাম মালিক (রহ.) জনবসতির নিকটবর্তী জমি ও দূরবর্তী অনাবাদী জমির মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তার মতে, প্রথম প্রকারের জমি এ নির্দেশের আওতাধীন নয়। আর দ্বিতীয় প্রকারের জমির জন্য অনুমোদন শর্ত নয়। শুধু আবাদ করার মাধ্যমেই আবাদকারী এ জমির মালিক হয়ে যাবে। (ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা : ৩৬ ৩৭; আবু উবায়েদ, কিতাবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা : ২৮৫-২৮৯)।