ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

‘নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা’

আফজাল হুসাইন
‘নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা’

ট্রাফিক সিগন্যালে অপেক্ষারত প্রাইভেট কার। গ্লাসে টুক টুক শব্দ। জামিল সাহেব দৃষ্টি ফেরালেন। বুড়ো বয়সি একজন ভিক্ষুক। হাত বাড়িয়েছে সাহায্যের আশায়। এই দৃশ্য ঢাকা শহরে নিত্যদিনের। তবু অজানা কারণে আজ জামিল সাহেবের মনটা গলে গেল। পকেট থেকে ১০ টাকার একটি নোট বের করলেন। বড় মায়াভরে তার হাতে তুলে দিলেন। লোকটা ইশারায় শোকরিয়া আদায় করল। জামিল সাহেব তাকিয়ে আছেন। দেখলেন, সে অন্য গাড়ির দিকে এগোলো। কিছুক্ষণ পর আবার ঠক ঠক। শব্দটা তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটাল। তাকিয়ে দেখেন, অল্প বয়সি একটা ছেলে। হাতে পুরোনো বাটি। সাহায্যের আশায় তাকিয়ে আছে।

এমন বহু রূপ পথেঘাটে, স্টেশনে, বাস-টার্মিনালে, দিনরাতে। সর্বত্রই চোখে পড়ে তার বিভিন্ন বয়স ও বেশের ভিক্ষুক। জামিল সাহেব কী করবেন! ভাবছেন, কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। কী ভেবে আবার চুপ হয়ে গেলেন।

নাহ, ওকে বলে কাজ হবে না। বিষয়টা নিয়ে গভীর ভাবনায় পড়ে গেলেন। এভাবে কত মানুষ পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিশু, কিশোর-কিশোরী, বয়োবৃদ্ধ নারী-পুরুষ। তারা অসহায় হয়ে এমনটা করছে, নাকি স্বভাবদোষে ভিক্ষার পথ বেছে নিয়েছে! জামিল সাহেবের মনে কৌতূহল।

পড়ন্ত বিকাল। অফিস সেরে তিনি রাস্তায় নামলেন। কয়েকজন ভিক্ষুকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাদের কিছু টাকা দিয়ে এক পাশে ডেকে আনলেন। এবার নিজের কৌতূহল তাদের সামনে ঝাড়লেন। জানতে পারলেন, বিভিন্ন কারণে তারা এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।

সবটা শুনে জামিল সাহেবের মনে পড়ল গত জুমার বয়ানের কথা। খতিব সাহেবের কণ্ঠে শুনেছিলেন, ‘আল্লাহ বিত্তবানদের সম্পদে সাহায্যপ্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক রেখেছেন।’

খতিব সাহেব বিষয়টি দারুণভাবে উপস্থাপন করেছিলেন, ‘ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক অসহায়, অভাবী ও ভিক্ষুক দেখা যায়। যারা খুবই কষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অবশ্য কেউ কেউ এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে সে সংখ্যা খুবই নগণ্য। বেশির ভাগ জীবিকার অভাবে রোগে-শোকে বিপণ্ণ হয়ে অন্যের কাছে হাত পাতছে। এসব অভাবীর সাহায্যে এগিয়ে আসা ও তাদের ভিক্ষাবৃত্তি থেকে উদ্ধার করা বিত্তবানদের অবশ্য কর্তব্য। এজন্য উত্তম পন্থা হলো, কাউকে সেই পরিমাণ সাহায্য করা, যাতে সে কোনো একটা কাজ শুরু করতে পারে, যা থেকে তার নিত্যদিনের আয়ের একটা ব্যবস্থা হয়ে যায়; একদিন সেও অন্যকে সাহায্য করার মতো সাবলম্বী হয়।’

খতিব সাহেব আরো বলেছিলেন, ‘রাসুল (সা.) ভিক্ষাবৃত্তিকে বারণ করেছেন। সামর্থ্যানুযায়ী পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। যেমন একদিন এক লোক এসে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! আমার ঘরে খাবার নেই, আমাকে কিছু সাহায্য করুন। রাসুল (সা.) বললেন, তুমি ভিক্ষা ছেড়ে কাজ করে জীবিকা উপার্জন করো। লোকটি বললো, আমার তো তেমন কিছু নেই। রাসুল (সা.) বললেন, তোমার ঘরে কী আছে? লোকটি বলল, একটি কম্বল আছে। রাসুল (সা.) বললেন, সেটি বাজারে নিয়ে বিক্রি করে একটি কুঠার কিনে নাও। তারপর তা দিয়ে গাছ কেটে কেটে তোমার জীবিকা নির্বাহ করো। এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে, যার মাধ্যমে রাসুল (সা.) উম্মতকে কষ্ট করে জীবিকা উপার্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। (তিরমিজি : ১২১৮)।’

খতিব সাহেবের কথাগুলো বারবার কানে বাজছে জামিল সাহেবের। তিনি ভাবছেন, যাদের কিছু নেই, তাদেরকে কীভাবে উপার্জনের জন্য উপযুক্ত করা যায়! একদিন তার এক বন্ধু বললো, ‘তুমি প্রতিদিন এভাবে দশ-বিশ টাকা ভিক্ষুককে দিয়ে কোনো লাভ নেই। এতে ভিক্ষুক সারাজীবন ভিক্ষুকই থেকে যাবে। তুমি বরং একটা কাজ করতে পারো, তোমার আশপাশে যেসব ভিক্ষুক আছে, তাদেরকে কোনো একটা কাজ করার মতো কিছু করে দাও। যেমন ধরো, একজনকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দিলে, আরেকজনকে একটা রিকশা কিনে দিলে, আরেকজনকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে।’

আইডিয়াটা জামিল সাহেবের বেশ মনে ধরলো। পণ করলেন, আজ থেকে আর দশ-বিশ টাকা ছিটাবেন না। জাকাতের টাকাগুলো পরিকল্পনা করে গুছিয়ে রাখবেন। প্রতি বছর কয়েকজন ভিক্ষুককে বাসায় দাওয়াত করে খাওয়াবেন। এরপর আয় করার মতো কিছু একটা কিনে দেবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। বছর ঘুরে এলো। জামিল সাহেব তার পরিকল্পনামাফিক কাজ করলেন। তার এলাকা থেকে দূর হতে লাগলো ভিক্ষাবৃত্তি। কর্মমুখর হতে লাগলেন সব শ্রেণি-পেশা, বয়সি লোকজন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত