হালাল খাবারে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। দেশের কল্যাণ হয়। মানুষের পেটে যা পড়ে, আচরণে তার প্রভাব থাকেই। শরীরের সঙ্গে যা আহার্য হিসেবে মিশে যায়, বাহ্যিকভাবেও তার বিরাট ক্রিয়া পরিদৃশ্যমান হয়। কোনো এক আলেম বলেন, ‘যখন হালাল ভক্ষণ ও হালাল অন্বেষণ বেড়ে যায় এবং মানুষ সন্দেহজনক জীবিকা থেকে দূরে থাকা বাড়িয়ে দেয়, তখন সৎ ও আল্লাহভীরু মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। যে অঞ্চলে হালাল খাবারের প্রচলন বেশি, সে অঞ্চলে সৎলোকের সংখ্যাও অধিক। এর উল্টো হলে, পরিণামও উল্টো হয়।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুলরা! তোমরা পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর ও সৎকর্ম কর।’ (সুরা মোমিনুন : ৫১)। এ আয়াতে হালাল ও পবিত্র বস্তু ভক্ষণের কথা আগে বলা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, হালাল ভক্ষণের সু-ক্রিয়ায়ই ভালো কাজের আগ্রহ জন্মে। কারণ, হালাল ও পবিত্র আহার্য শরীর ও মন শুদ্ধ করে। ফলে কর্মও শুদ্ধ হয়। এর বিপরীতে হারাম ও অপবিত্র আহার্য শরীর ও মন অশুচি করে। ফলে কর্মও অশুদ্ধ হয়।
হালালের প্রতি শরিয়তের গুরুত্বারোপ : হৃদয়-মন পরিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে খাদ্য, পানীয়, পোশাক, সাজসজ্জা ও ওষুধ হালাল হওয়ার বিরাট প্রভাব রয়েছে। এগুলো হালাল হলে মানুষের দিব্যদৃষ্টি শক্তিশালী হয়; বরং ইবাদত ও দোয়া কবুল হওয়া খাদ্য হালাল হওয়ার সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, ‘রাসুলরা ও তাদের জাতিরা হালাল ও পবিত্র খাবার গ্রহণ ও সৎকর্মে আদিষ্ট। আমল কবুল হওয়ার জন্য খাবার হালাল হওয়া পূর্বশর্ত। তাহলে খাবার হালাল না হলে, আমল কীভাবে কবুল হবে রবের দরবারে?’
খাবার হালাল হওয়ার আবশ্যকীয়তা : মুসলিম শরিফে আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে একটি বর্ণনা আছে, ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য খাবার হালাল হওয়ার আবশ্যকীয়তার ওপর যা সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। তিনি মোমিনদেরও সেই আদেশ করেছেন, কোরআনে যে আদেশ করেছেন তার রাসুলদের। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে রাসুলরা! পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর ও সৎকর্ম কর।’ (সুরা মোমিনুন : ৫১)। মোমিনদের লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ‘হে মোমিনরা! আমার দেওয়া রিজিক থেকে পবিত্র বস্তু ভক্ষণ কর।’ (সুরা বাকারা : ১৭২)। এরপর রাসুল (সা.) এমন এক ব্যক্তির আলোচনা করলেন, যে দীর্ঘ সফর করেছে। চুল উষ্কখুষ্ক। বদন ধূলিমলিন। সে আকাশের দিকে হাত প্রসারিত করে ডাকে, ‘হে আমার রব! হে আমার রব!’ কিন্তু তার খাদ্য হারাম। পানীয় হারাম। পরিধেয় হারাম। লালিত-পালিতও সে হারাম খাবারে। ফলে কী করে তার দোয়া কবুল হতে পারে? (মুসলিম : ১০১৫(। শরিয়তে মুহাম্মদির অনন্য বৈশিষ্ট্য ও রাসুল (সা.)-এর দায়িত্ব উল্লেখ করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তুকে হারাম করে।’ (সুরা আরাফ : ১৫৭)।
খাবার হালাল রাখায় ইসলামের অনন্য ব্যবস্থাপনা : মুসলমানদের খাবার হালাল হওয়ার ব্যাপারে ইসলামি শরিয়ত যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। যেসব প্রাণী হালাল, তার জবাইয়ের রয়েছে বিশেষ পদ্ধতি। শরিয়ত জবাই শুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্তারোপ করেছে। দেখিয়ে দিয়েছে কিছু রীতি-পদ্ধতি ও সৌন্দর্য। জবাইকারীকে হতে হবে বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন। জবাইটাও সম্পন্ন হতে হবে বিশেষ পদ্ধতিতে। ভালোভাবে রক্তক্ষরণ হতে হবে। কাটতে হবে কণ্ঠনালী, খাদ্যনালী ও দুই শাহরগ। জবাই করতে হবে ধারালো যন্ত্র দিয়ে। সুন্দরভাবে জবাই করতে হবে। জবাইকৃত প্রাণীর প্রতি প্রদর্শন করতে হবে কোমলতা। পাশাপাশি শরিয়ত সব ধরনের মৃত প্রাণী হারাম সাব্যস্ত করেছে। যেমন- শ্বাসরোধে মৃত প্রাণী, প্রহারে মৃত প্রাণী, পতনে মৃত প্রাণী, শৃংগাঘাতে মৃত প্রাণী, হিংস্র পশুতে খাওয়া প্রাণী, মূর্তিপূজার বেদির ওপর বলি দেওয়া প্রাণী, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে জবাইকৃত প্রাণী। হ্যাঁ, কেউ যদি অনন্যোপায়, কিন্তু অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্য আবার এসব বৈধ রয়েছে। এসব সূক্ষ্ম বিধান শুধু মুসলমানদের পেটে যা প্রবেশ করবে, তা হালাল ও পবিত্র রাখার স্বার্থেই।
আধুনিক যুগে চাই অধিকতর সচেতনতা : এখন আধুনিকতার যুগ। প্রশংসিত কিছু অগ্রগতি এ যুগে সাধিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা এ যুগে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন অনেক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ। এ উন্নতি ও অগ্রগতির ছোঁয়া লেগেছে খাদ্য, ওষুধ ও প্রসাধনী প্রস্তুত করার ক্ষেত্রেও। এগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন রসায়নিক পদার্থ। হালাল ও পবিত্রতার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন তাই আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অধিক গুরুত্বের দাবি রাখে।
হালাল খাবারের উপকারিতা : হালাল খাবার বিপর্যয় প্রতিরোধ করে। জীবন, সম্পদ, সন্তান, কর্ম ও দেশের থেকে বিপদাপদ দূর করে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আত্মার রোগের ওষুধ কী?’ তিনি বললেন, ‘হালাল উপার্জন।’ কোনো এক বুজর্গ বলেন, ‘হালাল ভক্ষণে অন্তর নরম থাকে।’ ইবরাহিম ইবনে আদহাম (রহ.) বলেন, ‘আধ্যাত্মিক শক্তি সে-ই শুধু লাভ করবে, যে নিজের পেটে কী প্রবেশ করছে, সে সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত থাকবে।’ এ ব্যাপারে আরও বলা হয় যে, কারও তালি দেওয়া জামা, টাখনুর ওপরে কাপড় ও কপালে দাগ দেখে প্রবঞ্চিত হয়ো না। লক্ষ্য করো, অর্থের সামনে তার অবস্থান কী? সে কী অর্থের দিকে ধাবিত হয়, না তাকওয়া অবলম্বন করে? পূর্বসুরি কোনো এক নারী সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তার কাছে তার স্বামীর মৃত্যুসংবাদ এলো। তিনি তখন আটা দিয়ে খামিরা তৈরি করছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আটা থেকে এই বলে হাত তুলে নিলেন, ‘এটি এখন এমন খাদ্যে পরিণত হয়েছে, যাতে সব ওয়ারিশের অংশীদারিত্ব রয়েছে।’ সাহল ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, ‘যে খাবারের প্রতি লক্ষ্য রাখবে, না ডাকতেই তার হৃদয়ে দুনিয়া-বিরাগ উপস্থিত হবে।’ আবু আবদুর রহমান রবিয়া ইবনে আবদ বলেন, ‘দুনিয়া-বিরাগের সারকথা হলো, হালাল পন্থায় অর্থ সংগ্রহ করা ও যথাস্থানে তা ব্যয় করা।’
আমলে পূর্ণতা লাভের পাঁচ গুণ : আবু আবদুল্লাহ বাজি (রহ.) বলেন, ‘পাঁচটি গুণের মাধ্যমে আমল পূর্ণতা লাভ করে- আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, সত্যের পরিচয় লাভ, ইখলাসের সঙ্গে আমল করা, সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করা ও হালাল ভক্ষণ করা। এর কোনো একটি অনুপস্থিত হলে আমল কবুল হবে না। কারণ, কেউ যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, কিন্তু সত্যের পরিচয় তার সামনে স্পষ্ট না থাকে, ঈমান দ্বারা সে উপকৃত হতে পারবে না। সত্যের পরিচয় পেল, কিন্তু ঈমান আনল না, সেও উপকৃত হতে পারবে না। ঈমান আনল, সত্যও চিনল, কিন্তু আমলে ইখলাস নেই, তারও কোনো উপকার হবে না আমলে। আগের চারটি বিদ্যমান, কিন্তু খাবার হালাল নয়, তার ইবাদতও কোনো কাজে আসবে না।’
প্রকৃত ধনী ও গরিবের পরিচয় : যে লোভী, সে দরিদ্র। ধনী সে, যে অল্পে তুষ্ট থাকে। যে মানুষের ওপর অর্থনৈতিক অত্যাচার করে না, শ্রমিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে না, দরিদ্রদের উপার্জন থেকে সুবিধা লাভ করে না, সে-ই হালাল ভক্ষণ করে। যে নিষ্ঠার সঙ্গে মুসলমানের সন্তানদের সুশিক্ষা দান করে, শিষ্টাচার শেখায়, সেও হালাল খায়। লোভ কষ্ট-ক্লেশ বয়ে আনে।
অধিক আশা বয়ে আনে লাঞ্ছনা। প্রবাদ আছে, ‘লোভ মানুষের মাথা নিচু করে দেয়।’ ইবরাহিম ইবনে আদহাম বলেন, ‘লোভ ও আশার স্বল্পতা সততা ও তাকওয়া সৃষ্টি করে। আর লোভ ও আশার আধিক্য বয়ে আনে দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা।’ যে অসুস্থতার ভয়ে হালাল খাবারও বেছে চলে, কিন্তু জাহান্নামের ভয়ে হারাম থেকে বাঁচে না, তাকে দেখে কী আশ্চর্য বোধ হয় না? হারাম খাবারে মন শক্ত হয়ে যায়। উদাসীনতা বৃদ্ধি পায়। জুনদুব (রা.) সূত্রে বর্ণিত; মানুষের সর্বপ্রথম পঁচন ধরে তার পেটে। অতএব, প্রত্যেকের যথাসাধ্য হালাল ভক্ষণের চেষ্টা করা উচিত।’ (বোখারি : ৭১৫২)।
অনুবাদ : মুফতি মুইনুল ইসলাম