আল্লাহর খাঁটি বান্দা হতে চাইলে গোনাহমুক্ত জীবন গড়ে তুলতে হবে। গোনাহ অনেক রয়েছে। এর মধ্যে মারাত্মক দুটি গোনাহ হলো- সুদ এবং ঘুষ। সুদ একটি কবিরা গোনাহ। এ গোনাহ থেকে জীবনকে মুক্ত রাখা চাই। ঘুষও কবিরা গোনাহ। এ গোনাহ থেকেও জীবনকে মুক্ত রাখা চাই। সুদণ্ডঘুষমুক্ত জীবন গড়া চাই। শুধু সুদণ্ডঘুষের গোনাহ নয়, বরং সব রকম গোনাহ থেকেই জীবনকে মুক্ত রাখা চাই। তবে সুদ ও ঘুষ এমন গোনাহ, যা থেকে মুক্ত থাকা বর্তমানে বেশ কঠিন। সমাজের অনেকেই নানাভাবে এ দুটো গোনাহের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। কোরআনে কারিমে স্পষ্টভাবে সুদ সম্বন্ধে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেও না। আল্লাহকে ভয় করো; যেন সফলকাম হতে পার।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩০)।
ইসলামে সুদের বিধান : শরিয়তে সুদ হারাম; যে কোনো ধরনের সুদ হোক, তা হারাম। বিশ্বব্যবস্থায় সুদ যত ব্যাপকই হয়ে থাকুক না কেন, তবু সুদ হারাম। সুদ থেকে বিরত থাকা যত কঠিনই হোক না কেন, তবু সুদ হারাম। তবে আজকাল কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে, কোরআনে যে সুদ নিষেধ করা হয়েছে, তা হলো- চক্রবৃদ্ধি সুদ। অতএব, চক্রবৃদ্ধি হারে যদি না হয়, বরং সরল সুদ হয়, তাহলে সে সুদ গ্রহণ করা যেতে পারে। হাদিসে সুদ গ্রহণ করলে যে আল্লাহর লানত বা অভিশাপের কথা বলা হয়েছে, সেখানে সাধারণভাবেই সুদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বোঝা যায়, সব ধরনের সুদই নির্দিষ্ট, চাই তা চক্রবৃদ্ধিহারে হোক বা সরল সুদ হোক। আজ পর্যন্ত উম্মতের সর্বস্তরের ওলামা ও ফোকাহা এ রকমই বুঝে আসছেন। নতুন করে এসব আয়াত ও হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে উম্মতকে গোমরাহ করার অবকাশ নেই।
সুদণ্ডসংক্রান্ত ইসলামি নীতি : আজকাল অনেকে বলে থাকেন, বিশ্বব্যবস্থায় সুদ এত ব্যাপক হয়ে গেছে যে, সুদ থেকে মুক্ত থেকে কোনো বড় ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব নয়। তাই সুদের ব্যাপারে নরম নীতি হওয়া চাই। তাহলে কি তারা বলতে চান, বিশ্বের অর্থব্যবস্থা সুদভিত্তিক হয়ে যাওয়ায় শরিয়তে যে সুদ হারাম ছিল, তা হালাল হয়ে গেছে? বিশ্বের কোনো ব্যবস্থা গোনাহভিত্তিক হলে কি সেই গোনাহ আর গোনাহ থাকবে না? তাহলে তো নাচণ্ডগান, অশ্লীলতা, ছবি ইত্যাদি গোনাহ এত ব্যাপক হয়ে গেছে যে, এসব থেকে বিরত থাকা এখন অনেক অসম্ভব। তাহলে কি এগুলোকেও এখন জায়েজ বলে দিতে হবে? ঘরে ঘরে রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদিতে শতরকম গোনাহের অনুষ্ঠান মানুষ উপভোগ করছে। তাই বলে কি তা জায়েজ হয়ে যাবে? কখনোই তা হবে না। কোনো গোনাহ দুনিয়ার সবাই করলেও তা গোনাহ থাকবে, তার পাপের মাত্রা একটুও কমবে না।
সুদমুক্ত হতে আস্থা ও বিশ্বস্ততা : কেউ কেউ বলে থাকেন, যখন সুদি লেনদেন ছাড়া আর কোনোভাবে লোন পাওয়া যায় না, তখন বাধ্য হয়ে সুদি কারবারে জড়িয়ে পড়া ছাড়া উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়েই আমরা সুদি কারবারে জড়িয়েছি। আমরা অপারগ, আমাদের আর কোনো উপায় নেই, তাই আমাদের অন্যায় থাকার কথা নয়। তাদের এ বক্তব্য পুরোপুরি ঠিক নয়। আজও কেউ যদি তার নিজের ওপর এটা প্রমাণিত করতে পারে, সে ঋণ নিয়ে যথাসময় পরিশোধ করতে যত্নবান, তাহলে সে বিনা সুদে মানুষের কাছ থেকে ঋণ পাবে। সমাজে বহু লোক এমন আছেন, যারা ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন, ব্যাংক থেকে কোনো সুদ গ্রহণ করেন না। তারা যদি কারও ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন, সে ঋণ নিয়ে ঠিকমতো পরিশোধ করে দেবে, তাহলে তারা তাকে ঋণ দিতে কুণ্ঠিত হবেন না। যদি কেউ ইসলামি তরিকায় টাকা নিয়ে ব্যবসা করে ঠিকমতো লাভ দেবেন বলে মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করেন, তাহলে তাকে ইসলামি পন্থায় লোন দেয়ারও অনেক লোক পাওয়া যাবে। নিজেকে আস্থাভাজন এবং ভালো চরিত্রবান বলে প্রমাণিত করতে পারলে বিনা সুদে এমনকি বিনা লাভেও ঋণ পেতে তার অসুবিধা হবে না। সুদি কারবারের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে নিজেকে আস্থাভাজন বলে প্রমাণিত করতে হবে।
করজে হাসানায় বরকত রয়েছে : অনেকের ধারণা, ব্যক্তিগত ঋণ নিয়ে তো আর বড় ধরনের কারবার করা সম্ভব নয়। অথচ ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের সুদি লোন না পেলে ব্যক্তিগতভাবে করজে হাসানা নিয়ে হয়তো শুরুতে বড় ধরনের কারবার করা যাবে না, কিন্তু যতটুকু হবে, তাতেই আল্লাহ বরকত দান করবেন। এর বিপরীত সুদি লোনে অনেক বড় কারবার জুড়তে পারলেও শেষ নাগাদ তাতে কোনো বরকত উপলব্ধি করা যায় না। মনে রাখা উচিত, সুদি কারবারে সাময়িক লাভ দেখলেও তাতে বরকত নেই। কোনো অবৈধ কারবারে বরকত নেই। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করলে সে সম্পদে আল্লাহতায়ালা কোনো বরকত দেন না। তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৬)। এ আয়াতে বোঝানো হয়েছে, আল্লাহর রাস্তায় দান করা হলে তা ফরজ ব্যয় হোক বা নফল, আল্লাহ সম্পদ বৃদ্ধি করে দেন। কখনো সম্পদের পরিমাণকে বৃদ্ধি করে দেন, কখনো সম্পদের বরকতকে বৃদ্ধি করে দেন। যখন যেভাবে বৃদ্ধি করা আল্লাহ মনে করেন, সেভাবেই বৃদ্ধি করে দেন।
সুদে আল্লাহর অভিশাপ : যারা সুদ বা অবৈধভাবে সম্পদ উপার্জন করে, তাদের সম্পদকে আল্লাহ বরকতহীন করে দেন। সম্পদ দ্বারা যে উদ্দেশ্য- সুখ-শান্তি অর্জন করা, তা তাদের ভাগ্যে জোটে না। দেখা যায়, সব সময় তাদের পেরেশানি লেগে আছে, টেনশনের পর টেনশন লেগে আছে, তাদের সম্পদ কাজে লাগে না। অতএব, সুদি কারবারে বাহ্যিক লাভ দেখা গেলেও তাতে প্রকৃত লাভ নেই। কারণ, তাতে বরকত নেই। আর শুধু দুনিয়াবি লাভ দেখলেই শরিয়তের ওপর চলা যাবে না। সুদি কারবারে যদি বাহ্যিক লাভ দেখাও যায়, তবু একজন মোমিন তা করতে পারে না। কারণ, শরিয়তে সুদ হারাম। শুধু হারাম নয়, বরং কঠিন হারাম। সুদ এত কঠিন হারাম, যারা সুদের সঙ্গে জড়িত, তারা আল্লাহর অভিশপ্ত। শুধু যারা সুদ নেয়, তারাই যে অভিশপ্ত, তা নয়; বরং সুদের সঙ্গে যে কোনোভাবে যারাই জড়িত, সবাই আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত। যে সুদ খায়, যে সুদ খাওয়ায়, যে সাক্ষী থাকে এবং যে ব্যক্তি সুদের হিসাব-নিকাশ বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি লিখে দেয়, সবার প্রতি রাসুল (সা.) লানত করেছেন। (তিরমিজি : ১২০৬)।
সুদে আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধ : যারা সুদ নেয় এবং সুদ দেয়, সবাইকে আল্লাহ অভিশপ্ত করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা সুদ খায়, তারা জিনে ধরা পাগল ব্যক্তির মতো হাশরের মাঠে দাঁড়াবে। তাদের এ অবস্থার কারণ, তারা বলেছে, ব্যবসা তো সুদের মতোই।’ (সুরা বাকারা : ২৭৫-২৭৯)। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন। প্রতিপালকের নির্দেশ আসার পর যে ব্যক্তি বিরত হয়েছে, সে আগে যা নিয়েছে, তা তারই থাকবে। তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। কিন্তু এ নির্দেশের পরও যারা সুদে জড়িত হবে, তারা জাহান্নামে যাবে। তারা চিরকাল সেখানেই থাকবে। আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান-খয়রাতকে বর্ধিত করেন। কোনো অস্বীকারকারী পাপীকে তিনি পছন্দ করেন না। এক আয়াতে এসেছে, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। যদি মোমিন হয়ে থাক, তবে সুদের যা বকেয়া আছে, তা ছেড়ে দাও। যদি না ছাড়, তবে জেনে রাখ, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হও।’ (সুরা বাকারা : ২৭৮-২৭৯)।
সুদভিত্তিক ঋণব্যবস্থার পেছনে দায়ী : সুদের মতো এত বড় অভিশপ্ত ব্যবস্থা আমাদের সমাজে কীভাবে চালু হলো? আসলে সমাজে সুদভিত্তিক ঋণব্যবস্থা চালুর জন্য আমরাই দায়ী। এজন্য আমাদের চরিত্র কয়েকভাবে দায়ী। তার মধ্যে একটি হলো, ইসলামি নিয়মানুযায়ী ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য টাকা নিলে পরে ব্যবসার ক্ষতি দেখিয়ে অর্থ বিনিয়োগকারীকে বঞ্চিত করে থাকি। তাই এখন অর্থ বিনিয়োগকারী সুদি অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে লাভ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোটকথা, আমরা আমাদের চরিত্র পাল্টালে এ অবস্থাও পরিবর্তন হতে পারে। সমাজে সুদভিত্তিক ঋণব্যবস্থা চালুর জন্য আমাদের চরিত্র এভাবেও দায়ী যে, ইসলাম যে করজে হাসানা তথা সুদমুক্ত ও লাভমুক্ত ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা চালু করেছিল এবং একজন যেন আরেকজনকে করজে হাসানা দিতে উদ্বুদ্ধ হয়, তাই করজে হাসানার সওয়াবও রাখা হয়েছিল অনেক। করজে হাসানা তথা লাভমুক্ত ঋণ দিলে দানের দ্বিগুণ সওয়াব পাওয়া যায়। এক আয়াতে এসেছে, ‘মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এ আশায় যা কিছু তোমরা লাভে দিয়ে থাক, আল্লাহর কাছে তা বর্ধিত হয় না। পক্ষান্তরে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র অন্তরে যারা দিয়ে থাকে, তারাই দ্বিগুণ লাভ করে।’ (সুরা রুম : ৩৯)।
আমাদের কর্মগুণে ফল : আমাদের চরিত্র খারাপ হয়ে গেছে। আমরা ঋণ নিলে পরিশোধ করতে চাই না। ফলে আমাদের মধ্য থেকে করজে হাসানা প্রদানের অভ্যাস প্রায় উঠে গেছে। এখন ব্যক্তিগতভাবে কেউ কাউকে করজে হাসানা বা সুদ ও লাভমুক্ত ঋণ দিতে চায় না। কারণ, একবার দিলে তা আর উসুল করা যায় না। এ সুযোগে লাভ সন্ধানী ব্যক্তিরা (যাদের ঋণ উসুল করে নেয়ার মতো শক্তি আছে) সুদভিত্তিক ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা চালু করেছে। ক্রমান্বয়ে এ সুদভিত্তিক লোন প্রদানের ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। তা বিশ্বব্যাপী রূপ নিয়েছে। হয়তো আমাদের কর্ম দোষেই সুদিব্যবস্থা এরূপ আকার ধারণ করেছে।