তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের উন্নয়নে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগটি দেশের জন্য গৌরব বয়ে এনেছে, বিশ্বজুড়ে একটি মর্যাদাপূর্ণ ব্র্যান্ডে পরিণত করেছে। বাংলাদেশকে একসময় নিন্দুকেরা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করত, এখন ‘বিস্ময় ভরা ঝুড়ি’তে পরিণত হয়েছে। সীমিত সম্পদসহ দেশটি বার্ষিক গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ বজায় রেখেছে। উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও মানব উন্নয়ন ঘটিয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক মনোভাব ও নীতির কারণে বাংলাদেশে কোনো বড় শিল্প গড়ে ওঠেনি। কিন্তু বাংলাদেশ চুপ করে বসে থাকেনি।
দেশ পুনর্গঠন করার চ্যালেঞ্জ : যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে সীমিত সম্পদ দিয়ে পুনর্গঠন করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। যে শিল্পটি দেশ এবং এর অর্থনীতির পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে, তা-ই তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি)। যা এখন বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি আয়কারী। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ এই খাত। যখন আমাদের একমাত্র প্রধান রপ্তানি আয়কারী ‘পাট শিল্প’ তার সোনালি দিনগুলো হারাতে শুরু করে, তখন আরএমজি খাত এটিকে প্রতিস্থাপন করে একে ছাড়িয়ে যায়।
পোশাকশিল্পের সূচনা কথা : বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ৮০-এর দশকে যাত্রা শুরু করে আজকের এ অবস্থানে এসেছে। তৈরি পোশাক শিল্পের পথিকৃৎ প্রয়াত নূরুল কাদের খানের উদ্যোগে ১৯৭৮ সালে ১৩০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠানো হয়। যেখানে তারা পোশাক তৈরি করতে শিখেছিল। সেই প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে তিনি রপ্তানির জন্য পোশাক তৈরির প্রথম কারখানা ‘দেশ গার্মেন্টস’ স্থাপন করেন। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অন্যান্য বিচক্ষণ ও পরিশ্রমী উদ্যোক্তারা দেশে আরএমজি কারখানা চালু করেন। এরপর থেকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বিগত বছরগুলোতে এ সেক্টরটি অনেক সমস্যার সম্মুখীন হলেও এখন বিশ্ববাজারে একটি কুলুঙ্গি তৈরি করেছে।
সাফল্যের অন্য গল্প : এমএফএ-পরবর্তী যুগ সাফল্যের অন্য গল্প। সব ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণ করে এমএফএ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলোকে জয় করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ২৭.৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি মূল্যের সঙ্গে এখন পোশাক শিল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি আয়কারী। গত সাত বছরে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প বার্ষিক আয় ১৯ বিলিয়ন থেকে ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি দেশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক করে তোলে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ এ খাত দিয়ে।
শিল্পে হতাশার ঘনঘটা : তবে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে কাজের পরিস্থিতি ২০১২ সালে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে পড়ে, যখন রাজধানী ঢাকার কাছে তাজরীন ফ্যাশন নামের গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১২০০ শ্রমিক নিহত হয়। এর পরের বছর রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারান আরো কয়েক হাজার শ্রমিক। এ ঘটনাগুলো বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের নাম ক্ষুণ্ণ করে। এরপর বিশ্বব্যাপী খুচরা বিক্রেতা, বিদেশি সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএফসি শিল্পের নিরাপত্তা এবং শ্রমসহ উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ সরকার। দেশের অর্থনীতির একটি কেন্দ্রীয় স্তম্ভকেও রক্ষা করতে ৪.৪ মিলিয়ন শ্রমিক নিয়োগ করা হয় পোশাক শিল্পে। যাদের বেশির ভাগই নারী। দেশের জিডিপিতে ১১ শতাংশের বেশি অবদান রাখে তারা।
তবু আশায় বাঁধা বুক : মারাত্মক বিপর্যয়ের পর কারখানার মালিকদের জন্য ঋণ কম ও সুদের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় ব্যাংকগুলো। যার প্রভাব পড়তে থাকে পোশাকশিল্পের উন্নতিতে। অবশেষে আইএফসি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নীতি, আইন, প্রবিধান তৈরি এবং বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে প্রক্রিয়াগুলোকে সুগম করে। গত জুনে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬৯০টি কারখানা আগুন ও বিল্ডিং সুরক্ষা মান এবং ৬৫৫টি কারখানা শ্রমিকদের নিরাপত্তা মান মেনে চলছে। প্রশিক্ষণ কর্মসূচির চাহিদাও বেড়েছে। সেই সঙ্গে স্থানীয় চারটি ব্যাংক ৭২টি কারখানাকে ২ লাখ থেকে ১ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঋণ প্রদান করে।
মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা : মহামারি এবং বৈশ্বিক বাজারের পরিবর্তন বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। ২ বিশ্বব্যাপী লকডাউন অর্ডার হ্রাস, বাতিলকরণ, অর্থ প্রদানে বিলম্ব এবং শর্তাদি পুনঃআলোচনা শুরু করে। মহামারি বাংলাদেশি শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেললে অনেক ছোট, কম অর্থায়িত কারখানা তাদের দরজা বন্ধ করে দেয় এবং ছোট অর্ডারের প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়। মহামারির প্রথম বছরে বাংলাদেশের আরএমজি রপ্তানির মূল্য ১৭ শতাংশ কমেছে। যা ৫.৬ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রাজস্ব ক্ষতির প্রতিনিধিত্ব করে। এ ছাড়া ২০১২ সালের তাজরিন কারখানার অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৩ সালের রানা প্লাজা কারখানার পতন কাজের পরিস্থিতিতে ব্যাপক সমস্যা তুলে ধরে কিছু আন্তর্জাতিক ক্রেতাকে বাংলাদেশ থেকে সোর্সিং বন্ধ করতে পরিচালিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার পছন্দের শুল্ক চুক্তি প্রত্যাহার করতে প্ররোচিত করে।
সাফল্যের ওপর সাফল্য : বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করছে, বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে সাম্প্রতিক দশকে দেশটি যে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি অর্জন করেছে, তার ওপর। কোভিড-১৯ মহামারির বিপর্যয়ের ভেতরও দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে। তবে তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের গল্পের একটি মূল ভিত্তি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারকদের একটি। আরএমজি খাত বাংলাদেশের রপ্তানির ৮৪ শতাংশের জন্য দায়ী। গত এক দশকে এ সেক্টরের দ্রুত প্রবৃদ্ধি এবং আধুনিকীকরণ, সেই সঙ্গে এটি দেশের আনুমানিক চার মিলিয়ন গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতিতে অগ্রগতি করেছে।
পোশাকশিল্প অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত : বাংলাদেশের পোশাকশিল্প চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশটি অভ্যন্তরীণভাবে বিদ্যুতের ঘাটতি এবং বৈশ্বিক চাহিদার মন্দাসহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। আউটপুট, বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পোশাকশিল্প দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর একটি। শিল্পটি মূল্যের দিক থেকে শিল্প উৎপাদনে প্রায় ৭ শতাংশ, জিডিপিতে ২ শতাংশ এবং দেশের রপ্তানি আয়ে ১৫ শতাংশ অবদান রাখে।
রপ্তানি আয় ৩৫.৮১ বিলিয়ন ডলার : ২০২১ সালে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আয় ৩০.৩৬ শতাংশ বেড়ে ৩৫.৮১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। পোশাক রপ্তানি থেকে দেশটির আয় ভিয়েতনামের ৩২.৭৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। পোশাক রপ্তানি আয়ের ঊর্ধ্বগতি নিটওয়্যার রপ্তানি দ্বারা প্রাধান্য পেয়েছে; যা গত বছরের একই সময়ের মধ্যে ১৪.২২ বিলিয়নের তুলনায় ৩৭.৭২ শতাংশ বেড়ে ১৯.৫৯ বিলিয়ন হয়েছে। বিজিএমইএ-এর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘এ বছরে বাংলাদেশের বোনা পণ্যের রপ্তানিও ২২.৪৬ শতাংশ বেড়ে ১৬.২১ বিলিয়ন হয়েছে।’ ২০২২ সালে পোশাক বাজারে আয়ের পরিমাণ ৯.৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাজারটি বার্ষিক ৪.৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে (২০২২-২০২৭)। ২০২২ সালে ৪.২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজারের পরিমাণসহ বাজারের বৃহত্তম অংশ হলো নারীদের পোশাকের সেগমেন্ট। বৈশ্বিক তুলনায় সবচেয়ে বেশি রাজস্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপন্ন হয় (২০২২ সালে ৩১২.০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। মোট জনসংখ্যার পরিসংখানের সাপেক্ষে ২০২২ সালে জনপ্রতি ৫৫.৬৫ মার্কিন ডলার আয় হয়। পোশাক বাজারে ভলিউম ১,৩০৫.৭ পিসি হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। পোশাকের বাজার ২০২৩ সালে ৬.৭ শতাংশ ভলিউম বৃদ্ধি দেখাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শেষ কথা : গার্মেন্টস তৈরির অর্থনৈতিক গুরুত্বের মধ্যে রয়েছে স্বনির্ভরতা, ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ইত্যাদি। গার্মেন্ট মেকিং ডিজাইন সহকারী, ফ্যাশন ডিজাইনার, টেক্সটাইল ডিজাইনার ইত্যাদিতে কিছু ক্যারিয়ারের সুযোগ। গার্মেন্টস তৈরিতে তথ্য পাওয়ার উপায়গুলোর মধ্যে রয়েছে টেলিভিশন, ফ্যাশন ম্যাগাজিন, রেডিও, সংবাদপত্র ইত্যাদি। ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী আয় ২০২৫ সালে ১.৯ ট্রিলিয়ন চিহ্ন অতিক্রম করবে, ২০২৬ সালে আরো বেড়ে ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি হবে। বিশ্বব্যাপী পোশাকের বাজার আরও দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বার্ষিক রাজস্ব বৃদ্ধির হার-০.৮৪ শতাংশ নিবন্ধিত হয়েছে। কিন্তু ২০২১ থেকে ২০২৬ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী পোশাক বাজারের আকারের গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৫.৮৩ শতাংশ অনুমান করা হয়েছে। এটি কোভিড-১৯ মহামারির আগের তিন বছরে নিবন্ধিত বৃদ্ধির হারের দ্বিগুণেরও বেশি।