প্রাচীনকাল থেকেই স্বাভাবিক নিয়ম চলে আসছে, জীবিকার দায়িত্ব পুরুষের এবং সাংসারিক দেখভাল করবে নারীরা। যেহেতু ভরণ-পোষণ সবার নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং একান্ত আবশ্যকীয়; আর এসবের দায়িত্ব একজন পুরুষের থাকে, সেদিক থেকে পুরুষের চিন্তাধারা থাকে যেমন দীর্ঘমেয়াদি, তেমন পরিশ্রমটাও হয় বেশি। কারণ, সময় কখনও কারও জন্য থেমে থাকে না। নিয়ম করে যতদিন সূর্য উদয় হবে পশ্চিমাকাশ থেকে, যতবার চাঁদ উঠবে, ততদিন অধীনে থাকা প্রত্যেক সদস্যের চিন্তা একজন পুরুষের করতে হবে। একটা পরিবারে অর্থ সচ্ছলতা না হলে বা কোনো সমস্যা হলে, সে নিয়ে কিন্তু ঘরের কর্তাকেই কথা শুনতে হয়। এমনকি পুরুষদের তো তাদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও প্রশ্ন আসে। ঘামঝরা পরিশ্রমের পরও এমন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া আদৌ যুক্তিসঙ্গত কি না, ভেবে দেখিনি।
পুরুষের সঙ্গে দায়িত্ববোধ অবিচ্ছেদ্য : পুরুষ নামের জাতির সঙ্গে দায়িত্ববোধের বিষয় অবিচ্ছেদ্য। তবে আমাদের নারীরা যে কম পরিশ্রম করেন, এটা বলাটাও মস্ত বড় ভুল। কারণ, পুরুষের পরিবারসহ সবকিছুর জিম্মা থাকে গৃহিণীর ওপর। আর একজন পুরুষের বেড়ে ওঠার অবদানও থাকে মায়ের অর্থাৎ নারীর। মোদ্দাকথা, কারও দায়িত্বই কম নয়। তবে বাহ্যিকভাবে পুরুষের দায়বদ্ধতার জায়গা বেশি। দায়িত্বশীল পুরুষ-নারীর মধ্যে নারীর দায়িত্বটাও থাকে পুরুষের ওপর। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘পুরুষরা নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল। এজন্য আল্লাহতায়ালা এককে অন্যের ওপর বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। এজন্য যে, তাদের অর্থ তাদের স্ত্রীদের জন্য ব্যয় করবে।’ (সুরা নিসা : ৩)। যেহেতু জীবিকার দায়িত্ব পুরুষের ওপর অর্পিত হয়, সেজন্য রুজি অন্বেষণে পুরুষকে ছোটাছুটি করতে হয় নানা জায়গায়। কারণ, শুধু অর্থ উপার্জনেই একজন মানুষের দায়িত্ব শেষ হয় না। উপার্জনের পন্থা বা সে বস্তু হালাল কিনা, সেদিকেও নজর রাখা কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে মানবজাতি! তোমরা পৃথিবীর দ্রব্যসমাগ্রী থেকে হালাল বস্তু আহার করো এবং শয়তানের অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।’ (সুরা বাকারা : ১৬৮)। উপার্জনের জের ধরে অনেকে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশ পাড়ি জমায়। অর্থ যত বেশি উপার্জিত হবে, দুনিয়ার চাল-চলন ততটা সহজের আশা করা যায়। তাছাড়া রাসুল (সা.) সব সময় ক্ষুধা থেকে পানাহ চেয়েছেন। কারণ, সেটা খুব খারাপ সঙ্গী।
প্রবাসীর সহজ পরিচয় : অর্থ উপার্জনকে অনেকে বাঁকা চোখে দেখেন। কিন্তু যদি একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করা হয়, তাহলে বোঝা যাবে, অর্থেও মৌলিক নাম শ্রম। আপনি যতটুকু শ্রম দেবেন, আপনাকে সে মূল্যের অর্থ প্রদান করা হবে। অর্থকে যদি পরিশ্রমের সনদ বলি, তাহলে ভুল হবে না। অসঙ্গতি আসে যখন অলসতা আর খারাপ চিন্তায় পরিশ্রম ছাড়া অর্থ ভোগ করতে চায়। তখন অর্থ হয় অবৈধ। অর্থ উপার্জন পরিশ্রম ছাড়া সম্ভব নয়। আর পরিশ্রম করে সাহাবায়ে কেরামও অর্জন করেছেন। এতে ইসলামে কোনো নিষেধ নেই। টাকা উপার্জনে অসঙ্গতি আসে যখন কি না কেউ পরিশ্রম ছাড়া অন্যের অর্থ হাসিল করে। আর অতিরঞ্জনে টাকা উপার্জনের ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসুলের নির্দেশের তোয়াক্কা করে না। শুধু টাকা কেন, নিয়ম লঙ্ঘনকারীরা কোনো ক্ষেত্রেই ভালো নয়। আমাদের ঘৃণা করা উচিত ছিল অনিয়মের জন্য। অনিয়মের দায়ে উপার্জিত বস্তুকে নয়। আরও সহজে বললে, শ্রমিক যেমন টাকা দিয়ে প্রয়োজন মেটাতে পারবে, তেমন চোরও তার চুরিকৃত অর্থ দ্বারা প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে। সুতরাং অর্থকে আপনি ভালো করতে পারেন, বিপরীতে তা খারাপও করতে পারেন। অর্থের ভালো-মন্দের মানদ- বিবেচিত হয় কর্মের ওপর। আর নির্দিষ্ট বৈধ নিয়মে বেশি অর্থ উপার্জন খারাপ কিছু নয়। এ তাগিদে বেশি অর্থ উপার্জনের জেরে অনেকে মাতৃভূমি ছাড়েন। তাদের সহজ একটা পরিচয় আছে। তা হলো, প্রবাসী।
উপার্জনে অপ্রকাশ্য সাধনা : মাতৃভূমি যেমনই হোক না কেন, সবার কাছে তার মাতৃভূমির মূল্যায়ন অতুলনীয়। প্রবাসীদের শ্রমের কষ্টের কথা বাদ দিলেও সবচেয়ে বড় ত্যাগ রুজির তাগিদে পরিবার-পরিজন ছেড়ে বছরের পর বছর অপরিচিত একটা জায়গায় খেটে মরা। লোকমুখে একটা কথা শুনতাম, ‘প্রবাসীদের জন্য তিন বিষয়ে মিথ্যা বলা অন্যায় নয়- ১. না খেয়ে থাকলেও অন্য কেউ জিজ্ঞেস করলে এরা বলে, খেয়েছি। ২. সুস্থতার কথা জিজ্ঞেস করলে অসুস্থতার মধ্যেও এরা বলে, ভালো আছি। ৩. সচ্ছল-অসচ্ছলতায়ও নির্দ্বিধায় বলে, সব ঠিক আছে। এসব অসত্য বলার কারণ আপনজন যেন দুশ্চিন্তা না করে, তারা যেন বিচলিত না হয়। একজন প্রবাসী হয়তো জানেন, বাড়ির মতো এখানে এসে কেউ তার সেবা-শুশ্রƒষা করতে পারবে না। শুধু দুশ্চিন্তা পোহানো ছাড়া তেমন কিছু করতে পারবে না। তাহলে কী দরকার নিজের সঙ্গে অন্যদেরও অস্বস্তিতে রাখার! প্রবাসের একটা নিয়ম হলো, কাজ থাকুক বা না থাকুক দৈনিক খাওয়া-দাওয়ার খরচ বহন করতে হবেই। অন্যথায় না খেয়ে, না পরে থাকতে হবে। এখানে সবাই থাকে ভাড়ার ওপর। আর বাড়িওয়ালা দেখবে না, আপনি কাজ করছেন কি না। সে মাস শেষে ভাড়ার টাকা চাইবেই। তারও হয়তো এটাই জীবিকার উৎস। সেও নিজের জায়গা থেকে সঠিক। যখন কাজ থাকে না, নিজের চলার খরচ থাকে না, তখন শুরু হয় জীবনযুদ্ধের বড় পরীক্ষা। একদিকে নিজের চলার জন্য অর্থের দুশ্চিন্তা, অপরদিকে পরিবারের রোজকার প্রয়োজন। এমন মুহূর্তে প্রবাসীর কঠিন সময় পার হয়। এসব হয়তো ব্যাপকভাবে জানলেও প্রবাসীরা কষ্টে জীবন অতিবাহিত করে। কিন্তু নির্দিষ্ট কে সমস্যায় আছে, এটা হয়তো পরিবারও জানে না। একজন প্রবাসী চাইলেই বাবার ভিটায় ফিরে আসতে পারে না। তার প্রতি অনেকে ভরসা করে থাকে। তার নিজের চিন্তা করতে হয়। ফেলে আসা পরিবারের কথা ভাবতে হয়। কথায় আছে, মানুষ মরার আগেও কয়েকবার মরে। আর এ মারা যাওয়াটা বেশি ভয়ংকর। প্রবাসে প্রতিনিয়ত টাকার দুশ্চিন্তা থাকে। আর পরিবারের থেকে যদি টাকার খোঁটা শুনতে হয়, তখন একজন প্রবাসী জীবিত থাকতেও মরে যায়। যাদের জন্য সে কষ্ট করছে, তারা যখন না বুঝে উল্টো দোষারোপ করে, তখন চিন্তার সঙ্গে যুক্ত হয় মর্মবেদনা। আর এসব দুর্গতি হয়তো অপ্রকাশ্যই থেকে যায়।
ঘামঝরা পরিশ্রমের গল্প : কোনো কাজই কষ্ট ছাড়া হাসিল হয় না। কিছু কাজে অধিকতর বল প্রয়োগে ঘাম ঝরে, অন্যদিকে অনেকের শরীরের বল প্রয়োগ না করেও দুশ্চিন্তার ঘাম ঝরাতে হয়। সব কাজেই আছে শারীরিক ও মানসিক চাপ। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে, এক শিক্ষক বলেছিলেন, এভাবে সব সময় বসে থেকে অনেক কষ্ট হয়ে যায়। যদি অন্যদের মতো বলপ্রয়োগ হয়, এমন কোনো কাজ করতে পারতাম, তাহলে মনে খুব তৃপ্তি পেতাম। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, যখন বলপ্রয়োগ হয়, এমন কোনো কাজ নিয়মিত করতে থাকব, তখন আবার অবস্থান পরিবর্তনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠব। অর্থাৎ কাজের মান যেমন হোক না কেন, প্রত্যেককেই আপন কাজ সমাধা করতে পরিশ্রম করতে হয়। প্রবাসে সব মানুষ এক পেশায় নিয়োজিত নন। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা দায়িত্ব হলেও সবার তাড়াহুড়োর ধরন অভিন্ন। নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছাতে হবে। নিয়মমাফিক কাজ শেষ করে বাসস্থলে ফিরে আসা চাই। ভিন্নভাবে খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত করার বাড়তি চিন্তা। এই তো একটা দিন ব্যস্ততায় পার হবার পর আরেকটা ব্যস্ততাময় দিন এসে হাজির। এমন হরদম ছোটাছুটি চলতে থাকে বছর কয়েক। প্রত্যেক দিনের সূর্য উদিত হয় যেন একজন প্রবাসীর ব্যস্ততার দূত হয়ে। কয়েক মাস আগে যখন শীতের তীব্রতা খুব ছিল, তখন ফজরের নামাজের আগে কন্সট্রাকশনে কাজ করা শ্রমিকরা ঘুম থেকে উঠে গাড়ির অপেক্ষা করছে। হোটেল থেকে কোনো রকম তাড়াহুড়ো করে সামান্য নাশতা সেরেই দৌড়। এ শ্রমিকদের শীত ও গরমে পরিবেশ-পরিস্থিতির বিবেচনায় কাজের সময় পরিবর্তন হয়। শীতের সময় দিনের কাজ চলে, আর গরমে রাতের ভাগে কাজ শেষ করা হয়। কারণ, এসব জায়গায় গরম আমাদের দেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। একে তো কাজ করার কষ্ট, আবার তার ওপর রোদের তীব্রতা থাকলে টিকে থাকা মুশকিল। ভারী সেইফটি স্যু ও সেইফটি জ্যাকেটের গরমে শরীর ঘামে ভিজে চুপচুপ হয়ে যায়। তাছাড়া কাজের কষ্ট তো আছেই। তাদের পরিশ্রমের সঠিক ধারণা দিতে অপারগ। তাদের পরিশ্রম কেবল তারা নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারে। অনেকে কাজ করতে গিয়ে বেহুশও হয়ে যায়। এভাবে পরিশ্রম করে তারপর টাকা রোজগার হয়। এসব কী তার পরিবার জানে! একই সময়ে পরিবারের সদস্য সাচ্ছন্দে আছে, অথচ তাদের জন্য পরিশ্রম করা মানুষটা কী অবস্থায় আছে! আর আরবের আবহাওয়ার একটা সহজ পরিচয় হলো, গরমে প্রচণ্ড গরম আর শীতের সময় শীতও প্রবল।
অনেকে খাবার সরবরাহ করার জন্য মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। রোদে শরীর পুড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে যায়। কেন এত কষ্ট করে? ওই যে পরিচিত বিষয়, পরিবার যেন সাচ্ছন্দে থাকে। আর এসব দেশে শীতের সময়ও রোদের তাপ কম নয়। দীর্ঘ সময় রোদে থাকা মুশকিল। আর গরমের সময় রোদের তাপ তো বর্ণনাতীত। বাইরে পাঁচ মিনিট হাঁটতে গেলে দম বেরিয়ে যায় যেন। এরপরও কোনো প্রবাসীর কাজ থেমে নেই। প্রবাসীদের দুনিয়াটা অন্য সাধারণ মানুষদের তুলনায় ভিন্ন। এদের কাছে ঈদের দিন অন্য সাধারণ দিনের মতো। প্রতিষ্ঠান থেকে ছুটি না মিললে কিছু করার নেই। নিজের মর্জিতে কাজ ছেড়ে দেবে? কে জানে, দ্বিতীয় কাজ মেলার পরিধি কেমন হবে? হয়তো অনেকে বলি, অন্য কাজের যোগ্যতা নেই, তাই করছে। যোগ্যতা থাকলে কি আর এমন কষ্ট করা লাগত! এসব যদি আমাদের মূল স্লোগান হয়, তাহলে সমাজের হাল এ গল্পটার মতো হবে হয়তো, একটা রাজ্যের সব জনগণ অনেক অর্থের মালিক হয়ে যায়। এরপর সবাই নিজ পেশা ছেড়ে দিয়ে অর্থের ওপর ভরসা করে বসে থাকে। জমাকৃত খাদ্যদ্রব্য যখন শেষ হয়ে যায়, তখন দেখে জোগান নেই। কেন, কী হয়েছে? কারণ, সমাজে এখন আর কোনো শ্রমিক নেই। সবার এখন অনেক টাকা। কে চায়, টাকা থাকতে কষ্ট করতে! অবশ্য টাকার মূল্যও তখন কমে যায়, যখন টাকা দিয়ে কেনার মতো কোনো পণ্যই অবশিষ্ট না থাকে। (চলবে...)
লেখক : কাতার প্রবাসী