ভারসাম্য রক্ষায় জাকাত
ওমর ইবনে আখতার
প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাষ্ট্র, সমাজনীতি, পারিপার্শ্বিকতা, আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদি বিষয় যেমন- মানবজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তেমনি অর্থ ও অর্থব্যবস্থার অপরিহার্যতাও অনস্বীকার্য। এ কারণেই ইসলাম অর্থনীতির ক্ষেত্রে দিয়েছে সতর্ক ও মমত্বময় দৃষ্টি। রেখেছে জাকাতের ন্যায় এমন এক ব্যবস্থা, যা পৃথিবীর ইতিহাসে শুধু বিরলই নয়; বলা চলে অদ্বিতীয়ও।
সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মোকাবিলায় জাকাত : যেখানে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মতো কুফরি অর্থব্যবস্থাগুলো মানবসমাজের অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে, সেখানে ইসলাম জনগণকে দিয়েছে চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ নিখুঁত এক অর্থব্যবস্থা। ইসলাম পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে। এক-নায়কতন্ত্রের কাছে জনগণের অর্থ জিম্মি থাকার মতো ভয়ংকর সমাজতন্ত্র থেকে মানুষকে মুক্ত করেছে। জাকাতের মাধ্যমে দূর করে জুলুম, শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্য। প্রতিষ্ঠিত করে ন্যায়-ইনসাফ।
সম্পদের সুষম আবর্তন : এ মহান অর্থব্যবস্থার দাবি হচ্ছে, গুটি কয়েক ব্যক্তির হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত না হয়ে সমাজে সুষম আবর্তন ঘটাতে হবে। তাই সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা স্বর্ণ-রুপা পুঞ্জিভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের কঠোর শাস্তির সংবাদ দিন। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে। এর দ্বারা তাদের ললাট ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে। বলা হবে, এই তো সেই বস্তু, যা তোমরা নিজেদের জন্য জমিয়ে রাখতে। সুতরাং যা জমিয়েছিলে, তার স্বাদ আস্বাদন করো।’ (সুরা তওবা : ৩৪-৩৫)। জাকাতের মুখ্য উদ্দেশ্য ও লক্ষ?্য হলো, সম্পদ যেন সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিটি সদস্যের মাঝে আবর্তিত হতে থাকে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান, শুধু তাদের মধ্যেই যেন সম্পদ আবর্তন না করে।’ (সুরা হাশর : ৭)।
জাকাত কী শুধু ঐচ্ছিক : মানবসমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ঠিক রাখতে ইসলাম জাকাতের ব্যাপারে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছে। জাকাত আদায়কে শুধু ঐচ্ছিক পর্যায়ে রাখেনি, বরং সম্পদশালীর জন্য জাকাত আদায়কে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা সালাত কায়েম করো, জাকাত আদায় করো। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো। আল্লাহ তো তোমাদের কলুষমুক্ত করে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন করতে চান।’ (সুরা আহজাব : ৩৩)।
জাকাতের সঙ্গে নামাজের সম্পর্ক : ইসলাম গ্রহণের পর একজন ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ। এই নামাজ আর জাকাতকে কোরআনে একসঙ্গে ত্রিশবার উল্লেখ করা হয়েছে। এ দুটির উল্লেখ যেহেতু একসঙ্গে, তাই জাকাত আদায় না করলে ব্যক্তির নামাজও কবুল হবে না। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমাদের নামাজ কায়েম করার এবং জাকাত প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যে ব্যক্তি (সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও) জাকাত আদায় করে না, তার নামাজও কবুল হয় না।’ (ফাজায়েলে সাদাকাত : ১/৩৮৮)।
জাকাত আদায় না করার শাস্তি : জাকাত ফরজ হওয়া সত্ত্বেও যারা জাকাত আদায় করে না, তাদের সম্পর্কে রাসুল (সা.) কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা জাকাত আদায় করে না, তারা শেষ বিচারের দিন দেখতে পাবে যে, তাদের সেসব ধন-সম্পদ ভয়ঙ্কর সাপ হয়ে তাদের শরীর পেঁচিয়ে ধরেছে। এসব বিষাক্ত সাপ তাদের দেহকে কঠিনভাবে নিষ্পেষিত করবে, ছোবল দেবে এবং বলতে থাকবে, আমিই তো তোমার আহরিত ধন-সম্পদ এবং আমিই হলাম সেই রত্নসম্ভার, যার প্রতি তুমি এত আসক্ত ছিলে।’ (বোখারি : ১৪০৩)।
ইতিহাসের পাতায় জাকাত আদায়ের সুফল : জাকাতের মাধ্যমেই সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা হয়। ইসলামের সোনালি যুগেও বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটেছিল। হতবল, দরিদ্র, শোষিত আরবরা মাত্র কয়েক বছরেই ইসলামি অর্থব্যবস্থার কল্যাণে এমন বদলে গিয়েছিল যে, সেখানে জাকাত নেওয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। ইতিহাসও যুগ যুগ ধরে বহন করেছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ। কেন না, যখনই কোনো ইসলামি রাষ্ট্র পূর্ণরূপে জাকাত আদায় করেছে, সেখানেই দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়।
ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালের গল্প : একবার ইয়েমেনের গভর্নর মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) ইয়েমেনের এক-তৃতীয়াংশ জাকাত কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিলেন। খলিফা ওমর (রা.) বললেন, ‘তোমাকে কি ট্যাক্স উসুল করতে পাঠিয়েছি? ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে ওখানেই গরিবদের মাঝে বণ্টন করে দাও।’ গভর্নর জানালেন, ‘জাকাত নেওয়ার মতো এখানে কেউ নেই।’ দ্বিতীয় বছর অর্ধেক জাকাত এবং পরের বছর পুরো জাকাত মদিনায় পাঠিয়ে দিলেন। জানালেন, ‘জাকাত নেওয়ার মতো অসহায় কোনো লোক ইয়েমেনে নেই।’ (আল আমওয়াল : ৫৯৬)।
জাকাতের সুফল দ্বিতীয় ওমরের শাসনকালেও : অনুরূপ ঘটেছে ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.)-এর শাসনামলেও। ইফ্রিকিয়া (বর্তমান তিউনিসিয়া) প্রদেশে তার নিযুক্ত জাকাত আদায়কারী ইয়াহইয়া বিন সাঈদ বলেন, ‘আমি জাকাত সংগ্রহ করলাম, কিন্তু দেওয়ার মতো উপযুক্ত কাউকে পেলাম না। পরে ওই টাকা দিয়ে স্থানীয় দাসদের কিনে ইসলাম গ্রহণের শর্তে আজাদ করে দিলাম।’ (ফিকহুজ জাকাত : ২/৪৬)।
একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা : অটোমান সাম্রাজ্যের সপ্তম খলিফা মুহাম্মদ আল ফাতিহ (রহ.)-এর শাসনকালে এক মুসলমান জাকাতের টাকা দেওয়ার মতো কাউকে পেল না। অগত্যা টাকাগুলো থলেতে ভরে চৌরাস্তায় ঝুলিয়ে দিল।
লিখে রাখল, ‘ভাই! আমি অনেক খুঁজেও কোনো অসহায় পাইনি। তুমি যদি অভাবী হও, নির্দ্বিধায় এটা গ্রহণ করতে পারো।’ কথিত আছে, তিন মাস পড়েছিল থলিটি। কিন্তু কেউ তা গ্রহণ করেনি।