ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মানবিক অর্থনীতির শিক্ষায় রমজান

লুকমান হাসান
মানবিক অর্থনীতির শিক্ষায় রমজান

আধুনিক অর্থনীতি বাণিজ্যিক ও নৈতিক সীমারেখা পৃথক করে দেখে। বাণিজ্যিক চৌহদ্দিতে লোভ আর স্বার্থই হচ্ছে সম্পদ বিতরণ-বণ্টনের প্রধান প্রেরণাশক্তি। আধুনিক অর্থনীতিবিদরা নৈতিকতার ভিত্তি খুঁজে বের করার জন্য এখনো অনুসন্ধানের প্রথম পাঠই সম্পন্ন করতে পারেনি। এসব বিষয়ে সমাধান কোথায় আছে, তা এখনো তারা ভালো করে জানে না। ফলে বাজার ব্যর্থতা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে ইসলামি অর্থনীতির ভিত্তিই হলো নৈতিকতা ও মানবিকতার ওপর। নৈতিকতা ছাড়া এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারণা অসম্পূর্ণ। এতে রয়েছে নৈতিকতার সুশৃঙ্খল আদর্শিক মানদ- ও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন। জবাবদিহিতা ও অতি উচ্চ মানবিকতার ভিত্তিতে এর নীতিমালা, প্রয়োগ ও ফলাফল হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ। তবে ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে স্বার্থের বাজারে মানুষের মধ্য থেকে নৈতিকতার স্তর কখনো কখনো নেমে যায়। আর সে স্তর প্রতিনিয়ত উন্নত ও সুউচ্চ করতেই ইসলাম বিভিন্ন রকমের আয়োজন করে। দিবসের শুরুতে আল্লাহর সামনে ফজরের নামাজে উপস্থিতির মাধ্যমে জবাবদিহিতার চেতনা জাগ্রত করার মধ্যদিয়ে তা প্রতিদিন শুরু হয়। আর পুরো বছরে মাসব্যাপী এমন প্রশিক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মাহে রমজান।

রমজানের দাওয়াত : ১৪৪৫ হিজরির মাহে রমজান যাপন করছি আমরা। রাসুল (সা.) যে বছর হিজরত করেছেন, তার এক বছর পরই রমাজানের রোজা ফরজ করা হয়েছিল। সে হিসেবে আমরা ১ হাজার ৪ শত ৪২তম ফরজ রমজান আদায় করছি। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াত হলো, এক আল্লাহর বিশ্বাসে সবাই এক দেহ, এক প্রাণে পরিণত হবে। যেমনটি জান্নাতি মোমিনদের সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যাদের অন্তর এক অন্তরের মতো।

তাতে নেই কোনো হিংসা কিংবা বিদ্বেষ।’ (বোখারি : ৩২৫৪)। রমজান মূলত আমাদের সবার মধ্যে এক প্রাণ সঞ্চারের আহ্বান জানাতে আসে। এটি ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য ও শক্তি। বর্তমান বিশ্ব এ সৌন্দর্য ও শক্তি থেকে বঞ্চিত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মোমিনগণ পারস্পরিক ভালোবাসা, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ব্যাপারে একটি দেহের মতো। যার কোনো অঙ্গ ব্যথা পেলে পুরো দেহ তার জন্য রাত জাগে এবং জ্বরে ভোগে।’ (মুসলিম : ৬৭৫১)।

মানবিক সম্প্রীতিশক্তি কোন পথে : এই এক দেহ, এক প্রাণ হওয়ার জন্য মহান মালিক আল্লাহকে মানতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি তাদের হৃদয়ে পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতি সৃষ্টি করেছেন। তুমি যদি পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদও ব্যয় করতে, তবে তাদের হৃদয়ে সম্প্রীতি সৃষ্টি করতে পারতে না। কিন্তু তিনি তাদের অন্তরসমূহে প্রীতি স্থাপন করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আনফাল : ৬৩)।

অন্তরের এই মিল ও সম্প্রীতি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। আল্লাহতায়ালা তা দেওয়ার জন্য কিছু করণীয় দিয়েছেন, যা করতে হবে। কিছু বর্জনীয় দিয়েছেন, যা বর্জন করতে হবে। করণীয় ও বর্জনীয় শিক্ষা দিতে রমজানের আগমন। দেহের কোনো অঙ্গ ব্যথা পেলে যেমন সারা দেহে জ্বালা হয়, তেমনি সারা বছর অনাহারে-অর্ধাহারে যাদের জীবন কাটে, তারা তো আমারই মোমিন ভাই-বোন। তাদের মর্মণ্ডবেদনা আর ক্ষুধার যাতনা কি আমরা টের পাই? এই অনুভূতি জাগ্রত করা আমাদের প্রথম করণীয়। পরিবারের কেউ ক্ষুধার্ত থাকলে আমরা যেভাবে তাদের খাবার জোগাড় করি, গরিবদের জন্যও সেভাবে কিছু করার চেষ্টা করতে হবে। আর সে চেষ্টার জন্য আগে হৃদয় থেকে তার বেদনা অনুভব করতে হবে। রোজা মূলত এ বেদনা জাগ্রত করতে উদ্বুদ্ধ করে।

জবাবদিহিতার শিক্ষা : ইসলামি অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি হলো, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে জবাবদিহিতার চেতনা সৃষ্টি করা। আল্লাহতায়ালা সবকিছু দেখেন ও জানেন। এরপরও প্রত্যেকের সঙ্গে তিনি চারজন এমন সাক্ষী নিযুক্ত করেছেন, যাদের কাউকে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই- এক. মানুষের অঙ্গ। কেয়ামতের দিন প্রত্যেক অঙ্গ মানুষের কর্মের সাক্ষ্য দেবে। (সুরা ইয়াসিন : ৬৫)। দুই. মানুষের গায়ের চামড়া। আল্লাহর সামনে মানুষের গায়ের চামড়াও সেদিন কথা বলবে। (সুরা হামিম সাজদা : ২১)। তিন. জমিন। যার ওপর মানুষের রাতদিন বিচরণ। সেদিন তার ওপর সংঘটিত সব খবর সে আল্লাহকে জানিয়ে দেবে। (সুরা জিলজাল : ৪)। চার. দুই কাঁধে আমল লেখার কাজে নিয়োজিত দুই ফেরেশতা। যারা মানুষের সব কাজ-কর্মের যথাযথ হিসাব রাখেন। (সুরা ইনফিতার : ১১-১২)।

রোজা ফরজ করা হয়েছে তাকওয়া অর্জনের জন্য। আর তাকওয়ার মূলকথাই হলো, জবাবদিহিতার ভয়ে নিজেকে অন্যায়-অপরাধ থেকে দূরে রাখা এবং কর্তব্য কাজগুলো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করা। সম্পদ আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে প্রত্যেক মানুষকে কেয়ামতের দিন জবাব দিতে হবে, এ চেতনা তাকওয়ার অন্যতম অংশ।

ক্ষুধার্তদের খাবার দেওয়া : আল্লাহতায়ালা মানুষকে অর্থবিত্ত দিয়েছেন। অপরদিকে কিছু মানুষকে গরিব বানিয়েছেন। কিন্তু কোরআনে তিনি বলেছেন, ‘তাদের ধন-সম্পদে যাচক ও বঞ্চিতের প্রাপ্য রয়েছে।’ (সুরা জারিয়াত : ১৯)। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ফরজ করে দিয়েছেন। যেমন- জাকাত, উশর, মানত ইত্যাদি। এর মধ্যে অন্যতম হলো, রোজার কাফফারা, অসুস্থদের রোজার পরিবর্তে প্রদেয় ফিদয়া ও রোজা শেষে অনিচ্ছাকৃত ভুলসমূহের কাফফারা হিসেবে সদকাতুল ফিতর আদায়। আবার কখনো তা নৈতিক কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রোজাদারকে ইফতার করানোর অনেক ফজিলত দিয়েছেন। দানশীলতা ও উদারতার মহৎ গুণ হিসেবে প্রশংসা করেছেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, রমজানে প্রায় সব বাসাবাড়িতে খাবারের মহা-আয়োজন থাকলেও গরিবের ঘরে কী রান্না হলো, তার কোনো খোঁজখবর কেউ রাখে না। প্রতিবেশী কী দিয়ে ইফতার করছে, তা জানার চেষ্টা করা হয় না। এটি মুসলমানের আদর্শ নয়। রমজানে মানুষ সারাদিন না খেয়ে থাকে। এ বছর দীর্ঘ প্রায় ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত প্রচণ্ড পিপাসা আর গরমের দাবদাহ সয়ে রোজা রাখছে। এত এত খাবার, অথচ একটুও সে মুখে দেয় না। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার এই অভুক্ত থাকা। এ কারণে রোজাদারকে আল্লাহতায়ালা নিজে পুরস্কৃত করবেন। এই কষ্টের পর সামর্থবানরা তো পেট পুরে খেয়ে নেয়। এরপর অবশিষ্ট খাবারগুলো অপচয়ও করে। অথচ বাংলাদেশে এখনও প্রতি চারজনের একজন মানুষ বিনা আহারে দিনাতিপাত করে।

কোভিডের কারণে দেশের অর্থনীতিও শোচনীয় অবস্থা। কাজ নেই, ব্যবসা নেই; নেই নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত মানুষের জীবিকার নিরাপদ সংস্থান। মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় মানুষ নাজেহাল। ঘরে ঘরে দিন দিন অনাহারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর পেছনে ধনীদের ভোজন বিলাসিতাও কম দায়ী নয়। এমতাবস্থায় একজন মোমিন হিসেবে রমজানের শিক্ষা জীবনে ধারণ করে ভোজন নিয়ন্ত্রণ করা এবং অন্তত অবশিষ্ট খাবার দিয়ে হলেও গরিবের খেয়াল রাখা উচিত।

ধনীদের সম্পদে গরিবদের অধিকার : ধনীদের সম্পদে গরিবদের অধিকার রয়েছে। সে অধিকার ধনীরা যথাযথ আদায় করেছে কি-না, কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে খাবার দাওনি।’ বান্দা বলবে, ‘হে আমার রব! আপনাকে কীভাবে খাবার দেব, আপনি তো রাব্বুল আলামিন!’ তিনি বলবেন, ‘তুমি কি জানো না, অমুক (গরিব) লোকটি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, তখন তাকে তুমি খাবার দাওনি। তুমি যদি তাকে খাবার দিতে, তাহলে তা আমার কাছে আজ পেয়ে যেতে।’ (মুসলিম : ২৫৬৯)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি বস্ত্রহীন কোনো মুসলমানকে কাপড় দান করবে, প্রতিদান হিসেবে আল্লাহতায়ালা ওই ব্যক্তিকে জান্নাতের সবুজ পোশাক দান করবেন। আর যে ব্যক্তি ক্ষুধার্ত মুসলমানকে খাবার দেবে, আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতের ফল-মূল খাওয়াবেন। আর যে ব্যক্তি পিপাসার্ত মুসলমানকে পানি পান করাবে, আল্লাহতায়ালা তাকে মোহরাঙ্কিত শরাব পান করাবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৬৮২)।

যাদের জন্য ব্যয় করতে হবে : নিজের ও পরিবারের জন্য সবাই ব্যয় করে। আলাদা করে তা বলার বিশেষ প্রয়োজন নেই। কিন্তু ব্যয়ের যে খাতগুলো অবহেলিত থাকে, সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশেষ কয়েকটি খাত উল্লেখ করা হলো-

এক. আত্মীয়দের খোঁজ নিতে হবে। আত্মীয়দের হক সবচেয়ে বেশি। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন আত্মীয়তা রক্ষা করে।’ (বোখারি : ৬১৩৮)। অপর এক হাদিসে এসেছে, ‘আত্মীয়কে দান করলে দুটি সওয়াব হয়, আত্মীয়তা রক্ষার ও সদকা করার।’ (আল জামিউস সাগির, সুয়ুতি : ৪৯৭৭)।

দুই. প্রতিবেশীর খোঁজ নিতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জিবরাইল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীদের ব্যাপারে এত বেশি তাগিদ দিচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল, আল্লাহতায়ালা প্রতিবেশীকেও হয়তো ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন।’ (তিরমিজি : ১৯৪৩)। অপর এক হাদিসে আবু জর (রা.)-কে রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে আবু জর! তুমি যখন তরকারী রান্না করো, তখন তার মধ্যে ঝোল বাড়িয়ে দেবে। আর প্রতিবেশীর প্রতি খেয়াল রাখবে।’ (মুসলিম : ২৬২৫)।

তিন. এতিমদের দায়িত্ব নিতে হবে। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) মধ্যমা ও শাহাদত আঙুল দেখিয়ে বলেছেন, ‘আমি ও এতিমের দায়িত্ব গ্রহণকারী এই দুই আঙুলের মতো।’ (মুসলিম : ২৯৮৩)।

চার. বিধবাদের দায়িত্ব নিতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এতিম অথবা বিধবার দায়িত্ব গ্রহণ করবে, আল্লাহতায়ালা তাকে তার রহমতের ছায়া দান করবেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ৩/২৩)।

পাঁচ. রমজানে রোজা রেখে আয় করতে গেলে অনেক মানুষের পক্ষে তা কঠিন হয়ে পড়ে। অভাবী সেই মানুষগুলোর খোঁজখবর নেওয়া। প্রতিদিনই তো কোনো না কোনো কাজে আমাদের রিশকায় চড়তে হয়। চলার পথে রিকশাওয়ালা ভাইটির খবর নেওয়া চাই। ফেরিওয়ালা, হকার, টোকাই, ঝাড়ুদার, ফুটপাতের দোকানি কিংবা দিনমজুর ও শ্রমিক এবং বুয়া-আয়াদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন কারণেই দেখা হয়। তখন তাদের খোঁজ নেওয়া নৈতিক দায়িত্ব। তাদের কাছে যেতে হবে। তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করার সাধ্যমতো ব্যবস্থা করা চাই। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের কোনো সমস্যা সমাধান করে দেবে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিনের বিপদগুলো থেকে তার একটি বিপদ দূর করে দেবেন।’ (মুসলিম : ২৬৯৯)।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত