রমজান মাসকে আল্লাহতায়ালা মানুষের জন্য তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিযোগিতার ময়দান বানিয়েছিলেন। কেউ প্রতিযোগিতায় অগ্রগামী হয়ে সফলতা লাভ করেছে। কেউ অলসতা করে হয়েছে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত। আলী (রা.) রমজানের শেষ রাতে সবাইকে লক্ষ্য করে বলতেন, ‘আমি জানি না, আল্লাহর কাছে কার ইবাদত গৃহীত হয়েছে; আর কে বঞ্চিত হয়েছে। যার ইবাদত কবুল হয়েছে, তাকে মোবারকবাদ। যে বঞ্চিত হয়েছে, আল্লাহ তার ক্ষতিকে পুষিয়ে দিন।’
বিদায় হে মাহে রমজান : এই তো কিছুদিন আগে আমরা রমজানের অপেক্ষায় ছিলাম। প্রহর গুণতাম- কখন রমজান মাস শুরু হয়? আর এখন সেই রমজান মাস বিদায়ের আয়োজনে ব্যস্ত। কবি বলেন, ‘হে রমজান মাস! তোমার ওপর আমার জীবন উৎসর্গীত হোক। তোমার প্রস্থান আরও বিলম্বিত হোক, আরও বিলম্বিত হোক। কী জানি, বছর যখন শেষ হয়ে যাবে, তুমি কী আবার আমার জীবনে ফিরে আসবে? তুমি কি জীবদ্দশায় প্রাণপণ আমার সঙ্গে মিলিত হবে? নাকি তোমার সঙ্গে আমার আর ফের দেখাটা কবরেই হবে?’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষ যদি রমজান মাসের গুরুত্ব বুঝত, তাহলে কামনা করত- যেন সারা বছর রমজান মাস হয়?’ (মাজমাউয যাওয়াইদ)।
ভয় ও আশার মাস রমজান : মোমিনমাত্রই এ মাস আসায় খুশি হয়। আল্লাহতায়ালা কর্তৃক রোজা রাখা ও রাতে নামাজ আদায়ের তৌফিক প্রদানের কারণে আনন্দিত হয়। ঈমানের কারণে গর্বিত হয়। ইসলামের কারণে নিজেকে সম্মানিত মনে করে। পাশাপাশি কল্যাণের এই মৌসুম চলে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় ব্যথিত হয়, দুঃখী হয়। যথাযথ ইবাদত-বন্দেগি করতে না পারার কারণে আফসোস করতে থাকে। মনে মনে ভয় করতে থাকে, হয়তো আর এ রমজান মাস তার জীবনে ফিরে আসবে না। প্রত্যেক মোমিনের হৃদয়েই এ সময়ে বিপরীতমুখী দুটো অবস্থা বিরাজ করে। মনে ইবাদত কবুল হওয়ার আশা যেমন থাকে, থাকে কবুল না হওয়ার আশঙ্কাও। খুশিও যেমন থাকে, থাকে বেদনাও। গর্ব যেমন থাকে, থাকে পরিতাপও।
শেষ ভালো যার, সব ভালো তার : রমজান মাস বিদায়ের পথে। শেষ দশকের বিজোড় রজনীগুলোর আর একটি মাত্র রজনী অবশিষ্ট আছে; ২৯ তারিখের রাত। যে রাতে ইবাদত করলে হাজার মাস ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়। আমাদের দ্রুত তওবার দিকে অগ্রসর হতে হবে। ফিরে আসতে মহান রবের কাছে। ভালো কাজগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে আপন করে নিতে হবে। মন্দ কাজগুলোকে পরিত্যাগ করতে হবে।
আবু মুসা আশআরি (রা.)-এর মৃত্যুর আগের ঘটনা। সেবার তিনি রমজানের শেষ দশকে কঠিন পরিশ্রম করেছিলেন। তাকে বলা হলো, নিজের ওপর একটু যদি দয়া করতেন! পরিশ্রমটা যদি একটু কমিয়ে দিতেন! তিনি বললেন, ‘ঘোড়াকে যখন প্রতিযোগিতার জন্য পাঠানো হয়, তার লক্ষ্যস্থল যখন অনতিদূরে দৃষ্টিগোচর হয়, ঘোড়া তার সর্বশক্তি ব্যয় করে লক্ষ্য ধরতে চায়। অতএব, আমাদেরও শাওয়ালের চাঁদ ওঠার আগে নিজেদের সর্বশক্তি ব্যয় করে ইবাদতে নিমগ্ন হতে হবে।’ আমাদের চেষ্টা করতে হবে। ইবাদতে শ্রম বিনিয়োগ করতে হবে। পরিপূর্ণরূপে আলস্য ত্যাগ করতে হবে। একেবারে মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত; বরং জীবনের অন্তিম ক্ষণ পর্যন্তই ইবাদতে এমন চেষ্টা-প্রচেষ্টার বিনিয়োগ কাম্য। কেউ যদি বিগত দিনগুলো কোনো অলসতা করে থাকে, তার তওবা করা উচিত; যাতে রমজান মাসের একটা সুন্দর পরিসমাপ্তি আমাদের জীবনও সুন্দর করে। কারণ, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। ধর্তব্য সুন্দর পরিসমাপ্তির। পরিসমাপ্তি সুন্দর হলে, সূচনার ত্রুটি ঢাকা পড়ে যায়।
রমজানের অন্তিমবেলায় করণীয় : রমজানের সমাপ্তিতে মোমিনের কিছু করণীয় আছে। এর মধ্যে একটি হলো, সদকাতুল ফিতর আদায় করা। এটি নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, স্বাধীন-দাস সব মুসলমানের ওপরই ওয়াজিব। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ছোট-বড়, দাস-স্বাধীন, নারী-পুরুষ সব মুসলমানের জন্য এক সা খেজুর কিংবা এক সা জব সদকাতুল ফিতর হিসেবে ধার্য্য করেছেন।
(বোখারি ও মুসলিম)। পেটে যে বাচ্চা আছে, সে ছাড়া আর সব সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর এটি ওয়াজিব। কেউ যদি পেটের বাচ্চার ফেতরাও আদায় করে, সেটাও মুস্তাহাব হিসেবে আদায় হবে। ওসমান (রা.) গর্ভের বাচ্চারও সদকাতুল ফিতর আদায় করতেন। সদকাতুল ফিতর রোজাকে কলুষমুক্ত করে। রোজার ত্রুটিগুলোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে কাজ করে। পাশাপশি এতে গরিবের খাবারের চাহিদাও পূরণ হয়।
সদকাতুল ফিতর ঈদের দিনের আগেও আদায় করা জায়েজ। তবে ঈদের রাতে কিংবা ঈদের নামাজ আদায়ের আগে আদায় করা উত্তম। কেউ যদি ঈদের নামাজের পরে আদায় করে, তার সেটি সাধারণ নফল দান হিসেবে গণ্য হবে।
ঈদের চাঁদ ওঠার পর একটি বিশেষ আমল হলো, বেশি বেশি তাকবির বলা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যাতে তোমরা মেয়াদ পূর্ণ করতে পারো ও আল্লাহর বড়ত্ব বর্ণনা করতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)। চাঁদ ওঠার পর পুরুষরা জোরে জোরে তাকবির বলবে। ঘরে-মসজিদে, পথে-ঘাটে সর্বত্র বলবে, ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ নারীরা অবশ্য নিজ বাড়িতেই নিচু আওয়াজে এ তাকবির উচ্চারণ করতে থাকবে। ঈদের নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবিরের এ ধারা চলবে।
মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুইনুল ইসলাম