ঈদ ও রমজানের অনন্য অনুষঙ্গ সদকাতুল ফিতর। রোজায় যেসব ভুল-ভ্রান্তি হয়, তার মুক্তির জন্যই সদকাতুল ফিতরের বিধান। রাসুল (সা.) রোজাদারকে ত্রুটিমুক্ত ও মিসকিনদের আহারের ব্যবস্থা করার জন্য সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৮২৭)।
সদকাতুল ফিতর কী : ঈদুল ফিতরের দিন জাকাতের নেসাব পরিমাণ মালের মালিকের ওপর যে সদকা বা ফেতরা ওয়াজিব হয়, তাকেই সদকাতুল ফিতর বলে। (ফতোয়ায়ে শামি : ৩/৩৬২)। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, একে জাকাতুল ফিতরও বলে। (সুনানে আবি দাউদ : ১/২২৭)।
কার ওপর ওয়াজিব : জাকাতের নেসাব পরিমাণ মালের মালিক ছোট-বড়, স্বাধীন, নর-নারী সব মুসলমানের ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। (সুনানে আবি দাউদ : ১/২২৯)।
নেসাব : জাকাতের নেসাবই হলো ফেতরার নেসাব। অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচাদি ও ঋণ বাদ দিয়ে ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময় যার কাছে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা সাড়ে সাত তোলা সোনা কিংবা এর সমমূল্যের সম্পদ থাকে, তার ওপর সদকাতুল ফিতর বা ফেতরা আদায় করা ওয়াজিব। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/২৫৩)।
ফেতরায় কী দেবেন : সদকাতুল ফিতর আদায়ের জন্য পাঁচটি খাদ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন- আটা বা গম অর্ধ সা (১ কেজি ৬৫০ গ্রাম), যব ১ সা (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম), কিশমিশ ১ সা (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম), খেজুর ১ সা (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) এবং পনির ১ সা (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম)। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩১)। হাদিসে উল্লিখিত পাঁচ দ্রব্য বা মূল্যের যে কোনোটি দ্বারা ফেতরা আদায়ের সুযোগ রয়েছে। যেন প্রত্যেকেই নিজ নিজ সামর্থ্য ও সুবিধানুযায়ী যে কোনো একটি দ্বারা আদায় করতে পারেন। (আল গায়াহ ফি শরহিল হিদায়া : ৭/১৮৮)। কেউ চাইলে সরাসরি দ্রব্য দ্বারা ফেতরা আদায় করতে পারবেন, আবার কেউ চাইলে মূল্য দ্বারাও আদায় করতে পারবেন। তবে মূল্য দ্বারা আদায় করা ভালো। (ফতোয়ায়ে শামি : ২/৩৬৭)।
ভিন্ন দ্রব্যে ফেতরা : হাদিসে উল্লিখিত ফেতরার পাঁচ দ্রব্য ছাড়া অন্য কোনো দ্রব্য দ্বারা ফেতরা আদায়ের ক্ষেত্রে শর্ত হলো, হাদিসে বর্ণিত দ্রব্যসমূহের সমমূল্যের হতে হবে। অর্থাৎ ধান বা চাল দিতে চাইলে ধান বা চাল অর্ধ সা গমের সমমূল্যের হতে হবে। সরাসরি ধান-চাল এক সা বা অর্ধ সা দিতে চাইলে ফেতরা আদায় হবে না। (ফতোয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ : ৬/৩১৩)।
উত্তম ফেতরা : হাদিসে বর্ণিত দ্রব্যাদির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফেতরা দেওয়া উত্তম। এমনটিই অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মত। কেন না, এভাবে ফেতরা দিলে গরিবদের বেশি উপকার হয়। (ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া : ৩/৪৫৫)।
সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ পরিমাণ : বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী চলতি বর্ষ ২০২৪-এর ফেতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ জনপ্রতি ১১৫ টাকা। আর সর্বোচ্চ ২৬৪০ টাকা। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)। উল্লেখ্য, ফেতরা আদায়ের পণ্যসমূহের স্থানীয় খুচরা বাজারমূল্যে তারতম্য রয়েছে। সে অনুযায়ী স্থানীয় মূল্য পরিশোধ করলেও ফেতরা আদায় হয়ে যাবে।
প্রচলিত ভুল নিরসন : সমাজের ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই ফেতরার সর্বনিম্ন পরিমাণ জনপ্রতি ১১৫ টাকা হিসেবে আদায় করে থাকেন। অনেকে হয়তো ভুলেই গেছেন, গম হচ্ছে ফেতরার ৫টি দ্রব্যের একটি। যা বর্তমানে সর্বনিম্ন মূল্যের। এটি সর্বনিম্ন সম্পদের মালিকের জন্য ঠিক আছে; কিন্তু আল্লাহতায়ালা যাদের সামর্থ্য দিয়েছেন, তাদের ফেতরার সর্বোচ্চ পরিমাণ তথা ২৬৪০ টাকা আদায় করা উচিত।
ফেতরা কয়জনকে দেবেন : একজনের ফেতরা একজনকে, আবার কয়েকজনকেও দেওয়া যায়। এমনিভাবে কয়েকজনের ফেতরা মিলিয়ে একজনকেও দেওয়া যাবে। (ফতোয়ায়ে শামি : ৩/৩৭৭)। তবে একজনের ফেতরা একজনকে দেওয়া উত্তম। (কিতাবুল মাসায়েল : ২/২৮৪)।
ফেতরা কখন দেবেন : যার কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তার ওপর সদকাতুল ফিতর ঈদের দিন সুবহে সাদিক তথা ফজরের সময় ওয়াজিব হয়। (তোহফাতুল ফুকাহা : ১/৩৩৯)। তবে কেউ যদি ফজরের আগে মারা যায় বা গরিব হয়ে পড়ে, তাহলে তার ওপর ফেতরা ওয়াজিব নয়। এমনিভাবে কেউ যদি ফজর হওয়ার পর জন্মগ্রহণ করে বা কোনো কাফের ফজরের পর মুসলমান হয়, তাহলেও তার ওপর ফেতরা ওয়জিব নয়। কিন্তু কোনো সন্তান যদি ঈদের দিন ফজরের আগে জন্মগ্রহণ করে বা কোনো কাফের ঈদের দিন ফজরের আগে ইসলাম গ্রহণ করে কিংবা কোনো গরিব ধনী হয়ে যায়, তাহলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/২৫৪)। আবার সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়ার আগেই কেউ যদি ফেতরা আদায় করে দেয়, এরপর মালের মালিক হয়, তাহলেও তার আদায় সহিহ হবে। (আল বাহরুর রায়েক : ২/৪৪৪)।
ফেতরা দেওয়ার উত্তম সময় : ঈদের দিন সকালে ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। অবশ্য এর পরে দিলেও আদায় হবে। ঈদের আগেও দেওয়া যাবে। (ফতোয়ায়ে শামি : ৩/৩৭৬)। কেন না, রাসুল (সা.) ঈদগাহে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (মুসলিম : ২২৫০)। কেউ যদি রমজানের শুরুর দিকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতে চায়, তাহলে বিশুদ্ধ মতানুসারে তাও বৈধ আছে। তবে রমজানের আগে জায়েজ নেই। (ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া : ৩/৪৫২)। আর কেউ যদি ঈদের দিন সকালে ফেতরা আদায় করতে না পারে, তাহলে পরবর্তীতে তা আদায় করতে পারবে। সেটিও আদায় হিসেবে গণ্য; কাজা হিসেবে নয়। (বাদায়েউস সানায়ে : ২/২০৭)।
ফেতরা কাদের দেবেন : যাদের জাকাত দেওয়া যাবে, তাদেরই সদকাতুল ফিতর দেওয়া যাবে। যেমন- গরিব, মিসকিন, ঋণী, মুসাফির ইত্যাদি। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/২৫৫)।
যাদের দেওয়া যাবে না : সদকাতুল ফিতর ধনী ব্যক্তিকে ও ঊর্ধ্বতন পুরুষ বা নারীদের দেওয়া যাবে না। যেমন- পিতা, দাদা, পরদাদা, নানা, পরনানা ও তাদের ওপরের ব্যক্তিগণ। অনুরূপ অধস্তন পুরুষ বা নারীদেরও দেওয়া যাবে না।
যেমন- ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, পুতি ও তাদের সন্তানরা। একইভাবে স্বামী-স্ত্রী একে অপরকেও সদকাতুল ফিতর দিতে পারবে না। (কিতাবুন নাওয়াজেল : ৭/২৫১)।
নারীদের ফেতরা : কোনো নারী যদি নিজেই নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হয়, তাহলে সে নিজেই তার সম্পদ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করবে। স্বামী যদি স্ত্রীর সদকা নিজের টাকা থেকে দিয়ে দেয়, তাহলে তা আদায় হয়ে যাবে। তবে নারীর ফেতরা তার বাবা বা স্বামী কারও ওপরই ওয়াজিব নয়। (ফতোয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ : ৬/৩২৪)।
প্রবাসীদের সদকাতুল ফিতর : সদকাতুল ফিতরের মূল উদ্দেশ্য হলো, অসহায়-মিসকিনদের উপকার হওয়া। সুতরাং যে দেশের গমের মূল্য ধরলে গরিব-মিসকিনদের বেশি উপকার হবে, সেই দেশের পৌনে দুই সের গমের মূল্য ধরে সদকাতুল ফিতর আদায় করবে। (ফতোয়ায়ে রহিমিয়্যা : ৭/১৯৪-১৯৫)।
কাজের লোককে ফেতরা প্রদান : নিজ বাড়ির কাজের লোক যদি নেসাব পরিমাণ মালের মালিক না হয়, তাহলে তাকে ফেতরা দেওয়া যাবে। তবে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েজ নেই। (ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া : ৪/৪২৩)।
সন্তানের ফেতরা : নেসাবের মালিক নিজের ফেতরা ও তার ছোট সন্তানের ফেতরা আদায় করবে। প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের ফেতরা আদায় করা তার ওপর ওয়াজিব নয়। অনুরূপ পিতামাতার ফেতরাও আদায় করা তার ওপর আবশ্যক নয়। তবে দিলে তা আদায় হয়ে যাবে। (আল ফিকহুল ইসলামি : ৩/ ৫৫)।