দেশের অর্থনীতি ছিল ক্রমবর্ধমান। দারিদ্র্যতার কষাঘাত থেকে দেশ দিন দিন উঠে আসছিল। উন্নত দেশগুলোর কাতারে পা রেখেছিল। অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিল। অমনি বৈশ্বিক করোনা মহামারির উপস্থিতি। থমকে দাঁড়াল দেশের অর্থনীতির চাকা। সময়টা ২০২০ সাল। টানা দু’বছর ক্রিয়াশীল থাকে। করোনা মহামারিতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেমে আসে স্থবিরতা। এ সংকট কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে বেধে যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে উন্নত-অনুন্নত প্রায় সব দেশেই দেখা দেয় মূল্যস্ফীতি। সরবরাহব্যবস্থায় বিপত্তি। উৎপাদন ও আমদানি-রপ্তানি হ্রাস। কর্মসংস্থান হারানোসহ নানা বিপর্যয়। বিশেষ করে এ মুহূর্তে আমাদের বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি। বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিতিশীলতা। টাকার অবমূল্যায়ন। আমদানি বৃদ্ধি ও রপ্তানি হ্রাস, ফলে বাণিজ্য ঘাটতি। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ক্রমাবনতি। জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি। এসব কারণে দেশের অর্থনীতি মন্দার শিকার। মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম। তাই দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের সরকার, অর্থনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক, সুশীল সমাজ থিংক ট্যাংক থেকে শুরু করে সচেতন জনগণের মধ্যে বেশ উদ্বেগ ও শঙ্কা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিপদাপদ মানুষের হাতের কামাই : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, বিগত আগস্ট-সেপ্টেম্বেরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে চলে গেছে প্রায় একটি বছর। বর্তমান বাজারে ৭০০ টাকা কেজি কাঁচামরিচের মূল্যের দ্বারা পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়। মানবজীবনে এ জাতীয় বিভিন্ন সংকট দেখা দিতে পারে। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান- সব ক্ষেত্রেই থাকতে পারে সরব উপস্থিতি। এ সংকটের পরিধি ব্যক্তিজীবন ছাপিয়ে রাষ্ট্র বা সমাজ পর্যন্তও পৌঁছাতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, এ সবকিছুই বান্দার হাতের কামাই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষ নিজ হাতে যা কামায়, তার ফলে জলে-স্থলে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহ তাদের কতককে কৃতকর্মের স্বাদ গ্রহণ করান। হয়তো (এর ফলে) তারা ফিরে আসবে।’ (সুরা রুম : ৪১)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদরা বলেন, দুনিয়ায় যে ব্যাপক বালা-মসিবত দেখা দেয়। যেমন- দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ভূমিকম্প, শত্রুর আগ্রাসন, জালিমের অধিপত্য ইত্যাদি। এসবের প্রকৃত কারণ ব্যাপকভাবে আল্লাহতায়ালার হুকুম অমান্য করা, পাপাচারে লিপ্ত হওয়া। এভাবে সব বিপদাপদ মানুষের হাতের কামাই হয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালা মানুষের ওপর বিপদাপদ চাপান এ জন্য, যাতে মানুষের মন কিছুটা নরম হয় এবং দুষ্কর্ম থেকে নিবৃত হয়।
সংকট নিরসনে ইসলামের নির্দেশনা : এসব সংকট ও সমস্যা সমাধানে ইসলামে রয়েছে শাশ্বত পন্থা ও নিখুঁত উপাদান। যেগুলো অনুসরণের মাধ্যমে দেশে দেশে ফিরে আসতে পারে সুখ-শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধের মাহেন্দ্রক্ষণ। তা হলো-
১. ঈমান ও তাকওয়া : বাস্তবিক অর্থে জীবনের সুখ-শান্তি ও তৃপ্তি-পরিতৃপ্তি দানের মালিক আল্লাহতায়ালা। সবকিছুর চাবিকাঠি তাঁর?ই হাতে। তাই তাঁর ওপর পরিপূর্ণ ঈমান এনে তাঁকে ভয় করে চলার নীতি অবলম্বন করা চাই। তাহলে সে জনপদকে তিনি সমৃদ্ধ সুখ-শান্তি দেবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি সেসব জনপদবাসী ঈমান আনত ও তাক?ওয়া অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশমণ্ডলী ও জমিন থেকে কল্যাণধারা অবারিত করতাম। কিন্তু তারা সত্য প্রত্যাখ্যান করল। সুতরাং তারা ক্রমাগত যা করে যাচ্ছিল, তার পরিণামে আমি তাদের পাকড়াও করি।’ (সুরা আরাফ : ৯৬)।
২. তাওয়াক্কুল বা ভরসা : আল্লাহতায়ালার প্রতি ভরসা রাখা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ঈমানদাররা ভালো ও কল্যাণকর কাজে নিজে সাধ্যমতো চেষ্টা করে ও ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করে। আর তাওয়াক্কুলের নীতি অবলম্বনকারী কখনও হতাশ হয় না। বিপদাপদে অবিচল থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, আল্লাহই তার (কর্ম সম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা তার কাজ পূরণ করেই থাকেন। অবশ্য আল্লাহ সবকিছুর জন্য একটা পরিমাণ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।’ (সুরা তালাক : ৩)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে আল্লাহতায়ালা তার কাজ পূর্ণ করে দেন। তার কাজ পূর্ণ করার ধরন ও সময় আল্লাহই নির্ধারণ করেন। তবে উপায় অবলম্বন করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থি নয়; বরং তা অবলম্বন করাও আল্লাহর হুকুম। কিন্তু ভরসা রাখতে হবে আল্লাহর ওপর, উপায়ের ওপর নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা যদি যথাযথ তাওয়াক্কুল বা ভরসা কর, তাহলে তিনি তোমাদের এমনভাবে রিজিক দেবেন, যেমন তিনি রিজিক দেন পাখিদের। তারা প্রভাতকালে খালি পেটে বের হয়, আর সন্ধ্যায় ভরা পেটে নীড়ে ফেরে।’ (তিরমিজি : ২৩৪৪)।
৩. ইস্তেগফার : ইস্তেগফার হলো মহামহিম আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এটি অন্যতম একটি ইবাদত। ইস্তেগফার দ্বারা সব ধরনের সংকট দূর হয়। বালা-মসিবত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তাদেরকে বানিয়েছি নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য। নিশ্চয় তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে উন্নতি দান করবেন। তোমাদের জন্য নদনদীর ব্যবস্থা করবেন।’ (সুরা নুর : ১০-১২)।
৪. মিতব্যয়ী হওয়া : বৈধ কাজে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় করাকে বলে অপচয়। আর অবৈধ কাজে ব্যয় করা হলো অপব্যয়। দুটোই ইসলামে দোষণীয় ও নিষিদ্ধ। আল্লাহতায়ালা মিতব্যয়ী হতে আদেশ করেছেন এবং অপচয় রোধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। (সুরা আরাফ : ৩১ )। অপব্যয়কারী সম্পর্কে বলেন, ‘কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে, তারা শয়তানের ভাই। শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬২৭)।
৫. আয় বুঝে ব্যয় : আয়-ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যতা চিরস্থায়ী সুখের সোপান। আয় বুঝে ব্যয় না করলে দারিদ্র্য বেড়ে যায় পাগলা সাপের মতো। এ ক্ষেত্রে পরিমিত বোধ থাকলে সাধারণত অভাব আসে না। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে, সে কখনও অভাবগ্রস্ত হয় না। (মুসনাদে আহমদ : ৪২৬৯)।
৬. দুর্নীতি দমন : লেনদেন ও জীবনঘনিষ্ঠ কালচারে পরিচ্ছন্নতা ইসলামে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সম্পর্কে অজস্র আয়াত ও হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হুমকি-ধমকি ও ভীতিপ্রদ বার্তা দিয়ে নিবৃত রাখতে ইসলাম একদম কার্পণ্য করেনি। প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতিকে কঠোরভাবে দমন করা গেলে কোনো সংকট থাকবে না, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’ (সুরা নিসা : ২৯)।
৭. জাকাতব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা : জাকাত ইসলামি অর্থব্যবস্থার অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধান। ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম। স্বাধীন, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ, বুদ্ধিসম্পন্ন ও সম্পদশালী মুসলিম নর-নারী বছরান্তে তার সম্পদের ৪০ ভাগের একভাগ গরিব-অসহায়দের দেয়াকে জাকাত বলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং জাকাত আদায় করো। তোমরা যে সৎকর্ম করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ তা দেখেন।’ (সুরা বাকারা : ১১০)। জাকাত এমন একটি বিবেকলব্ধ ইবাদত, যার ফলে ধনী-গরিবের মধ্যকার বৈষম্য দূর হয় এবং স্থিতিশীল অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
৮. সাধ্যমতো দান-সদকা করা : দান-সদকা ইসলামের মৌলিক বিধিবিধানের অন্তর্ভুক্ত না হলেও ইসলামে গুরুত্বশীল একটি ইবাদত। যার মাধ্যমে অন্তরে নুর বৃদ্ধি পায়। বালা-মসিবত দূর হয়। হাদিসে আছে, ‘দান-সদকা বালা-মসিবত দূর করে।’ (তিরমিজি : ২৩২৫)।
৯. নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা : আল্লাহতায়ালা বাংলার ভূমিকে প্রকৃতিগত নেয়ামতের দিক থেকে বিশেষ রহমত ও বরকত দান করেছেন। তাই এ নেয়ামত কাজে লাগানো চাই। যথা- কৃষি উৎপাদন। বাংলাদেশি ভূমির উর্বরতা বিশ্বমণ্ডলে সুপরিচিত ও সুবেদিত। সুতরাং সংকট পূরণে বাংলার ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি কাজে লাগাতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা আমার নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা শোকরিয়া আদায় করো, তাহলে আমি তা বাড়িয়ে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে জেনে রেখ আমার আজাব বড় মর্মন্তুদ।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)।
১০. দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ : বিশ্বচরাচর সব সময় এক রকম থাকে না। কখনও মানুুষ অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি বা দুর্ভিক্ষের কবলেও পড়তে পারে; সে জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। খাদ্যশস্য বা ধন-সম্পদের কিছুটা সংরক্ষণ করা দরকার। ইউসুফ (আ.) মিসরের খাদ্যভাণ্ডারের দায়িত্ব নিয়ে এমনটাই করেছিলেন। কোরআনে এসেছে, ‘ইউসুফ বলল, তোমরা ৭ বছর লাগাতার চাষাবাদ করবে। এর যতটুকু শস্য কাটবে, তার সামান্য খাবে; আর বাকি সব শীষসমেত সংরক্ষণ করবে। এরপর সাতটি কঠিন বছর আসবে; এ সাত বছর যা আগে সঞ্চয় করে রাখবে, লোকে তা খাবে; শুধু সামান্য কিছু যা তোমরা (বীজ হিসেবে) সংরক্ষণ করবে, তা ছাড়া।’ (সুরা ইউসুফ : ৪৮)।