ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাকাতের গুরুত্ব ও আবশ্যিকতা

মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ
জাকাতের গুরুত্ব ও আবশ্যিকতা

জাকাতের আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ও প্রশংসা। উল্লিখিত সব ক’টি অর্থই কোরআন ও হাদিসে উদ্ধৃত হয়েছে। পারিভাষিক অর্থে জাকাত বলতে ধনীদের ধন-সম্পদে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নির্ধারিত অংশকে বোঝায়। তাই ইসলামি শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত নেসাব পরিমাণ মালের নির্দিষ্ট অংশ নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করার নাম জাকাত। (ফিকহুল মুয়াসসার : ১২১)। জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে। বিত্তশালীদের পরিশুদ্ধ করে। দারিদ্র্য মোচন করে ও উৎপাদন বৃদ্ধি করে; অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করে এবং সমাজে শান্তি আনে। কোরআন ও হাদিসের অনেক স্থানে ‘জাকাত’-কে ‘সাদাকাহ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। কোরআনের ৮টি মক্কি ও ২২টি মাদানি সুরার ৩০টি আয়াতে ‘জাকাত’ শব্দটি উল্লিখিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি আয়াতে ‘সালাত’-এর সঙ্গেই ‘জাকাত’ শব্দ এসেছে।

জাকাত পূর্ণাঙ্গ ইসলামের মাধ্যম : জাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। একে বাদ দিয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলাম মানা সম্ভব নয়। আর পূর্ণ মোমিন হওয়ার জন্য ইসলামের যাবতীয় বিধান মানা অবশ্যক। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ, আর কিছু অংশ অস্বীকার করো? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কি প্রতিদান হতে পারে? কেয়ামত দিবসে তাদের কঠিনতম আজাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে উদাসীন নন।’ (সুরা বাকারা : ৮৫)।

জাকাত প্রশান্তি লাভের মাধ্যম : মানুষের সম্পদ যত বেশিই হোক না কেন, যদি তার কোনো প্রতিবেশী অনাহারে দিনাতিপাত করে, তাহলে সে কখনও তার অন্তরে প্রশান্তি লাভ করতে পারে না। বরং যখন তার সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ ওই গরিব লোকটিকে দিয়ে সচ্ছল করে, তখন সে অন্তরে প্রশান্তি লাভ করে। প্রত্যেক মানুষ যেহেতু তার সম্পদকেই অধিক ভালোবাসে, এমনকি সম্পদের জন্য মানুষ নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না, সেহেতু সেই অধিক ভালোবাসার বস্তু অন্যের জন্য পছন্দ করার মাধ্যমেই পূর্ণ ঈমানদার হওয়া সম্ভব। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ প্রকৃত মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করবে, যা তার নিজের জন্য পছন্দ করে।’ (বোখারি : ১৩, মুসলিম : ৪৫, মিশকাতুল মাসাবিহ : ৪৯৬১)।

জাকাত জান্নাত লাভের মাধ্যম : রাসুল (সা.) বলেন, ‘জান্নাতের মধ্যে এমন সব (মসৃণ) ঘর রয়েছে, যার বাইরের জিনিসগুলো ভেতর হতে এবং ভেতরের জিনিসগুলো বাইর হতে দেখা যায়। সেসব ঘর আল্লাহতায়ালা সেই ব্যক্তির জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন, যে ব্যক্তি (মানুষের সঙ্গে) নম্রতার সঙ্গে কথা বলে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে (জাকাত আদায় করে), পর পর সিয়াম পালন করে এবং রাতে সালাত আদায় করে, অথচ মানুষ তখন ঘুমিয়ে থাকে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৩৫১, মিশকাতুল মাসাবিহ : ১২৩২)।

জাকাত মুসলিম ঐক্যের সোপান : জাকাত আদায়ের মাধ্যমে মুসলিম ঐক্য সুদৃঢ় হয়। এমনকি এটি সমগ্র মুসলিম জাতিকে একটি পরিবারে রূপান্তরিত করে। ধনীরা যখন গরিবদের জাকাত আদায়ের মাধ্যমে সহযোগিতা করে, তখন গরিবরাও তাদের সামর্থ্যানুযায়ী ধনীদের ওপর সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে। ফলে তারা পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।’ (সুরা কাসাস : ৭৭)। তিনি আরো বলেন, ‘এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তার বিপদগুলো দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।’ (বোখারি : ১৪৪২, মুসলিম : ২৫৮০, মিশকাতুল মাসাবিহ : ৪৯৫৮)।

দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান মাধ্যম : প্রাচীনকাল হতে মানুষ ধনী-গরিবে বিভক্ত। ধনিক শ্রেণির সম্পদের আধিক্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে, আর দরিদ্র শ্রেণি ক্ষীণ হতে হতে মাটির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তেলহীন প্রদীপের ন্যায় নিভু নিভু জীবন প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে মাত্র। এর কারণ, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলো দরিদ্রের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ প্রদর্শনে উৎসাহ দিলেও তা বাধ্যতামূলক করেনি এবং দানের পরিমাণও নির্ধারণ করেনি। পক্ষান্তরে ইসলাম ‘জাকাত’ নামে এমন এক বিধান দিয়েছে, যার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ দরিদ্রের মাঝে বণ্টন বাধ্যতামূলক করে দারিদ্র্য বিমোচনে চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর তাদের সম্পদের মধ্য থেকে জাকাত ফরজ করেছেন। যেটা ধনীদের কাছ থেকে গৃহীত হবে আর দরিদ্রের মাঝে বণ্টন হবে।’ (বোখারি : ১৩৯৫, মুসলিম : ১৯)।

জাকাত আদায়ে সম্পদ বাড়ে : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ কোনো অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৬)। অতএব, জাকাত আদায় করলে এবং দান করলে সম্পদ কমে যায় না; বরং তা বৃদ্ধি পায়। যে কোনো মাধ্যমে আল্লাহ তার রিজিক বৃদ্ধি করে দেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দান সম্পদ কমায় না; ক্ষমা দ্বারা আল্লাহ কোনো বান্দার সম্মান বৃদ্ধি ছাড়া হ্রাস করেন না এবং যে কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে বিনয় প্রকাশ করে, আল্লাহ তাকে উন্নত করেন।’ (মুসলিম : ২৫৮৮, মিশকাতুল মাাসবিহ : ১৮৮৯)।

জাকাত কল্যাণ নাজিলের মাধ্যম : জাকাত আদায় করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ কল্যাণ হাসিল হয়। যারা জাকাত দেয় না, তারা সেই কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়। রাসুল (সা.) তাদের সতর্ক করে বলেন, ‘তারা তাদের সম্পদের জাকাত আদায়কে বাধা দেয় না; বরং আকাশ হতে (রহমতের) বৃষ্টি বর্ষণকে বাধা দেয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০১৯)।

ইসলামে জাকাতের বিধান : প্রত্যেক মুসলিম স্বাধীন ব্যক্তির ওপর জাকাত ফরজ। যা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের তৃতীয় স্তম্ভ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সালাত কায়েম কর ও জাকাত দাও। আর যারা রুকু করে, তাদের সঙ্গে রুকু কর।’ (সুরা বাকারা : ৪৩)। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের সম্পদ হতে সদকা গ্রহণ করবে। এর দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র ও পরিশোধিত করবে।’ (সুরা তওবা : ১০৩)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইসলামের স্তম্ভ হচ্ছে পাঁচটি- আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল- এ কথার সাক্ষ্যপ্রদান করা, সালাত কায়েম করা, জাকাত আদায় করা, হজ সম্পাদন করা এবং রমজানের সিয়াম পালন করা।’ (বোখারি : ৪, মুসলিম : ১৬; মিশকাতুল মাসাবিহ : ৩)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) মুআজ (রা.)-কে ইয়েমেন দেশে (শাসক হিসেবে) প্রেরণ করেন। তখন বললেন, ‘সেখানকার অধিবাসীদের এ সাক্ষ্য দানের প্রতি আহ্বান জানাবে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসুল। যদি তারা তা মেনে নেয়, তবে তাদের অবগত কর যে, আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর প্রতি দিনরাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছেন। যদি সেটাও তারা মেনে নেয়, তবে তাদের অবগত কর যে, আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর তাদের সম্পদে জাকাত ফরজ করেছেন। যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গৃহীত হবে আর দরিদ্রের মাঝে বণ্টন হবে।’ (বোখারি : ১৩৯৫, মুসলিম : ১৯)।

লেখক : খতিব, কাজী ফিরোজ রশিদ জামে মসজিদ, ঘাঘর বাজার, কোটালিপাড়া, গোপালগঞ্জ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত