বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর জাকাত আদায়ে বিলম্ব করা যায় না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি, তোমরা তা থেকে ব্যয় করবে তোমাদের কারও মৃত্যু আসার আগে। অন্যথায় মৃত্যু এলে সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরো কিছু কালের অবকাশ কেন দিলে না! তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ (সুরা মুনাফিকুন : ১০)। এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো, নেসাবের মালিক হওয়ার সময়টি সামনে রাখা এবং ঠিক তার এক বছর পর সেই সময়ই জাকাত আদায় করা। নির্দিষ্ট সময়টি জানা থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো মাসের অপেক্ষায় বসে থাকা উচিত নয়। যেদিন এক বছর পূর্ণ হবে, সেদিনই জাকাত আদায় করা ফরজ। এরপর যখনই জাকাত আদায় করা হোক, সে পরিমাণই আদায় করতে হবে, যা সেদিন ফরজ হয়েছিল। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১০৫৫৯)। আর বছর পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে চন্দ্রবর্ষের হিসাব ধর্তব্য, সৌরবর্ষের নয়।
জাকাত আদায়ে নিয়ত : জাকাত আদায় হওয়ার জন্য জাকাত প্রদানের নিয়ত করা জরুরি। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৫৮)। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই জাকাত প্রদান করতে হবে। জনসমর্থন অর্জনের জন্য, লোকের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কিংবা অন্য কোনো জাগতিক উদ্দেশ্যে জাকাত দেওয়া হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। (সুরা বাকারা : ২৬৪)।
জাকাতের উপযুক্ত খাতে (যেমন ফকির-মিসকিনকে) দেওয়ার সময় জাকাতের নিয়ত করতে হবে। এটাই মূল নিয়ম। তবে নিজের সম্পদ থেকে জাকাতের টাকা পৃথক করে রাখলে, পৃথক করার সময়ের নিয়তই যথেষ্ট হবে। এখান থেকে ফকির-মিসকিনকে দেওয়ার সময় নতুন নিয়ত না করলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৮)। জাকাতের উদ্দেশ্যে টাকা পৃথক করে রাখলেও মালিক তা প্রয়োজনে খরচ করতে পারবে। তবে পরে জাকাত আদায়ের সময় জাকাতের নিয়ত করতে হবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১০৩৯১, ১০৩৯২)।
বিড়ম্বিত নিয়তের বিধান : জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কিছু টাকা দান করা হয়েছে; কিন্তু দান করার সময় দানকারীর মনে জাকাতের নিয়ত ছিল না, তাহলে গ্রহীতার কাছে সেই টাকা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় জাকাতের নিয়ত করলে জাকাত আদায় হবে। তদ্রূপ জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে কোনো খাদ্যদ্রব্য দেওয়া হলে গ্রহীতা তা খেয়ে ফেলার বা বিক্রি করে দেওয়ার আগে জাকাতের নিয়ত করলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। এরপর জাকাতের নিয়ত করলে জাকাত হিসেবে আদায় হবে না। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৬৮, রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৮-২৬৯)। আবার জাকাতের টাকা আলাদা করে রাখা হয়েছে; কিন্তু ফকির-মিসকিনকে দেওয়ার আগেই তা চুরি হয়ে গেল বা অন্য কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেল, তাহলে জাকাত আদায় হবে না। পুনরায় জাকাত দিতে হবে। (মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৬৯৩৬-৬৯৩৮, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৬/৫৩১-৫৩২, রদ্দুল মুহতার : ২/২৭০)।
যে পরিমাণ জাকাত ফরজ : যে সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ হয়েছে, তার ৪০ ভাগের একভাগ (২.৫০ শতাংশ) জাকাত দেওয়া ফরজ। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা হারে নগদ টাকা কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়-চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হবে।
(সুনানে নাসায়ি : ২২৩০-২২৩৩, সুনানে আবি দাউদ : ১৫৭০-১৫৭২, তিরমিজি : ৬২৩, সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৮০৩, মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৭১৩৩-৭১৩৪, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ১০৫৩৯-১০৫৮১)। যে পরিমাণ জাকাত ফরজ হয়, স্বেচ্ছায় তার চেয়ে বেশি দিয়ে দিলেও অসুবিধা নেই। এতে জাকাত আদায় এবং বাড়তি দান দুটোরই সওয়াব পাওয়া যাবে। (মুসনাদে আহমদ : ২০৭৭, মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৬৯০৭)।
জাকাত আদায়ে অবগতি জরুরি নয় : জাকাত গ্রহণকারীকে এ কথা জানানোর প্রয়োজন নেই, তাকে জাকাত দেওয়া হচ্ছে। যে কোনোভাবে দরিদ্র ব্যক্তিকে জাকাতের মাল দেওয়া হলে মালিক যদি মনে মনে জাকাতের নিয়ত করে, তাহলে জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৮)। তবে অন্যের পক্ষ থেকে জাকাত আদায় করতে হলে তার অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় সে ব্যক্তির পক্ষ থেকে জাকাত আদায় হবে না। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৯)।
জাকাত দেওয়ার অনুমতি : গৃহকর্তা যদি ঘরের লোকদের জাকাত দেওয়ার অনুমতি দিয়ে রাখেন, তাহলে তারা জাকাতের নিয়তে কাউকে কিছু দিলে তা জাকাত হিসেবে আদায় হবে। আর যদি আগে অনুমতি দেওয়া না থাকে, আর ঘরের লোকেরা জাকাত হিসেবে কিছু দান করে, তাহলে যাকে দান করা হলো, সে সেই অর্থ খরচ করার আগেই যদি গৃহকর্তার অনুমতি পাওয়া যায়, তাহলেও তা জাকাত হিসেবে আদায় হবে। অন্যথায় জাকাত আদায় হবে না। পুনরায় আদায় করতে হবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৬৯)।
ঋণের জাকাতের নিয়ম : ঋণগ্রস্তকেই জাকাতের টাকা দেওয়া উত্তম। কেন না, এতে তাকে ঋণের দায় থেকে মুক্ত করা হয়। আর কোনো স্বচ্ছল ব্যক্তি যদি জাকাত গণ্য করার নিয়ত করা ছাড়াই ঋণগ্রহীতার ঋণ ক্ষমা করে দেয়, তবে তো কথাই নেই। (রদ্দুল মুহতার : ২/২৭১)। কোনো দরিদ্র ব্যক্তির কাছে কারও কিছু টাকা পাওনা আছে। এখন সে যদি জাকাতের নিয়তে পাওনা মাফ করে দেয়, তাহলে জাকাত আদায় হবে না। তাকে জাকাত দিতে হলে নিয়ম হলো, প্রথমে তাকে জাকাত দেওয়া। এরপর সেখান থেকে ঋণ উসুল করে নেওয়া। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৭০, রদ্দুল মুহতার : ২/২৭১)।