মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

সহকারী মুফতি, মারকাজুশ শাইখ আরশাদ আল মাদানি, মানিকনগর, ঢাকা

প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রশ্ন : মোবাইলে এমপি থ্রি, ক্যামেরা এবং ভিডিও, ইন্টারনেটসহ সবধরনের সুবিধা রয়েছে। এগুলো ভালো-খারাপ উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। এসব সুবিধাযুক্ত মাল্টিমিডিয়া মোবাইল বেচাকেনা করা জায়েজ হবে?

উত্তর : বেচাকেনা জায়েজ। তবে অবৈধ কোনো কাজে তা ব্যবহার করা জায়েজ নয়। (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩৯১, আল-বাহরুর রায়েক : ৮/২০২, জাওয়াহিরুল ফিকহ : ২/৪৪৬, বুহুস ফি কাজায়া ফিকহিয়্যাহ : ১/৩৫৯)।

প্রশ্ন : চুরি বা ছিনতাইকৃত মোবাইল কেনা যাবে?

উত্তর : ছিনতাইকৃত বা চোরাই মোবাইল জেনেশুনে কেনা জায়েজ নেই। কেউ কিনলেও তা ব্যবহার করা বৈধ হবে না। বরং মালিক জানা থাকলে মূল মালিকের কাছে পৌঁছে দেওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতার কাছ থেকে মূল্য ফেরত নিতে পারবে। মালিকের সন্ধান পাওয়া না গেলেও বিক্রেতার কাছ থেকে মূল্য ফেরত নিতে পারবে। (আল মুহিতুল বোরহানি : ৭/৫৯, বাদায়েউস সানায়ে : ৬/৪৫, ফতোয়ায়ে খানিয়া : ৩/৪১৮, ফাতহুল কাদির : ৫/১৬৯)।

প্রশ্ন : মোবাইলের রিংটোন, মিউজিক, গান, ভিডিও-ছবি বা ইন্টারনেট ইত্যাদি লোডের ব্যবসা করা যাবে?

উত্তর : মিউজিক সংবলিত গান, প্রচলিত অশ্লীল ছবির ভিডিও ফিল্ম, অবৈধ চিত্র ইত্যাদির ডাউনলোড ব্যবসা নাজায়েজ। কারণ, এতে নিজের তো গোনাহ হয়ই, উপরন্তু অন্যের কাছে গোনাহের উপকরণ সরবরাহ করা হয়। তাই এ ধরনের ডাউনলোড থেকে উপার্জিত অর্থ হালাল হবে না। তবে কোনো বৈধ চিত্র, মিউজিক ছাড়া রিংটোন, বাদ্যহীন গজল ইত্যাদি ডাউনলোড করা জায়েজ এবং এর থেকে অর্জিত টাকাও হালাল। (বোখারি : ১/২৯৮, তিরমিজি : ১/২৪১, মুসলিম : ২১৯, শরহে নববি : ২/২৯, আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৫৫, আল বাহরুর রায়েক : ৮/১৯)।

প্রশ্ন : স্ক্র্যাচকার্ডের গায়ের মূল্যের চেয়ে কমবেশিতে বেচাকেনা করা জায়েজ হবে?

উত্তর : স্ক্র্যাচকার্ডের গায়ের মূল্য একটি নির্ধারিত পরিমাণ টেলিযোগাযোগ সুবিধা তথা আউটগোয়িং সেবা প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যান্য সেবার মতো এটিও বিক্রিযোগ্য সেবা। সুতরাং কার্ডের গায়ের দাম যেহেতু টাকা নয়, তাই কমবেশিতে বিক্রি করা যাবে। তবে কোম্পানি থেকে পণ্যের বা সেবার মূল্য নির্ধারিত করে দিলে ওই নির্ধারিত মূল্যেই বিক্রি করা নিয়ম। কমবেশি করা ঠিক নয়। কেন না, এতে বাজারের স্বাভাবিকতা বাঁধাগ্রস্ত হয়। (ফাতহুল কাদির : ৬/১৫৯, তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম : ১/৪০০)।

প্রশ্ন : স্বামীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রী-স্বামীর অর্থ-সম্পদ, দান-সদকা করতে পারবে?

উত্তর : না, পারবে না। কেন না, রাসুল (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, ‘কোনো নারী নিজের স্বামীর ঘর থেকে তার অনুমতি ছাড়া কোনো কিছু ব্যয় ও খরচ করবে না। এমনকি খাবার জাতীয় জিনিসও।’ তবে বিষয়টি যে একেবারে নিষিদ্ধ, এমন নয়; বরং স্বামীর মৌন সমর্থন থাকলে তা করা যেতে পারে। যদি স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রী অল্প কিছু দান-সদকা করেন এবং পরবর্তীতে স্বামী তা জেনে মৌন সমর্থন দেন, তাহলে ধরে নিতে হবে, এতে তার পক্ষ থেকে অনুমতি আছে। এ রকম দান-সদকা বৈধ। এতে ভালো কাজের কারণে স্ত্রী সওয়াব পাবেন। আর স্বামীও তার সম্পদের অংশবিশেষ দান করার কারণে সওয়াব পাবেন। (বোখারি : ১৪৪০, কিতাবুল ফাতাওয়া : ৩/৩৪০)।

প্রশ্ন : অবাধ্য ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করলে পিতার সম্পদ থেকে সে বঞ্চিত বা ত্যাজ্য হবে?

উত্তর : প্রচলিত নিয়মে ত্যাজ্য করা সত্ত্বেও সন্তান পিতার মৃত্যুর পর ওয়ারিশসূত্রে সম্পত্তির অংশিদার হয়। তবে পুত্র যদি পিতার অবাধ্য হয়ে বিভিন্ন গোনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে এবং ভবিষ্যতে পৈতৃক সম্পত্তি হারাম কাজে নষ্ট করার প্রবল আশঙ্কা থাকে, তাহলে পিতা তার জীবদ্দশায় নিজ সম্পদ সদকায়ে জারিয়ার কাজে ব্যয় করে দিতে পারেন অথবা সম্পূর্ণ সম্পত্তি অন্য ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে পারেন। অবাধ্য ছেলেকে পদ্ধতিদুটির যে কোনো একটি অবলম্বন করে বঞ্চিত করে দেওয়ায় পিতার গোনাহ হবে না। (খোলাসাতুল ফাতাওয়া : ৪/৪০০)।

প্রশ্ন : মদের বোতল বানানোর কারখানায় চাকরি করা ও তার বেতন গ্রহণ করা হালাল হবে?

উত্তর : বোতলগুলো যদি শুধু মদের জন্যই ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তাহলে এগুলোর কারখানায় চাকরি করা ও বেতন গ্রহণ করা জায়েজ হবে না। আর যদি অন্য ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়, তাহলে নাজায়েজ হবে না। (সুরা মায়িদা : ২, সুনানে আবি দাউদ : ৩৬৭৪, বাদায়েউস সানায়ে : ৬/৩)।

প্রশ্ন : বিদেশ থেকে অনুমতিবিহীন চোরাই পথে আমদানিকৃত জিনিস কিনলে গোনাহ হবে?

উত্তর : বিদেশ থেকে চোরাই পথে আমদানিকৃত জিনিস ক্রয়ে যদি প্রতারণা, মিথ্যার আশ্রয় বা অন্য কোনো গর্হিত কাজে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকে, তাহলে তা ক্রয় করা বৈধ। তবে কোনো প্রকার আইনি জটিলতায় পড়ার আশঙ্কা থাকলে ক্রয় না করাই নিরাপদ। (বুহুস ফি কাজায়া ফিকহিয়া মুআসারা : ১/১৬৬-১৬৭, ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১২/৩৫৩)।

প্রশ্ন : আকিকার পশুর চামড়া বিক্রি করা যাবে?

উত্তর : আকিকার পশুর চামড়ার বিধান কোরবানির চামড়ার মতোই। চামড়া নিজে ব্যবহার করতে পারবে অথবা ধনী-গরিব যে কাউকে দান করতে পারবে। তবে বিক্রি করলে বিক্রয়মূল্য কোনো অসহায়, গরিব বা এতিমকে সদকা করে দিতে হবে। (আল ফিকহুল ইসলামি ওয়া আদিল্লাতুহু : ৪/২৮৭)।

প্রশ্ন : পুকুর থেকে মাছ না ধরে অনুমান করে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে?

উত্তর : পুকুরে পানিতে মাছ থাকাবস্থায় তা মোটেও হস্তান্তরযোগ্য নয়। তাই পুকুরের মাছ না ধরে বিক্রি করা জায়েজ হবে না। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৩/১১৩)।

প্রশ্ন : মাছ দেওয়ার শর্তে মাছ ধরালে তা জায়েজ হবে?

উত্তর : এ পদ্ধতিতে জেলেদের পারিশ্রমিক প্রদান করা বৈধ নয়। জেলেদের পারিশ্রমিক প্রথমে নির্ধারণ করে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নগদ টাকা বা সমমূল্যের নির্ধারিত পরিমাণ মাছ যে কোনো একটি উল্লেখ করা যেতে পারে। এ হিসেবে মাছ শিকারের পর ইচ্ছে করলে শিকারকৃত মাছ থেকেও মজুরি পরিশোধ করায় আপত্তি নেই। (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৫৬)।

প্রশ্ন : আমি একটি জেনারেল (সুদি) ব্যাংকে প্রায় ৯ বছর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছি। এ সময়ে প্রাপ্ত বেতন-বোনাস দিয়ে গাড়ি-বাড়ি করেছি। পরবর্তীতে এক সময় ‘সুদি ব্যাংকে চাকরি করা বৈধ নয়’ মাসআলাটি জানার পর সুদি কারবারের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে নিজের মধ্যে অনুশোচনা জাগে। ফলে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন অন্য একটি চাকরিতে যোগদান করেছি। জানতে চাচ্ছি, আগের চাকরির বেতন-বোনাস দিয়ে যে গাড়ি-বাড়ি করেছি, তা আমার জন্য বৈধ কি-না? যদি বৈধ না হয়ে থাকে, তাহলে আমার এখন করণীয় কী?

উত্তর : সুদি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যে আয় দিয়ে গাড়ি-বাড়ি বা অন্য যে সম্পদ গড়েছেন, তা ভোগ করা জায়েজ হবে না। এখন আপনি যদি এ গাড়ি-বাড়ি ও অন্যান্য সম্পদ থেকে বৈধভাবে উপকৃত হতে চান, তাহলে যে পরিমাণ টাকা দিয়ে এ গাড়ি-বাড়ি ও অন্যান্য সম্পদ কিনেছেন, সে পরিমাণ টাকা সওয়াবের নিয়ত ছাড়া গরিব-মিসকিনদের মধ্যে সদকা করে দিতে হবে। এভাবে যতটুকু সদকা করবেন, ততটুকু সম্পদ আপনার জন্য হালাল বলে বিবেচিত হবে।

উল্লেখ্য, গাড়ি-বাড়ি করার পর এগুলো ভাড়ায় দিয়ে থাকলে তা থেকে উপার্জিত টাকাও সদকা করে দিতে হবে এবং অতীতের হারাম উপার্জন ও হারাম ভোগ-ব্যবহারের কারণে আল্লাহতায়ালার কাছে তওবা-ইস্তিগফার করতে হবে। (মুসলিম : ১৫৯৮, বাদায়েউস সানায়ে : ৬/১৪৫, ফাতহুল কাদির : ৮/২৫৮, আল বাহরুর রায়েক : ৮/১১৪)।