ইসলামে জীবন-জীবিকার তাগিদে ঋণ করার যৌক্তিক অবকাশ রয়েছে; কিন্তু বিলাসিতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ঋণ গ্রহণ করা কাম্য নয়। ঋণ করে কেনাকাটা করা আত্মমর্যাদা বোধের চরম অবমাননা। এ ব্যাপারে শরিয়ত নিরুৎসাহিত করেছে। অপ্রয়োজনীয় ধার-দেনা রাসুল (সা.)-এর বেশ অপছন্দনীয় ছিল। কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তিনি তার জানাজার নামাজ পড়ানোর আগে জিজ্ঞেস করতেন, ‘মৃতের কোনো ঋণ আছে?’ যদি ঋণ থাকত, তাহলে তার জানাজার নামাজ পড়াতেন না।’ (বোখারি : ২২৮৯)। রাসুল (সা.) নিয়মিত ঋণ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি রোজ নামাজে এ দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! গোনাহ ও ঋণগ্রস্ততা থেকে আপনার কাছে পানাহ চাই।’ (বোখারি : ২২৬৭)।
অপ্রয়োজনীয় ঋণের পরকালীন ক্ষতি : ১. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির অনাদায় ঋণ জান্নাতে প্রবেশের পথে বাধা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি তিনটি বিষয় হতে মুক্ত থাকাবস্থায় তার রুহ তার দেহ হতে আলাদা হলে সে জান্নাতে যাবে- ১. অহংকার, ২. ঋণ, ৩. যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আত্মসাৎ।’ (তিরমিজি : ২৭৮৫)।
২. অন্যান্য গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়ার আশা থাকলেও অনাদায় ঋণ আল্লাহতায়ালা ক্ষমা করবেন না। এটি পাওনাদারের হক তথা হক্কুল ইবাদ। বান্দার হক বান্দার কাছ থেকেই ক্ষমা করিয়ে নিতে হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঋণ ছাড়া শহিদের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম : ৪৭৭৭)।
৩. অনাদায় ঋণ রেখে মারা গেলে নেক আমলের মাধ্যমে সে ঋণ পরিশোধ করা হবে। কেন না, কেয়ামতের দিন টাকা-পয়সার মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা থাকবে না। যে ব্যক্তি এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, নিঃসন্দেহে সে পরকালে নেক আমলের মহাসংকটে ভুগবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি তার জিম্মায় এক দিনার বা এক দিরহাম পরিমাণ ঋণ রেখে মারা গেলেও (কেয়ামতের দিন) তার নেক আমলের মাধ্যমে তা পরিশোধ করা হবে। কেন না, সেখানে কোনো দিনারও থাকবে না, দিরহামও থাকবে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪১৪)।
জাগতিক ক্ষতি : ১. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির সামাজিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়। দুশ্চিন্তা, হতাশা ও অশান্তি সঙ্গী হয়। পাওনাদারদের সঙ্গে সাক্ষাতের ভয়ে লোকচক্ষু এড়িয়ে চলতে হয়। শুধু তা-ই নয়, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ডিপ্রেশন সহ্য করতে না পেরে কিংবা ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে বাধ্য হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ঋণের শুরু হয় দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে, শেষ হয় সংঘাতের মাধ্যমে।’ (মুয়াত্তায়ে মালেক : ১২৬)।
২. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি মিথ্যা ও ওয়াদা ভঙ্গের মতো নৈতিক স্খলনের শিকার হয়। কেন না, পাওনাদারদের পাওনা সঠিক সময়ে পরিশোধ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে মিথ্যা ও ওয়াদা ভঙ্গের আশ্রয় নিতে হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে, কথা বলার সময় মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে।’ (বোখারি : ৮৩২)।
ঋণ থেকে বাঁচার উপায় : ১. ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রাসুল (সা.) আল্লাহর কাছে এ দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে দুঃখ-দুশ্চিন্তা থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, ভীরুতা ও কার্পণ্য থেকে, ঋণের বোঝা ও মানুষের প্রাবল্যে শিকার হওয়া থেকে পানাহ চাই।’ (বোখারি : ৬৩৬৯)।
২. অপ্রয়োজনে ঋণ করার পাশাপাশি প্রয়োজনের সময়েও ঋণ না করার যথাসাধ্য চেষ্টা করা। ধৈর্য ও আল্লাহর ওপর ভরসাকে উপায় অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করা।
৩. সুখময় জীবনযাপনের জন্য অল্পে তুষ্টির বিকল্প নেই। অল্পে তুষ্টতা কোনো ব্যক্তির মাঝে স্থান করে নিলে সাধ্যের বাইরে কেনাকাটা বা বিলাসিতার পেছনে দৌড়ানোর মানসিকতা বিদায় নেবে। অল্পে তুষ্টির জন্য জীবনমানে নিম্নশ্রেণির লোকদের প্রতি দৃষ্টি ফেরাতে হয়। তাহলে নিজের মাঝে অল্পে তুষ্ট হওয়ার মানসিকতা চলে আসে।
৪. অফার, ডিসকাউন্ট, ক্যাশব্যাক ইত্যাদি লুফে নেওয়ার মানসিকতা বর্জন করা চাই। কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
লেখক : শিক্ষক, আনওয়ারুল উলুম হাজি সাইজউদ্দিন মাদ্রাসা, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা