আয়ের নিষিদ্ধ পন্থা ও ব্যয়ের নিষিদ্ধ খাত

মাহমুদ হাসান ফাহিম

প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামি অর্থব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট হলো, আয়-উপার্জন ও ব্যয়ের নিয়ন্ত্রণ। ইসলাম মানুষকে অবাধ ও যথেচ্ছভাবে সম্পদ অর্জনের সুযোগ যেমন দেয় না, তেমনই হালালভাবে উপার্জিত অর্থ-সম্পদও যথেচ্ছ ব্যয় করার অধিকার দেয় না। ফলে একদিকে যেমন আয়ের উৎস হয় বহুমাত্রিক, অপরদিকে ব্যয়ের ক্ষেত্রও থাকে অপচয় ও অপব্যয় মুক্ত।

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব : ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। হালাল উপার্জন বলতে বৈধ উপার্জনকে বোঝায়। সুন্দর ও সুস্থ জীবন এবং আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য চাই হালাল উপার্জন, হালাল জীবিকা। হালাল উপার্জনে রয়েছে মানুষের জন্য বিপুল কল্যাণ। হারাম বা অধৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদ অপবিত্র বিধায় তাতে রয়েছে মারাত্মক অকল্যাণ ও ক্ষতি।

পবিত্র কোরআনে হালালকে উত্তম ও পবিত্র বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। তা ভক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা উত্তম ও পবিত্র বস্তু খাও। যা আমি তোমাদের জীবিকাস্বরূপ দান করেছি।’ (সুরা বাকারা : ১৭২)। সুদি কারবারের প্রতিষ্ঠান, মদ উৎপাদনের কারখানা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ঈমান ও আমল নষ্ট করার উদ্দেশ্যে গঠিত প্রতিষ্ঠান, নৃত্যশালা, থিয়েটার, অশ্লীল ছায়াছবি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে মুসলমানদের জন্য চাকরি করা জায়েজ নেই। একজন মুসলমান কখনও হারাম গ্রহণ করতে পারে না। সে কারণেই ইসলাম মানুষকে অবাধ ও যথেচ্ছভাবে সম্পদও কামাইয়ের সুযোগ দেয়নি।

আয়ের নিষিদ্ধ পন্থা : মৌলিকভাবে ব্যক্তি ও সমাজ তথা মানুষের জন্য যা কিছু ক্ষতি ও অকল্যাণজনক, তার সবই হারাম, নিষিদ্ধ এবং অবৈধ। ইসলামের এ নীতি অর্থনৈতিকসহ মানব জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাই বেশ কিছু উপায়ে আয়-উপার্জন করা হারাম। যেমন- ১. সুদ ও ঘুষ আদান-প্রদানের মাধ্যমে উপার্জন। (সুরা বাকারা : ২৭৫)। ২. ধোঁকা ও প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জন। (বোখারি : ১৮৫, মিশকাত : ৩৫২০)। ৩. চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লুটপাট, ডাকাতি, চুরি, লুণ্ঠন, ছিনতাই ও অপহরণের মাধ্যমে উপার্জন। (সুরা বাকারা : ১৮৮, সুরা নিসা : ২৯)। ৪. দখল, জবর দখলি উপার্জন। (সুরা বাকারা : ২৮৩)। ৫. আমানতের খেয়ানত এবং আত্মসাৎ করার মাধ্যমে উপার্জন। (সুরা বাকারা : ২৮৩)। ৬. জুয়া, বাজি এবং এমন সব উপায় প্রক্রিয়া অবলম্বন করে উপার্জন করা, যার মাধ্যমে একজনের অর্থ-সম্পদ আরেকজনের কাছে চলে যায় এবং কোনো কারণ ছাড়াই অপর ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (সুরা মায়িদা : ৯০)। ৭. হারাম বস্তুর উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে উপার্জন। যেমন- ক. মদ ও মাদকদ্রব্য, খ. মৃত প্রাণী, গ. শুকর, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদির ব্যবসা। (সুরা মায়িদা : ৯০)। ৮. লটারি, ভাগ্য গণনা ও জ্যোতিষ কাজের মাধ্যমে উপার্জন।

(সুরা মায়িদা : ৯০)। ৯. মজুদদারি, অর্থাৎ দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুত রেখে উপার্জন। (সুরা নিসা : ২৯)। ১০. রাষ্ট্র ও ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে অর্থ উপার্জন।

(সুরা বাকারা : ১৮৮)। ১১. দেহব্যবসা ও বেশ্যাবৃত্তির মাধ্যমে উপার্জন। (সুরা নুর : ৩৩)। ১২. মাপে কমবেশি করার মাধমে উপার্জন। (সুরা হুদ : ৮৫)। ১৩. চোরাই মাল ক্রয়-বিক্রয় করে উপার্জন। (সুরা মায়িদা : ২)। ১৪. আসলের সঙ্গে নকল ও ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করার মাধ্যমে উপার্জন। (বোখারি : ১৮৫)। ১৫. আসল স্যাম্পল দেখিয়ে নকল সরবরাহ করার মাধ্যমে উপার্জন। (বোখারি : ১৮৫, মিশকাত : ৩৫২০)। ১৬. এতিমের অর্থ-সম্পদ ভোগ-দখল করা। (সুরা নিসা : ১০)। ১৭. অন্যায্য বণ্টন, অর্থাৎ নিজের ভাগে বেশি নেয়া, বেছে বেছে ভালোটা নেয়া কিংবা নিজে সুবিধাজনক অংশ নিয়ে অন্যকে ঠকিয়ে জুলুম করে উপার্জন। (সুরা মুতাফফিফিন : ২)। ১৮. ধার, করজ, ঋণ বা লোন নিয়ে পরিশোধ না করা। (বোখারি : ২১৪২, তিরমিজি : ১৩০৯)। ১৯. সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে কিংবা দাপট দেখিয়ে উপার্জন। (সুরা মায়িদা : ৩৩)। ২০. মূর্তি, প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য নির্মাণ, উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয়ের মাধমে উপার্জন। (বোখারি : ১৯৭৫)। ২১. যাদুমন্ত্র বা যাদু টোনার মাধ্যমে উপার্জন। (সুরা বাকারা : ১০২, মিশকাত : ৩৯৩)। এ ছাড়া ব্যক্তি, মানবতা ও ঈমান আকিদার জন্য ক্ষতি বয়ে আনা সব আয়ই নিষিদ্ধ। (ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা : ২৩-২৪)।

ব্যয়ের নিষিদ্ধ খাত : ইসলাম শুধু হালাল উপার্জনের কথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং হালাল পন্থায় ব্যয় করার প্রতিও উৎসাহিত করেছে। আবার হালালভাবে উপার্জিত সম্পদ যখন যেখানে ইচ্ছে ব্যয় করা যাবে না। ইসলাম সম্পদ ব্যয়ে উৎসাহিত করলেও অপচয় ও অপব্যবহারের কোনো সুযোগ দেয়নি। কেন না, সম্পদ মানুষের কাছে রবের দেয়া পবিত্র আমানত। ব্যক্তিগত ভোগবিলাস সম্পদ আহরণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নয়; বরং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও মঙ্গল এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর সন্তুষ্টি লাভই হবে সম্পদ উপার্জনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মানুষ যেসব অর্থ উপার্জন করে, তা সাধারণত বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়ে থাকে। ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থ ব্যয় একদিকে যেমন বিরাট নেকি ও পুণ্যের কাজ, অপরদিকে তা বিরাট পাপ ও অকল্যাণের হাতিয়ার। ইসলাম সব ধরনের কল্যাণের ব্যয়ে উৎসাহিত করেছে এবং অকল্যাণকর কাজে ব্যয় করাকে নিষিদ্ধ ও অবৈধ ঘোষণা করেছে।

নিষিদ্ধ খাতগুলো : ১. শরিয়তের বিরোধী যে কোনো কাজে সম্পদ ব্যয় করা। (সুরা মায়িদা : ২)। ২. গোনাহের কাজে ব্যয় ও সাহায্য করা। (সুরা মায়িদা : ২)। ৩. ক্ষতিকর জ্ঞানার্জন ও প্রশিক্ষণে ব্যয় করা। ৪. বিয়েশাদিতে অপব্যয় করা। (সুরা আরাফ : ৩১)। ৫. যশ-খ্যাতির জন্য টাকা উড়ানো। (সুরা আরাফ : ৩১)। ৬. বিলাসিতার জন্য দামি ও অতিরিক্ত আসবাব ক্রয় করা। (সুরা আরাফ : ৩১)। ৭. বিলাসিতার জন্য অহেতুক গাড়ি-বাড়ি করা। (সুরা আরাফ : ৩১)। ৮. অপচয় ও অপব্যয় করে নিষ্প্রয়োজনীয় কাজে সম্পদ উড়ানো। (সুরা ফোরকান : ৬৭, মুসনাদে আহমদ :৭০৬৫)। ৯. কারোর ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করা। (সুরা কাসাস : ৭৭)। ১১. ব্যভিচার ও অশ্লীলতা প্রসারের কাজে ব্যয় করা। (সুরা বাকারা : ৩৩)। ১২. ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কাজে ব্যয় করা। (সুরা মায়িদা : ২)। ১৩. ভালো কাজে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যয় করা। (সুরা মায়িদা : ২)। ১৪. বাচ্চাদের খেলনা সরঞ্জামাদি ক্রয়ে বাড়াবাড়ি করা। (সুরা আরাফ : ৩১)। এককথায়, যে কোনো ক্ষতিকর, অকল্যাণজনক এবং সামাজিক ও সামষ্টিক অনিষ্টকর কাজে ব্যয় করা নিষিদ্ধ। (ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা : ২৩-২৪)।

সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে : প্রত্যেক মুসলমানকে এ দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে, কেয়ামতের দিন আমরা উপর্জিত ও ব্যয়িত সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হব। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কয়েকটি প্রশ্নের জবাব দেয়া ছাড়া কোনো বান্দা (কেয়ামতের দিন) দু’পা অগ্রসর করতে পারবে না। তার জীবনকাল সম্পর্কে, সে তা কীভাবে কাটিয়েছে; তার অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী কী আমল করেছে; তার সম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছে এবং কোথায় খরচ করেছে; তার শরীর কীভাবে বিনাশ করেছে।’ (তিরমিজি : ২৪১৭)। অর্থ-সম্পদ মানুষের কাছে আল্লাহর দেয়া পবিত্র আমানত। উপার্জিত সম্পদ বৃদ্ধিকরণে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা আর্থিক লেনদেনকে তিনি বৈধ করেছেন।

যেন হাতে থাকা সম্পদ ব্যয় করতে করতে একেবারে নিঃশেষ না হয়ে যায়। মানুষের সম্পদে ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে আয়ের দিকগুলো কাজে লাগিয়ে তারা যেন সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারে, এ লক্ষ্যে ইসলাম মানুষকে সততার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে উৎসাহিত করে। পাশাপাশি অসাধুতার বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণীও উচ্চারিত হয়েছে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে। (সুরা বাকারা : ২৮৪)। চোরাকারবারি, মজুদদারি, পণ্যে ভেজাল মেশানো, ওজনে কারচুপি করা, ধোঁকাণ্ডপ্রতারণা ও ঠকবাজি করা, দামে হেরফের করা ইত্যাদি অসাধুতার পথ ইসলামে নিষিদ্ধ। তাই মুসলমান হিসেবে আমাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান মেনে চলা অনিবার্য কর্তব্য। অনুরূপ মিতব্যয়িতার সঙ্গে অর্থ-সম্পদ খরচ করা চাই। বস্তুত প্রকৃত সফলতা ও স্বার্থকতা তখনই অর্জন করা যাবে, যখন পূর্ণ চেষ্টা ও সামর্থ্য ব্যয় করে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুশীল করতে পারব।