যে পশুটি কোরবানি করা হবে, তার ওপর কোরবানিদাতার পূর্ণ মালিকানা থাকতে হবে। বন্ধকি পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না। গৃহপালিত সব ধরনের পশু তথা- ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ এবং উট দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু (যেমন- হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি) দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নয়। তেমনিভাবে হাঁস-মুরগি বা কোনো পাখি দ্বারাও কোরবানি জায়েজ নয়। (ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৫)।
কোরবানির পশুর বয়স : গরু ও মহিষ ২ বছর এবং উট ৫ বছর পূর্ণ হলে তা দিয়ে কোরবানি করা জায়েজ। ছাগল, দুম্বা ও ভেড়া ১ বছর পূর্ণ হতে হবে। দুম্বা ও ভেড়া যদি ১ বছর পূর্ণ না হয়, বরং বছরের বেশি অংশ অতিবাহিত হয় এবং দেখতে স্বাস্থ্যগতভাবে ১ বছরের বাচ্চার মতো মনে হয়, তাহলে সেরূপ দুম্বা ও ভেড়া দিয়েও কোরবানি করা জায়েজ।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) কোরবানি এবং হজ-উমরার পশুর ক্ষেত্রে উটের মধ্যে ৫ বছর বয়স অতিক্রমকারী, গরু-মহিষের ক্ষেত্রে ২ বছর অতিক্রমকারী এবং বকরি ও ভেড়ার ক্ষেত্রে ১ বছর অতিক্রমকারী পশুর কথা বলতেন। (মুয়াত্তায়ে মালেক : ৭৫৪)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা মুসিন্নাহ ছাড়া জবাই কোরো না। (মুসিন্নাহ হলো- ৫ বছর বয়সি উট, ২ বছরের গরু ও ছাগলের ক্ষেত্রে ১ বছর)। যদি সম্ভব না হয়, তাহলে ৬ মাস বয়সি ভেড়া বা দুম্বা।’ (মুসলিম : ১৯৬৩)।
কোন পশু ক’জন মিলে কোরবানি দেবে : ছাগল, ভেড়া, দুম্বা শুধু একজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যাবে। এমন একটি পশু দুই বা ততোধিক ব্যক্তি মিলে কোরবানি করলে কারও কোরবানিই সহিহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাতজন শরিক হতে পারবে। সাতের অধিক শরিক হলে কারও কোরবানিই সহিহ হবে না। (ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৪৯, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৭-২০৮)। জাবের (রা.)-সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘আমরা হজের ইহরাম বেঁধে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে বেরুলাম। তখন রাসুল (সা.) আমাদের একটি গরু এবং একটি উটে সাতজন করে শরিক হওয়ার নির্দেশ দিলেন।’ (মুসলিম : ১৩১৮/৩৫১, মুয়াত্তায়ে মালেক : ১/৩১৯)।
শরিকানায় অংশ ও শরিকদের যেমন হতে হবে : সাতজনে মিলে কোরবানি করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারও অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। (যেমন- কারও আধাভাগ, কারও দেড়ভাগ)। এমন হলে কোনো শরিকের কোরবানি সহিহ হবে না। তেমনিভাবে কোরবানি করতে হবে সম্পূর্ণ হালাল সম্পদ থেকে। হারাম টাকা দ্বারা কোরবানি করা সহিহ নয় এবং এ ক্ষেত্রে অন্য শরিকদের কোরবানিও আদায় হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৭)।
শরিক নির্বাচনে সর্তকতা : সব অংশিদারের নিয়ত কোরবানির জন্য হতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না; কিন্তু পৌঁছে তোমাদের অন্তরের তাকওয়া।’ (সুরা হজ : ৩৭)। তাই যদি কেউ আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনের উদ্দেশে কোরবানি না করে নিছক গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করে, তাহলে তার কোরবানি সহিহ হবে না। তাকে অংশিদার বানালে শরিকদের কারও কোরবানিই আদায় হবে না। সুতরাং খুব সতর্কতার সঙ্গে শরিক নির্বাচন করা চাই। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৮, ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৪৯)।
একা কোরবানির নিয়তে পশু কিনে শরিক করা : যদি কেউ গরু, মহিষ বা উট একা কোরবানি দেওয়ার নিয়তে ক্রয় করে আর সে ধনী হয়, তাহলে তার জন্য এ পশুতে অন্যকে শরিক করা জায়েজ। তবে এতে কাউকে শরিক না করে তার একা কোরবানি করাই শ্রেয়। শরিক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম। আর যদি ওই ব্যক্তি এমন গরিব হয়, যার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়, তাহলে যেহেতু কোরবানির নিয়তে পশুটি ক্রয় করার মাধ্যমে লোকটি তার পুরোটাই আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে, তাই তার জন্য এ পশুতে অন্যকে শরিক করা জায়েজ নয়। যদি শরিক করে, তাহলে ওই টাকা সদকা করে দেওয়া জরুরি। আর কোরবানির পশুতে কাউকে শরিক করতে চাইলে পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করে নিতে হবে। (ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৫০-৩৫১, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২১০)।
জবাইয়ের আগে শরিকের মৃত্যু হলে : জবাইয়ের আগে কোনো শরিকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি করার অনুমতি দেয়, তাহলে তা জায়েজ হবে। নইলে ওই শরিকের টাকা ফেরত দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে তার স্থলে অন্যকে শরিক করা যাবে। (আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩২৬, ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৫১)।
কোরবানির পশুতে আকিকা ও হজের কোরবানি : কোরবানির পশুতে আকিকা ও হজের কোরবানির নিয়ত করা যাবে। এতে প্রত্যেকের নিয়তকৃত ইবাদত আদায় হয়ে যাবে। এমন পশু হেরেম এলাকায় জবাই করতে হবে। অন্যথায় হজের কোরবানি আদায় হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৯, আল ইনায়া : ৮/৪৩৫-৩৪৬)।
কোরবানির পশুর নর-মাদা হওয়া : যেসব পশু কোরবানি করা জায়েজ, সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কোরবানি করা যায়। (ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২০৫)।
কোরবানির পশুর গঠন যেমন হতে হবে : কোরবানির পশু মোটা-তাজা ও নিখুঁত হওয়া উত্তম। (মুসনাদে আহমদ : ৬/১৩৬, ফতোয়ায়ে আলমগিরি : ৫/৩০০)। আবুল আশাদ্দ সুলামি তার পিতার সূত্রে, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাত ব্যক্তির সপ্তমজন ছিলাম। এমতাবস্থায় রাসুল (সা.) আমাদের প্রত্যেককে এক দিরহাম করে জমা করার জন্য বললেন। আমরা জমাকৃত সাত দিরহাম দিয়ে একটি কোরবানির পশু ক্রয় করে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমরা এটি বহু দামে কিনেছি।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘উত্তম কোরবানি তা, যা অধিক মূল্যবান ও মোটা-তাজা হয়ে থাকে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৫৫৩৩)।
খাসিকৃত পশু দিয়ে কোরবানি : খাসিকৃত পশু দিয়ে কোরবানি করা উত্তম। রাসুল (সা.) যখন কোরবানি করার ইচ্ছে করতেন, তখন দুটি বড় মোটা-তাজা শিং ও সুন্দর রং বিশিষ্ট মেষ কিনতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩১১৩)। আবু রাফে (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) দুটি মোটা-তাজা খাসিকৃত ভেড়ার কোরবানি করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৬৬৪৯)।
গর্ভবতী পশুর কোরবানি : গর্ভবতী পশু কোরবানি করা জায়েজ। তবে প্রসবের সময় আসন্ন হলে সে পশু কোরবানি করা মাকরুহ। জবাইয়ের পর যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায়, তাহলে সেটাও জবাই করতে হবে এবং কেউ চাইলে এর গোশতও খেতে পারবে। (ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৫০)।
জবাইয়ের আগে বাচ্চা প্রসব করলে : কোরবানির পশু ক্রয় করার পর জবাইয়ের আগে বাচ্চা প্রসব করলে ওই বাচ্চার গোশত খাওয়া যাবে না। পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। তবে ওই বাচ্চা জবাই না করে জীবিত সদকা করে দেওয়া উত্তম। (ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৪৯, ফতোয়ায়ে আলমগিরি : ৫/৩০১)।
বন্ধ্যা ও পাগল পশু দিয়ে কোরবানি : বন্ধ্যা পশুর কোরবানি জায়েজ। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৫)। হাসান (রা.) বলেন, ‘পাগল পশুর কোরবানি জায়েজ। তবে যদি এমন পাগল হয়, যে ঘাস পানি দিলে খায় না এবং মাঠেও চরে না, তাহলে তার কোরবানি জায়েজ হবে না। (আন নিহায়া ফি গরিবিল হাদিস : ১/২৩০, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২১৬)।
জিহ্বাহীন পশুর কোরবানি : জিহ্বা নেই, এমন গরু দ্বারা কোরবানি করলে সহিহ হবে না। তবে জিহ্বাহীন ছাগল দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। তবে না করা ভালো। (শামি : ৫/২২৯; আলমগিরি : ৫/২৯৮)।
জন্মগত শিং নেই বা ভাঙা এমন পশু : যে পশুর জন্মগত শিং নেই বা মাঝখানে ভেঙে গেছে, তা দিয়েও কোরবানি জায়েজ। আলী (রা.)-সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘একটি গাভি সাতজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা যায়।’ (বর্ণনাকারী বলেন) বললাম, ‘যদি গাভি বাচ্চা দেয়, তাহলে কী করবো?’ বললেন, ‘বাচ্চাকেও গাভির সঙ্গে জবাই করে দাও।’ বললাম, ‘খোঁড়া পশু!’ বললেন, ‘যদি কোরবানির স্থানে হেঁটে যেতে পারে, তাহলে কোরবানি করবে।’ বললাম, ‘শিংভাঙা পশু!’ বললেন, ‘এমন পশু দিয়ে কোরবানি করতে কোনো সমস্যা নেই। তবে আমাদের রাসুল (সা.) কোরবানির পশুর চোখণ্ডকান ভালোভাবে দেখে নেবার আদেশ করেছেন।’ (তিরমিজি : ১৪২৩)।
নাপাক খেয়ে জীবিকা নির্বাহকারী পশুর কোরবানি : যে পশু শুধু নাপাক খেয়েই জীবিকা নির্বাহ করে, তা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নেই। তবে সে পশুটি উট হলে ৪০ দিন, গরু-মহিষ হলে ২০ দিন, ছাগল-ভেড়া-দুম্বা হলে ১০ দিন বেঁধে রাখার পর কোরবানি করলে বৈধ হবে। আর যে পশু মাঝেমধ্যে নাপাক খায়, তা দ্বারা কোরবানি করতে কোনো নিষেধ নেই। (ফতোয়ায়ে শামি : ৫/২২৯, ফতোয়ায়ে আলমগিরি : ৫/২৯৮)।
পশু ক্রয় বা নির্দিষ্ট করার পর কোনোরূপ উপকৃত হওয়া : কোরবানির পশু ক্রয় বা নির্দিষ্ট করার পর তা দ্বারা কোনোরূপ উপকৃত হওয়া মাকরুহ। (যেমন- হালচাষ করা, তার পিঠে আরোহণ করা, বোঝা বহন করানো, পশম কাটা, ইত্যাদি)। যদি কেউ উপকৃত হয়, তাহলে পশম বা হালচাষের মূল্য, ইত্যাদি সদকা করে দেবে। (মুসনাদে আহমদ : ২/১৪৬, ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৫৪)।
কোরবানির পশুর দুধ পান : কোরবানির পশুর দুধ পান করা যাবে না। যদি জবাইয়ের সময় আসন্ন হয় আর দুধ দোহন না করলে পশুর কষ্ট হবে না বলে মনে হয়, তাহলে দোহন করবে না। প্রয়োজনে ওলানে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দেবে। এতে দুধের চাপ কমে যাবে। যদি দুধ দোহন করে ফেলে, তাহলে তা সদকা করে দিতে হবে। নিজে পান করে থাকলে মূল্য সদকা করে দেবে। (মুসনাদে আহমদ : ২/১৪৬, রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৯)।