ঈদুল আজহায় করণীয় বর্জনীয়

ঈদুল আজহা বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনে ঈদের নামাজ ও কোরবানি একসঙ্গে আদায় করা হয়; যা ঈদুল ফিতরের নামাজ ও সদকাতুল ফিতরের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। আল্লাহতায়ালা তাঁর রাসুল (সা.)-কে কাওসার দান করেছেন। এর কৃতজ্ঞতা আদায়ে এ দিনে কোরবানি ও নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। ঈদুল আজহার দিনে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করা ফজিলতপূর্ণ কাজ। সামর্থ্য থাকাসত্ত্বেও যে ব্যক্তি এ ইবাদত পালন করে না, তার ব্যাপারে কঠোর ধমকি এসেছে। এছাড়া এ দিনের বেশ কিছু করণীয়-বর্জনীয় রয়েছে; সে বিষয়ে লিখেছেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সহ-সম্পাদক - মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সকাল সকাল গোসল : ঈদের দিন সকাল সকাল গোসল করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা চাই। কারণ, ঈদের দিন গোসল করে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম গোসল করে ঈদগাহে যেতেন। নাফে (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার আগে গোসল করে নিতেন। (মুয়াত্তায়ে মালেক : ৪৮৮)।

উত্তম পোশাক ও সাজসজ্জা : সামর্থ্যানুযায়ী ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করা এবং বৈধ সাজগোছ গ্রহণ করা মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম এমনটি করতেন। নাফে (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) দুই ঈদে উত্তম পোশাক পরতেন। (সুনানে কোবরা লিল বাইহাকি : ৬১৪৩)। তবে উত্তম পোশাক মানে নতুন পোশাক নয়; বরং নিজের সংগ্রহে থাকা সবচেয়ে ভালো পোশাক পরা চাই। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দিন উত্তমভাবে গোসল করতেন, সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করতেন, নিজের সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। এরপর ঈদের নামাজে যেতেন। (শরহুস সুন্নাহ : ৪/৩০২)।

নামাজের আগে না খাওয়া : কোরবানির ঈদে নামাজের আগে কোনো কিছু না খাওয়া মুস্তাহাব। নামাজের পরে প্রথমে কোরবানিকৃত জন্তুর গোশত থেকে খাওয়া সুন্নত। হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন কোনো কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না।আর ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজ না পড়ে কিছু খেতেন না।’ (তিরমিজি : ৫৪২)। বুরাইদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে, নবীজি (সা.) ঈদুল ফিতরের নামাজের উদ্দেশ্যে না খেয়ে বেরোতেন না। আর ঈদুল আজহার নামাজের থেকে ফিরে আসার আগপর্যন্ত কিছু খেতেন না। এরপর প্রথমে কোরবানির গোশত খেতেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ২২৯৮)। এই সুন্নত শুধু ১০ জিলহজের জন্য। ১১ বা ১২ তারিখে জবাইকৃত কোরবানির গোশত দিয়ে খাবার শুরু করা সুন্নত নয়। (তিরমিজি : ১/১২০, শরহুল মুনয়া : ৫৬৬, আদ্দুররুল মুখতার : ২/১৭৬, আল বাহরুর রায়েক : ২/১৬৩)।

সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া : ঈদুল আজহার নামাজ ঈদুল ফিতরের নামাজের তুলনায় আগে আগে পড়তে হবে। ইয়াজিদ ইবনে খুমাইর (রহ.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.)-এর সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে বুসর (রা.) ঈদুল ফিতর অথবা ঈদুল আজহার দিন লোকদের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য ঈদগাহে গেলেন।

ইমামের আসতে বিলম্ব হলে তিনি এর প্রতিবাদ করলেন। বললেন, ‘এ সময় তো আমরা (রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে) নামাজ পড়ে অবসর হয়ে যেতাম।’ (বর্ণনাকারী বলেন), ‘সেটা নফলের (অর্থাৎ চাশতের) সময় ছিল।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১১৩৫, সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৩১৭)।

বেশি বেশি তাকবির পাঠ : ঈদগাহে যাওয়ার সময় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তাকবির বলতে থাকা চাই।তাকবিরটি হলো, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। নাফে (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের সকালে সশব্দে তাকবির বলতে বলতে ঈদগাহে যেতেন এবং ইমাম আসা পর্যন্ত তাকবির বলতে থাকতেন। (সুনানে দারাকুতনি : ১৭১৬)।

ঈদগাহে ভিন্ন পথে যাতায়াত : সম্ভব হলে ঈদগাহে যাওয়ার সময় এক পথে যাওয়া আর ফেরার সময় ভিন্ন পথে আসা। নবীজি (সা.) এমনটি করতেন। জাবের (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) ঈদের দিন এক পথ দিয়ে ঈদগাহে যেতেন আর ভিন্ন পথ দিয়ে বাড়ি ফিরতেন। (বোখারি : ৯৮৬)।

পায়ে হেঁটে ঈদগাহে গমন : যথাসম্ভব পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যেতেন এবং পায়ে হেঁটে ফিরতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১২৯৫)।

ঈদের নামাজ আদায় : ঈদের দিন সকালে পুরুষদের জন্য ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। বিশেষ পদ্ধতিতে অতিরিক্ত তাকবিরসহ জামাতে দু’রাকাত নামাজ আদায় করা এবং তারপর ঈদের খুতবা দেয়া ও শোনা চাই। ঈদের নামাজ খোলা ময়দানে আদায় করা উত্তম। কারণ, ঈদের জামাত রাসুল (সা.) সর্বদাই মাঠে গিয়ে আদায় করেছেন। বৃষ্টির কারণে একবার শুধু মসজিদে আদায় করেছেন। যা প্রমাণ করে, ঈদের জামাতের সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি হলো মাঠে আদায় করা। বাকি যদি কেউ মসজিদে আদায় করে, তাহলেও তার নামাজ হয়ে যাবে। তবে ইচ্ছাকৃত সুন্নতকে ছেড়ে দেয়া উচিত হবে না। তাই সামর্থ্য থাকাবস্থায় ঈদের জন্য মাঠ রাখাই শরিয়তের নির্দেশ। (ফতোয়ায়ে শামি : ৩/৪৯)।

একে অপরের জন্য দোয়া : ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরাম দোয়াসুলভ বাক্যে সৌজন্য বিনিময় করতেন। তাবেয়ি জুবাইর ইবনে নুফাইর (রহ.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর সাহাবিরা ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাতে বলতেন, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাদের এবং তোমাদের আমলগুলো কবুল কর। (ফাতহুল বারি : ২/৪৪৬)। এ রকম সৌজন্য বিনিময়ের মাধ্যমে উত্তম আচরণ প্রকাশিত হয় এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সুদৃঢ় হয়।

ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় : ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা।’ অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। ঈদ মোবারক ইনশাল্লাহও বলা যেতে পারে। ঈদুকুম সাঈদ বলেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।

এতিম ও অভাবীকে পানাহার : ঈদের দিন এতিমের খোঁজখবর নেওয়া, তাদের খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়া চাই। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, এতিম ও বন্দিকে খাদ্য দান করে।’ (সুরা দাহর : ৮)।

আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ নেওয়া : ঈদের দিন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া ও তাদের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া চাই। পাশাপাশি প্রতিবেশীরও খোঁজখবর নিতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতাপিতার সঙ্গে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে, এতিমণ্ডমিসকিন, প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পাশর্^বর্তী পড়শী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাসদাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের, যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’ (সুরা নিসা : ৩৬)।

মনোমালিন্য দূরীকরণ : জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারও কারও সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মনোমালিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমানের জন্য বৈধ নয় যে, তার ভাইকে তিনদিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে, দেখা-সাক্ষাৎ হলে একজন অন্যজনকে এড়িয়ে চলে। এ দু’জনের মাঝে ওই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, যে আগে সালাম দেয়।’ (মুসলিম : ৬৬৯৭)।

আনন্দ প্রকাশ করা : ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যেখানে সুষ্ঠু বিনোদনের সুযোগ রয়েছে। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ঈদের দিন আমার ঘরে এলেন, তখন আমার কাছে দু’জন কিশোরী বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে গান গাচ্ছিল। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। এরই মধ্যে আবু বকর (রা.) ঘরে প্রবেশ করে এ বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজি (সা.)-এর ঘরে শয়তানের বাঁশি? রাসুল (সা.) তার কথা শুনে বললেন, ‘ওদের গাইতে দাও হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন।’ (বোখারি : ৯৫২)।

রোজা না রাখা : রমজানের পুরো মাস রোজা রাখার পর ঈদ মোমিন বান্দার জন্য আনন্দের দিন। তাই আল্লাহতায়ালা ঈদের দিন রোজা রাখা হারাম করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) দু’দিন রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। তা হলো- ঈদুল ফিতরের দিন এবং কোরবানির ঈদের দিন। (মুসলিম : ১১৩৮)।

বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন না করা : ঈদকে কেন্দ্র করে বিজাতীয় আচরণ মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে মুসলমানদের অনেকেই। আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সঙ্গে সাদৃশ্য রাখবে, সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪০৩৩)।

খোলামেলা পোশাক না পরা : ঈদের দিন নারীরা ব্যাপকভাবে বেপর্দা অবস্থায় রাস্তাঘাটে খোলামেলা ঘোরাফেরা করে। এ থেকে বিরত থাকতে হবে। নিজের অধীন মেয়েদেরও বিরত রাখতে হবে। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন মূর্খতার যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না।’ (সুরা আহজাব : ৩৩)।

অপচয়-অপব্যয় না করা : ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে এ উপলক্ষ্যে সবকিছুতেই অপচয়-অপব্যয় করা হয়। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা কোনোভাবেই অপব্যয় করো না, নিশ্চয় অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘তোমরা পানাহার কর, কিন্তু অপচয় করো না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)।

মদ ও আতশবাজি না করা : ঈদের আনন্দে মদ খাওয়া, জুয়া খেলা, আতশবাজি করা শরিয়তবিরোধী কাজ। শুধু ঈদ নয়, অন্য কোনো দিনও এসব করা যাবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! নিশ্চয় মদণ্ডজুয়া, প্রতিমা-বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তিরগুলো তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর; যাতে সফলকাম হও।’ (সুরা মায়িদা : ৯০)।