ইসলাম ও ভোক্তা অধিকার

মুফতি লুকমান হাসান

প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ভোক্তা কে? : ভোক্তা বলা হয়, যিনি তার নিজের পছন্দ বা প্রয়োজনে পণ্যসামগ্রী বা সেবা ক্রয় করেন এবং তা নিঃশেষ করেন। সুতরাং ভোক্তা মূলত তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য পণ্য বা পরিসেবা ক্রয় করেন; উৎপাদন বা পুনরায় বিক্রয়ের জন্য নয়। ভোক্তা হলো, বিক্রয়চক্রের বা চেইনের শেষ ব্যবহারকারী। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে যে কোনো পর্যায়ের ক্রেতা বা সেবাগ্রহীতাকে ভোক্তা বলা হয়। তিনি সর্বশেষ ব্যবহারকারী হওয়া বা না হওয়া এখানে বিবেচ্য নয়।

একটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ভোক্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ, ভোক্তার চাহিদা ছাড়া উৎপাদকদের উৎপাদনের প্রয়োজন বা প্রেরণা থাকে না। ফলে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা এবং সম্পদ বণ্টনে অসমতা সৃষ্টি হবে।

ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারীর মর্যাদা : সব শ্রেণির মানুষ কোনো না কোনো পর্যায়ে ভোক্তা। কিন্তু সবাই উদ্যোক্তা বা উৎপাদনকারী নয়। তবে ভোক্তার প্রাপ্য মূলত মুষ্টিমেয় উদ্যোক্তা ও বিক্রেতার হাত হয়ে মানুষের মাঝে বিতরণ হয়। মানুষের কাছে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছানোর মাধ্যম তারা। তাই এ সেবা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও মর্যাদাপূর্ণ। ব্যবসায়ীর ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদী, সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী কেয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহিদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি : ১২০৯)।

উৎপাদন করার জন্য স্বয়ং আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তিনি তোমাদের ভূমি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে বসবাস উপযুক্ততা তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সুরা হুদ : ৬১)। এই বসবাস উপযুক্ততার অর্থ হলো, উৎপাদন ও মানুষের প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরি করা। তা ছাড়া অনেক আয়াত ও হাদিসে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও এর জন্য শ্রম দেওয়াকে প্রশংসা করা হয়েছে।

ভোক্তার অধিকার : এর পাশাপাশি আইন ও নিয়মকানুন দ্বারা তাদের আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। কারণ, এ শ্রেণির কোনো অনিয়ম বা অনৈতিকতার ফলে ভোক্তা শ্রেণি তথা মানবসমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভোক্তা তার ন্যায্যটা পাওয়ার অধিকার রাখে। তাদের এ অধিকারকে বলা হয় ‘ভোক্তাদের অধিকার’।

কনজিউমার রাইটস বা ভোক্তা অধিকার একটি মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার। তাদের এ অধিকার সম্পর্কে সর্বপ্রথম সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্ত আইন দিয়েছে ইসলাম। যা ফিকহের গ্রন্থাবলিতে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। ইসলামে অধিকার বাস্তবায়নের স্বতন্ত্র নীতি রয়েছে। যে নীতিতে ইসলাম অনন্য ও অতুলনীয়। এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করে দেশীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন নিয়ে পর্যালোচনা করা হলো। একই সঙ্গে এ ক্ষেত্রে ইসলামের অনন্যতার কিছু দিক তুলে ধরা হলো-

ইসলামে অধিকারনীতি : ইসলাম সবসময় ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে। নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এর যে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র কৌশল রয়েছে, তার কয়েকটি দিক হলো- এক. ইসলাম অধিকার প্রতিষ্ঠার আগে মানবতার চেতনাকে জাগ্রত করে। হাদিসে এসেছে, ‘সব মোমিন এক দেহের মতো। যার কোনো অঙ্গ ব্যথিত হলে পুরো দেহ তার জন্য রাত জাগে এবং জ্বরাক্রান্ত হয়।’ (আল মুজামুল কাবির, তাবারানি : ৫২)।

দুই. প্রতিটি বিবেককে একজন শাসকের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। অর্থাৎ তাকওয়ার শিক্ষা ও আল্লাহভীতি অন্তরে জাগ্রত করে। কারণ মানুষ সব ধরনের আইন ফাঁকি দিতে পারে; কিন্তু নিজের বিবেককে ফাঁকি দিতে পারে না। সেখানে আল্লাহর উপস্থিতি-চেতনা তাকে নীতিবান ও আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকতে বাধ্য করে। এর চমৎকার উদাহরণ হলো, ওমর (রা.)-এর যুগে একজন নারীর প্রসিদ্ধ ঘটনা। তিনি শেষ রাতে দুধ দোহনের পর বাজারে নেওয়ার আগে মেয়েকে তাতে পানি মেশাতে বললেন। মেয়ে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কথা বলল। মা বললেন, ‘এ সময় তো প্রশাসন এখানে নেই।’ মেয়ে প্রতিত্তোরে বলল, ‘আল্লাহ তো এখানে আছেন। তিনি দেখছেন।’ ভেজালমুক্ত খাদ্য পরিবেশনের এটি অনন্য নজির।

তিন. অন্যের অধিকার যথাযথভাবে প্রদানের দায়বদ্ধতা। নিজের অধিকার ছাড় দিয়ে হলেও অন্যের অধিকার যথাযথ দেওয়ার যে শিক্ষা ইসলাম প্রদান করে, তার নজির কোথাও নেই। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেক হকদারকে তার প্রাপ্য পরিপূর্ণভাবে প্রদান করো।’ (বোখারি : ১৯৬৮)। যার ফলে মুসলিম সমাজে নিজের চেয়ে অন্যের অধিকারের ব্যাপারে সবাই সচেতন থাকে এবং সবার ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।

ভোক্তা অধিকার বাস্তবায়নে বর্তমান সমাজ : অপরদিকে আধুনিক সভ্য পৃথিবীতে সবাই নিজের অধিকার আগে চায়। নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন করা হয়। অন্যের অধিকারের প্রতি গুরুত্বটা সেভাবে দেওয়া হয় না। ফলশ্রুতিতে স্বার্থপর ও অসহিষ্ণু এক জাতির বিশ্রী চেহারা সমাজে দেখতে হচ্ছে। একই চিত্র ভোক্তা অধিকার নিয়েও। পদে পদে ভোক্তাদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। সঠিকভাবে মূল্য পরিশোধ করার পরও তাকে সঠিক পণ্য, সঠিক সেবা দেওয়া হয় না।

ভোক্তা অধিকার দিবস : আধুনিক সভ্য পৃথিবী ভোক্তার অধিকার সম্পর্কে অবগত হয়েছে অনেক পরে; মাত্র কয়েক বছর আগে। অথচ ইসলাম প্রায় সাড়ে ১৪০০ বছর আগে মানুষের মৌলিক এ অধিকার নিয়ে সবিস্তারে নির্দেশনা ও আইন দিয়েছে। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ ওই সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি ভোক্তাদের ৪টি অধিকারের কথা বলেন। নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার; যা পরবর্তী সময়ে ভোক্তা অধিকার আইন নামে পরিচিতি পায়। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে জাতিসংঘ ভোক্তা অধিকার রক্ষার নীতিমালায় কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে আরও বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরও আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই কনজুমার্স ইন্টারন্যাশনাল এসব অধিকারকে সনদে অন্তর্ভুক্ত করে। কেনেডির ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৫ মার্চকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে পালন করা হয়। (উইকিপিডিয়া)।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ : ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে- ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ, বাস্তবায়ন, উন্নয়ন, ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ ও শাস্তির বিধান করা।

কী আছে এ আইনে? : উক্ত আইনে মোট ৮২টি ধারা ও কয়েকটি উপধারা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ধারার মধ্যে আছে, কোনো পণ্যে মোড়ক না থাকলে কিংবা পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য না থাকলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৩৭ ধারায় বিক্রেতাকে অনধিক ১ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারে আদালত।

তা ছাড়া কোনো বিক্রেতা যদি ভেজাল পণ্য বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৪১ ধারায় বিক্রেতাকে ৩ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে। যদি কোনো বিক্রেতা পণ্যের উৎপাদনের সময় নিষিদ্ধ উপকরণ মিশ্রণ করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তাহলেও সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারে আদালত।

(লিগ্যাল হোম : ২১ ডিসেম্বর ২০২১)।

বিশ্লেষণ : প্রচলিত আইনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করার কথা বলা হলেও এতে এমন কিছু নীতি ও বিধান রয়েছে, যা স্পষ্টতই ভোক্তাকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা হলো-

ক্রেতা সাবধান নীতি : নীতির মূল কথা হলো, ক্রেতার কোনো কিছু ক্রয় করার আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে তথা পণ্যের গুণগত মান যাচাই করে ক্রয় করা উচিত। যদি ক্রয় করার সময় যাচাই করা না হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে কোনো অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং বিক্রেতা কোনো তথ্য সম্পর্কে নীরব থাকলে সে ক্ষেত্রে ক্রেতার কর্তব্য হলো, বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা।

এটি এমন এক নীতি, যা বিক্রেতা ও ব্যবসায়ী শ্রেণিকে অনৈতিকতা ও দুর্নীতি করার শুধু সুযোগই করে দেয়নি, বরং উদ্বুদ্ধ করেছে। অপরদিকে ইসলাম বলে, বিক্রেতা জেনে-বুঝে দোষ গোপন করলে গোনাহগার হবে। আর জেনে বা না জেনে গোপন করা হলে ক্রয় করার পরও ক্রেতা পণ্য ফেরত দেওয়ার অধিকার লাভ করবে।

অপরাধ ও দণ্ড : যে কোনো অপরাধের শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রদান করা হয়েছে। যা উক্ত আইনের ধারা ৩৭ থেকে ৫৫ পর্যন্ত অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বড় একটা ফাঁক রয়ে গেছে। এসব শাস্তি ও দণ্ড তখনই প্রদান করা হবে, যখন ভোক্তা নির্ধারিত আদালতে অভিযোগ করবে এবং তা প্রমাণিত হবে। দ্বিতীয়ত অভিযোগ করা ছাড়া ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে আইনত বড় কোনো সুযোগ নেই। তৃতীয়ত আদালত ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতার যে দুর্ভোগ, তাতে অভিযোগকারীর মনে হতে পারে, হয়তো নিজেই অপরাধ করেছেন।

মোটকথা, এ শাস্তিগুলো মূলত বড় বড় ক্রেতা ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করবে; ভোক্তাদের মধ্যে যাদের সংখ্যা নিতান্ত কম। অপরদিকে সাধারণ ভোক্তা অধিকার এ আইনে কতটা সুরক্ষিত, তা পত্রপত্রিকার সংবাদ দেখলেই অনুমান করা যায়।

জরিমানার অর্থের ২৫ শতাংশ প্রদান : দায়েরকৃত আমলযোগ্য অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত ও জরিমানা আরোপ করা হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর ধারা ৭৬ (৪) অনুযায়ী আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগকারীকে প্রদান করা হবে। ইসলাম বলে, যতটুকু সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ততটুকুই তার প্রাপ্য। এর অধিক সে পাবে না। কারণ, এতে বিক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্রেতা তার পাওনার চেয়ে বেশি নিচ্ছে। আসলে ইসলামের ভোক্তা অধিকার নীতি ক্রেতাবান্ধব, তবে বিক্রেতার বিপক্ষে নয়। অপরদিকে বর্তমান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনেকটা বিক্রেতাবান্ধব এবং ক্ষেত্রবিশেষ ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে অসম্পূর্ণ।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকাইমাম ও খতিব, বাইতুস সালামজামে মসজিদ, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা