জীবিকা নির্বাহে ইসলাম
আবদুল্লাহ নোমান
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জীবিকা মানব জীবনের একটি মৌলিক ও অপরিহার্য দাবি। এর প্রান্তিক উপেক্ষা যেমন ডেকে আনে বৈরাগ্যের লাঞ্ছনা, তেমনি এর অবাধ প্রতিযোগিতাও বয়ে আনে কারুনের বঞ্চনা। জীবিকা নির্বাহের আসমানি ব্যবস্থাপনার দিকে নজর বুলালে এ কথা স্পষ্ট হয় যে, রিজিক আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত; তবে উপার্জন আমাদের দায়িত্ব। তিনি সৃষ্টিজগত সৃষ্টি করার সঙ্গে সঙ্গে তার রিজিকের দায়িত্বও নিজ একান্ত অনুগ্রহে নিয়েছেন। মনোরম এ বসুন্ধরার রকমারি উদ্ভিদ থেকে শুরু করে নানা প্রজাতির পাখপাখালি, জল-স্থলের বিচিত্র প্রাণীজগতসহ সব সৃষ্টির একমাত্র প্রতিপালক আল্লাহতায়ালা। নীলাকাশে সন্তরণরত মেঘমালা, জ্যোৎস্নাময় চাঁদ, প্রখরতেজী সূর্য, মৃদুমন্দ বাতাস, কূল-কিনারাহীন মহাসমুদ্র, কলকল ধ্বনিতে বয়ে চলা নদ-নদী আর দৃষ্টিনন্দন গাছগাছালি- সবই আল্লাহতায়ালার আদেশে বিশ্বজগতের সেবা করে যাচ্ছে। অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ করছে মানুষকে। আমরা অবলীলায় পাচ্ছি প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয়, আলো-বাতাস, অক্সিজেন এবং জীবন ধারণগুলোর উপকরণ। সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা হিসেবে যেমন তিনি অদ্বিতীয়, তেমনি প্রতিপালক হিসেবেও অতুলনীয়।
উপায় অবলম্বন তাওয়াক্কুল পরিপন্থি নয় : বান্দার জন্য আল্লাহ কর্তৃক বরাদ্দকৃত রিজিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সে পাবেই। কাজেই এ ব্যাপারে একমাত্র তার ওপর ভরসা রাখতে হবে, তাওয়াক্কুল করতে হবে। সেই সঙ্গে সাধ্য অনুযায়ী উপায়-উপকরণও অবলম্বন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, উপায় অবলম্বন তাওয়াক্কুল পরিপন্থি নয়। কেননা, আল্লাহতায়ালার শ্বাশ্বত রীতি হচ্ছে, তিনি সাধারণত উপায়-উপকরণের পর্দার আড়ালে রিজিক দিয়ে থাকেন। তাওয়াক্কুল যেমন তার অকাট্য হুকুম, তেমনি উপায় অবলম্বনও তার অমোঘ বিধান। তাই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা মানে তার আদেশ অমান্য করা। এর ফলে অভাব ও সংকট দেখা দিলে তা তার আদেশ অমান্য করারই পরিণাম। মোমিনের হৃদয়ে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল থাকতে হবে যে, উপায় অবলম্বন ফলপ্রসূ হবে মহান আল্লাহর ইচ্ছাতেই। এসবের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই যে, তা অবলম্বন করলে রিজিক প্রাপ্তি অবশ্যম্ভাবী, অন্যথায় অপ্রাপ্তি অনিবার্য। এ জন্য কখনো কখনো যাবতীয় উপায় অবলম্বনও ভেস্তে যায়, আবার কখনও উপায় ছাড়াই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়। তাই একদিকে যেমন যথাসাধ্য উপায় অবলম্বন করতে হবে, অন্যদিকে আল্লাহতায়ালাই মূলদাতা- এ বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর ওপর পূর্ণ তাওয়াক্কুলও করতে হবে। রিজিক অন্বেষণের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নামাজ শেষ হয়ে গেলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর। আর বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ কর; যাতে সফলকাম হও।’ (সুরা জুমা : ১০)। কোরআন মাজিদের পরিভাষায় আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান দ্বারা ব্যবসা বা অন্য কোনো উপায়ে জীবিকা উপার্জনকে বোঝানো হয়। (তাফসিরে তাওযিহুল কোরআন : ৩/৫০২)।
রিজিকের বিশ্বাসে মধ্যম পন্থা কাম্য : বাস্তব সত্য হলো, মানুষের রিজিক বণ্টিত, সুনির্ধারিত। এ ক্ষেত্রে মানুষ বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির দুই প্রান্তিকতার শিকার। দুটিই সত্যচ্যুত, প্রত্যাখ্যাত ও বিভ্রান্ত। এদের একদল হচ্ছে বৈরাগ্যবাদী, আরেকদল বস্তুবাদী। বৈরাগ্যবাদীরা মনে করে, রিজিক যখন বণ্টিত, আমার কাছে রিজিক এমনিতেই চলে আসবে। কোনো কাজ করার প্রয়োজন নেই। তারা নিজেদের দাবির পক্ষে রাসুল (সা.)-এর একটি হাদিস দলিল হিসেবে পেশ করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। যেখানে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা যদি সত্যিকারার্থে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কর, তবে তিনি তোমাদের রিজিক দেবেন, যেমন পাখিদের রিজিক দেন। তারা সকালে ক্ষুধা নিয়ে বেরোয়, সন্ধ্যায় তৃপ্ত ও পরিতৃপ্ত হয়ে (নীড়ে) ফেরে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম : ৭৮৯৪)। একটু চিন্তা করলেই বুঝে আসবে যে, মূলত এ হাদিস তাদের পক্ষে নয়, বিপক্ষে। পাখিরা তো নীড়ে বসে থেকে রিজিকের অপেক্ষা করে না, বরং তারা রিজিকের সন্ধানে দিক-দিগন্তে ছুটে যায়। রিজিক তালাশে যারপরনা-ই প্রচেষ্টা চালায়। ফলে তারা পরিতৃপ্ত হয়ে নীড়ে ফেরে। মনে রাখতে হবে, বৈরাগ্যবাদ তথা পরিবার-পরিজন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পার্থিব সব আনন্দ ও বিষয়ভোগ পরিহার করে ইবাদতে লিপ্ত থাকা ইসলাম অনুমোদন করে না। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলতেন, ‘তোমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের ওপর কঠোরতা আনয়ন কোরো না, তাহলে আল্লাহও তোমাদের ওপর কঠোর বিধান চাপিয়ে দেবেন। নিশ্চয়ই অতীতে একটি জাতি তাদের নিজেদের জন্য কঠোরতা গ্রহণ করেছিল। ফলে আল্লাহতায়ালাও তাদের ওপর কঠোর বিধান চাপিয়ে দিয়েছেন। গির্জা ও পাদ্রীদের উপাসনালয়ে যে লোকগুলো আছে, ওরাও তাদের উত্তরাধিকারী।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৯০৪)। পবিত্র কোরআনে রয়েছে, ‘বৈরাগ্য তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করেছিল। আমি তাদের জন্য এ বিধান করিনি।’ (সুরা হাদিদ : ২৭)।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম