মানবতার হারানো বিধান
আবদুল্লাহ নোমান
প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পৃথিবীর প্রত্যেক ব্যক্তিই কোনো না কোনোভাবে অন্যের মুখাপেক্ষী। পরনির্ভরশীলতার এ অনুপেক্ষ বাঁধন থেকে মুক্ত নন ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা কেউ। মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে মানবতার অনিবার্য দাবি হলো, দুঃসময়ে একে অপরকে বিনাস্বার্থে আর্থিক সহযোগিতা ও ঋণ প্রদান করা। এতে যেমন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি, মানুষের হৃদয় নিংড়ানো দোয়া ও অবারিত নেকি লাভ করা যায়, তেমনি এর দ্বারা সমাজ হয় দয়া, ভালোবাসা ও হৃদ্যতায় সিক্ত; পরস্পরের কল্যাণকামিতায় সুশোভিত। এ কর্জ প্রথা মুসলিম উম্মাহর হারানো ঐতিহ্য, মানবতার নিহত বাঁধন।
ঋণ দিতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে : আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। নিয়ত যদি পরিশুদ্ধ হয়, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ উদ্দেশ্য হয়, তাহলে অল্প আমলেও মেলে অনেক নেকি। পক্ষান্তরে নিয়ত যদি খারাপ হয়, তাহলে পাহাড়সম আমলও বৃথা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সব আমল (এর ফলাফল) নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তি যা নিয়ত করে, তা-ই পাবে। সুতরাং যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উদ্দেশে হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্যই হবে। পক্ষান্তরে যে দুনিয়া লাভের উদ্দেশে কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত সে হিসেবেই গণ্য হবে।’ (বোখারি : ৬৬৮৯)।
ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত গ্রহণ করা যাবে না : ঋণদান কোনো ব্যবসা নয়, পুণ্যময় মানবিক সহযোগিতা। মানবতার ধর্ম ইসলামে ঋণের উদ্দেশ্য আর্থিক প্রবৃদ্ধি নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং বিপদগ্রস্তের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করাই এর অভীষ্ঠ লক্ষ্য। কিন্তু এ সহযোগিতার আড়ালে ব্যবসায়িক বা অন্য কোনো সুবিধা অর্জনের হীন স্বার্থ-চরিতার্থ করার সুযোগ নেই। তাই ঋণগ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় যা নিয়েছে, তা কিংবা তার অনুরূপ ফেরত দিতে আদিষ্ট; এর অতিরিক্ত নয়। ঋণদাতা তার প্রদত্ত অর্থ থেকে সামান্য বেশি নিলেও তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। তবে পূর্বশর্ত ছাড়া ঋণগ্রহীতা যদি পাওনা আদায়ের সময় ঋণদাতাকে অপ্রত্যাশিতভাবে খুশি মনে কিছু বাড়িয়ে দেয়, তাহলে তা বৈধ। জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে এলাম। তখন তিনি মসজিদে ছিলেন। তিনি বললেন, ‘দুই রাকাত সালাত আদায় কর।’ তাঁর কাছে আমার কিছু ঋণ প্রাপ্য ছিল। তিনি আমার ঋণ আদায় করলেন। পাওনার চেয়েও বেশি দিলেন। (বোখারি : ২৩৯৪)।
ঋণ দিয়ে সুবিধা ভোগ করা যাবে না : কাউকে ধার দিয়ে বিনিময়ে কোনো প্রকার সুবিধা ভোগ করা, উপঢৌকন গ্রহণ করা কিংবা সুদণ্ডঘুষ নেওয়া সম্পূর্ণ হারাম। আবু বুরদাহ (রহ.) বলেন, একবার আমি মদিনায় এসে আবদুল্লাহ বিন সালাম (রা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি কি আমাদের এখানে আসবে না? তোমাকে আমি খেজুর ও ছাতু খেতে দেব। একটি ঘরে থাকতে দেব। তুমি এমন স্থানে (ইরাকে) বসবাস করছ, যেখানে সুদের প্রচলন খুব ব্যাপক। অতএব, কারও কাছে যদি তোমার কোনো পাওনা থাকে, আর সে যদি তোমাকে হাদিয়া বা উপহার হিসেবে এক বোঝা খড় বা এক বোঝা যব কিংবা এক আঁটি ঘাসও দেয়, তুমি তা গ্রহণ করবে না। কেননা, তা সুদের অন্তর্ভুক্ত।’ (বোখারি : ৩৮১৪)। তবে উভয়ের মাঝে যদি আগে থেকেই হাদিয়া আদান-প্রদানের প্রচলন থাকে, তাহলে সেই উপহার প্রদান বা গ্রহণ করতে অসুবিধা নেই। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে ঋণ দেয়, অতঃপর ঋণগ্রহীতা যদি দাতাকে কোনো হাদিয়া বা উপহার দেয়, তবে তা গ্রহণ করবে না অথবা যদি ঋণগ্রহীতা তার যানবাহনের ওপর ঋণদাতাকে বসাতে চায়, তবে এর ওপর বসবে না। অবশ্য যদি ঋণ নেওয়ার আগে থেকে তাদের মধ্যে ওইরূপ ব্যবহার প্রচলিত থাকে, তবে তা ভিন্ন কথা।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪৩২)।
ঋণ দিয়ে ছায়াও ভোগ করলেন না যিনি : বর্ণিত আছে, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এক ব্যক্তিকে কিছু ঋণ দিয়েছিলেন। একদিন তিনি এর তাগাদায় তার বাড়ি যান। তখন ছিল তীব্র গরমের সময়। তিনি ভাবলেন, ঋণগ্রহীতা ঘর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত তার বাড়ির দেয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকি। সঙ্গে সঙ্গেই চিন্তা করলেন, যদিও শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এ কাজ নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু তাকওয়া ও আল্লাহভীতির দাবি হলো, আমি (ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির) ছায়া থেকেও উপকৃত হব না। অতঃপর ঋণগ্রহীতা অনেক বিলম্বে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, আর ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ততক্ষণ প্রচণ্ড গরমেই রোদে দাঁড়িয়ে থাকেন।’ (মিরকাত : ৬/৬৯)।
ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণ করা জঘন্য অপরাধ : বর্তমানে অধিকাংশ ধনকুবেররা সুদ ছাড়া ঋণ দিতে চায় না। অথচ সুদ কতটা ঘৃণ্য কদাকার কুৎসিত ও জঘন্য অপরাধ, তা বহু হাদিস থেকে অনুমেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সুদের মাত্র একটি রৌপ্যমুদ্রাও যে ব্যক্তি জেনে-শুনে খায়, তার গোনাহ ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও বেশি হয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ২২০০৭)। তিনি আরও বলেন, ‘সুদের গোনাহের ৭০টি স্তর রয়েছে। এর সবচেয়ে নিম্নস্তর হলো, আপন মাকে বিয়ে করা।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৭৪)। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) আরো বলেন, মেরাজের রাতে আমি এমন এক শ্রেণির লোকের কাছে পৌঁছুলাম, যাদের পেট ঘরের মতো বিশাল। এর ভেতরে বহু সাপ রয়েছে, যা তাদের পেটের বাইরে থেকে দেখা যায়। আমি (আমার সঙ্গীকে) জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে জিবরাইল! ওরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘ওরা সুদখোর।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৭৩)।
ঋণ দিয়ে বন্ধকী জমি বা বাড়ি ভোগ করা হারাম : আমাদের দেশে ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণের একটি প্রচলিত প্রক্রিয়া হলো, জমি বন্ধক প্রথা। এটি মূলত ঋণ প্রদান করে বিনিময়ে সুদ গ্রহণেরই একটি প্রকার। এতে জমি ভোগ করার শর্তেই ঋণ দেওয়া হয় এবং ঋণের সুবিধা পাওয়ার কারণেই জমির মালিক ঋণ প্রদান করে থাকে; যা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। উল্লিখিত কারবার বৈধভাবে করতে চাইলে শুরু থেকেই বন্ধকী চুক্তি না করে ভাড়া বা লিজ চুক্তি করবে। এ ক্ষেত্রে জমিটি আর উল্লিখিত ঋণের বন্ধক হিসেবে বহাল থাকবে না, বরং তা ভাড়া চুক্তির অধীন বলে বিবেচ্য হবে। যার বিবরণ হলো, জমির মালিক জমি ভাড়া দেবে। তার যত টাকা প্রয়োজন, সেজন্য যত বছর ভাড়া দিতে হয়, একত্রে তত বছরের জন্য ভাড়া দেবে। যেমন- এক বিঘা জমির বার্ষিক ভাড়া ৫ হাজার টাকা। মালিকের ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। তাহলে সে ৪ বছরের জন্য জমি ভাড়া দেবে। আর অগ্রিম ২০ হাজার টাকা নিয়ে নেবে। এ ক্ষেত্রে জমির ভাড়া স্থানীয় ভাড়া থেকে সামান্য কমবেশিও হতে পারে। এরপর ভাড়ার মেয়াদ শেষ হলে অর্থদাতা জমি ফেরত দেবে, কিন্তু প্রদেয় টাকা ফেরত পাবে না। অবশ্য সময়ের আগে ফেরত দিলে যে কয়দিন ভাড়ায় ছিল, সে পরিমাণ ভাড়া কর্তন করে অবশিষ্ট টাকা ভাড়াটিয়া ফেরত পাবে। তবে এ ক্ষেত্রে ভাড়া যৌক্তিক ও প্রচলিত বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এত কম ভাড়া নির্ধারণ করা যাবে না, যার কারণে এমন সন্দেহ হয় যে, ঋণের কারণে ভাড়া অস্বাভাবিক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনটি হলেও তা ঋণ দিয়ে সুবিধা ভোগ করা বলে বিবেচ্য হবে; যা সুদগ্রহণের অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া ঋণ আদান-প্রদানের সঙ্গে জমি ভাড়া দেওয়ার শর্তও করা যাবে না। এমনিভাবে ঋণ দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাসা বা ফ্ল্যাটে বিনা ভাড়ায় থাকার সুবিধা ভোগ করাও হারাম। বর্তমানে জুয়েলারি দোকানে সোনা বন্ধক রেখে লাভের ওপর লোন প্রদান করার প্রচলিত পদ্ধতিও সুদের অন্তর্ভুক্ত। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৪৮২, বাদায়েউস সানায়ে : ৫/২১২)।
কিস্তিতে বিক্রির বিধান : বাজারে ফ্রিজ, কম্পিউটার, তাপবিদ্যুৎসহ নানা বৈদ্যুতিক সামগ্রী কিস্তিতে বিক্রি হয়। এসব বিক্রিতে সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে একটা নির্দিষ্ট হারে সুদ বাড়ার শর্তারোপ করা হয়। এটাও সুদের অন্তর্ভুক্ত। তাই এ ধরনের শর্ত সম্পূর্ণ নাজায়েজ। আর বাধ্য হয়ে কেউ এ ধরনের শর্তে ক্রয় করলে নির্ধারিত মেয়াদের ভেতরই কিস্তি পরিশোধ করতে হবে; নইলে সুদ দেওয়ার গোনাহ হবে। অবশ্য কিস্তির মেয়াদ কমবেশি হওয়ার কারণে পণ্যের মূল্য কমবেশি করা জায়েজ। তবে শর্ত হলো, কেনাবেচার সময় মেয়াদ অনুযায়ী একটা মূল্য চূড়ান্ত করে দিতে হবে। অর্থাৎ গ্রাহক যদি পণ্যটি কিস্তিতে নেয়, তবে তা কত মাসে পরিশোধ করবে এবং মোট কত টাকা পরিশোধ করবে, তা চুক্তির সময়ই নির্ধারণ করে নিতে হবে। বেচাকেনা সম্পন্ন হওয়ার পর কোনো কিস্তি আদায়ে বিলম্ব হলেও পূর্ব নির্ধারিত মূল্য থেকে বাড়ানো যাবে না। অন্যথায় তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। (রদ্দুল মুহতার : ৫/৯৯)।
ব্যাংকের ইন্টারেস্ট সুদের অন্তর্ভুক্ত : বর্তমানে ব্যাংকিং সুদের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে; যা অর্থনীতির ভাষায় ‘ইন্টারেস্ট’ হিসেবে কথিত। ব্যাংকে মানুষ টাকা জমা করে; বিনিময়ে ব্যাংক তাদের সুদ প্রদান করে, যা সম্পূর্ণ হারাম। ইন্টারেস্ট ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে সওয়াবের নিয়ত না করে জাকাত খাওয়ার উপযুক্ত ফকির-মিসকিনদের দিয়ে দিতে হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৭/১৬)। কোনো অবস্থাতেই সেই টাকা মসজিদণ্ডমাদ্রাসা বা কোনো জনকল্যাণমূলক কাজ (যেমন- রাস্তাঘাট বা পাবলিক টয়লেট নির্মাণ) ইত্যাদিতে খরচ করা যাবে না। (ইমদাদুল মুফতিন : ৫৮৬)।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম